
একটি হত্যার পিছনের গল্প
সেদিন ছিল গরুর হাট। রাস্তা দিয়ে দলে-দলে গরু দৌড়াচ্ছিল, পিছনে দৌড়াচ্ছিল তাদের মালিকও। মানে রাখাল। আমিও একজন রাখাল।
আমার ছিল দুটো বয়স্ক গরু। আমার সামনে গরু দুটো যাচ্ছিল এবং পিছনে পিছনে আমি দৌড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার গরু দুটো ডানে ঘুরে জিলকিয়ে দৌড় দেয়। আমি বুঝে উঠার আগেই গরু দুটো পশ্চিম মাঠের ভোগে গিয়ে আড়চোখে তাকায়। আমি তাকিয়ে দেখতে পাই, জুতামোজা পায় হলুদ শার্ট গায় এবং কালো প্যান্ট পরা লোকটিকে চিৎ করে শুয়ায়ে কোরবানির গরুর মত জবাই করে ফেলে। হালকা কিছুক্ষণ হাত-পা দাপাদাপি করে অসাঢ় পড়ে থাকে লাশ। গরুর ব্যাপারীরা লাশটির দিকে তাকিয়ে, না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল। অথচ আমার গরু দুটোর ডাগা ডাগা চোখে তাকানো দেখে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ভয়ে ভয়ে মাঠ ভেঙে, গরু না নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। এসে পাশের বাড়ির জলি খালার বাড়ি উঠেছিলাম। ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম আর মনে মনে বিড়বিড় করে বলছিলাম আমি কিছু দেখিনি-দেখিনি গো!
জলি খালা কাছে এসে মাথায় ও পিঠে তার নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কি জানি, কিভাবে খালা বুঝেছিল যে আমি ভয় পেয়েছি।
খালার ইতিহাস বড়ই লম্বা এবং ট্রোজেডিপূর্ণ ছিল। একাত্তরের যুদ্ধের সময় তার একমাত্র ছেলে আদম আলী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আবুরি গ্রামের ক্যানেলের ধারে, ঠিক উলুবনে ভরা গোরস্থানটার পাশে খালার বাড়ি। বাড়ি বলতে খড়ের চাল এবং মাটির মজবুত দেওয়াল। এখানে একবার পাকসেনা ও রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ হয়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার। এই যুদ্ধে মধু নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল।
খালার বাড়ি থেকে দক্ষিণে সাত-আট কিলোমিটার দূরে প্রাগপুর গ্রামের গোরস্থানে ছয়জন কৃষকের লাশ সারিসারি দাফন করা রয়েছে। সেদিনের সে যুদ্ধে জয়বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে এই ছয়জন কৃষক যুদ্ধের মাঠ দখল করতে যাচ্ছিল। ওই সময় পাকহানাদারদের বুলেট তাদের বুক ঝাজরা করে দিয়েছিল।
ওই যুদ্ধটা কাকিলাদহের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
যুদ্ধ শেষে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল, তাদের দাফন সম্পূর্ণ করে, এলাকার বিপ্লবী মানুষেরা। তারপর দাফন করেছিল এই ছয়জন কৃষককে।
আমি ঠিক প্রাগপুর গোরস্থান পার হয়ে ওসমানপুর হারদীর মাঠের মধ্যে গরুর সাথে যেতে যেতে দিনে-দুপুরে মানুষ জবাই করতে দেখেছিলাম। পরে গরু দুটো ঠিকই বাড়ি এসেছিল। কিন্তু আমি তো বাড়ি ঘুমাতে পারি না। আমার সামনে জবাই করা মানুষটির হাতপা শুধুই নড়তে থাকে। চোখ বুজলেই দেখতে পাই ওই দৃশ্য।
জলি খালার ছেলে আদম আলী দেশ স্বাধীন হলে, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত বিপ্লবী পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। তখন তিনি অস্ত্র নিয়ে ঘুরতো। ঘুরতে ঘুরতে অপর একটি বিপ্লবীগ্রুপ রাতে এসে জলি খালার সামনেই নাকি জবাই করেছিল এবং তারা শ্লোগান দিয়েছিল এক প্রতিবিপ্লবী ও সংশোধনবাদীকে হত্যা করা হলো, মার্কসবাদ-লেলিনবাদ জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ।
জলি খালা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। খালাও আমার মত জবাই করা আদম আলীর হাতপা নড়তে দেখতো। দেখতে দেখতে একদিন স্মৃতি-বিস্মৃতি হয়ে যায়। আমি খালার কাছে শুয়ে থেকে থেকে এ গল্প শুনেছিলাম।
আমিও অনেকদিন পর ভুলে যাই সেদিনের জবাই করা লাশের হাতপা নড়া দেখা। এখন শুধু বৃদ্ধ জলি খালা ভগ্ন শরীর নিয়ে, সামনে ঝুঁকে পড়ে ধীরে ধীরে হাঁটে আর আমার কাছে এসে মুখে ও মাথায় খসখসে জড়সড়ো হাত বুলিয়ে দেয়। হাত বুলানোর সময় খালার দুচোখ বেয়ে নীরবে পানি ঝরে, গাল বেয়ে পায়ের উপর পড়ে।
একদিন ভাংবাড়িয়া গ্রাম থেকে হিরা নামে একটি মেয়ে আসে। সে এসে আমার হাত ধরে কান্নাকাটি করে, আপনি আমার ধর্মের ভাই, শুধু একদিন কোর্টে গিয়ে সাক্ষীটা দিয়ে আসবেন।
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, পারব না বোন-পারবো না। বলেই পালাই।
তখন এলাকা থেকে রশীদ-তালেবের দাপট শেষ হলেও মরেনি তারা, যারা গরুর হাঁটের দিন হিরার স্বামী মহসীনকে হত্যা করেছিল।
হিরারও অনেক সুন্দর জীবনের গল্প ছিল। হিরা মিয়া বাড়ির মেয়ে। খুব ভালো গান গাইতে পারত। মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মহসীনের সাথে প্রেম করে, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। মহসীনকে যখন হত্যা করে তখন হিরার ফুফা জাতীয় সংসদের এমপি ছিল। তবুও রাষ্ট্র ওই হত্যার বিচার করতে পারেনি। পরে অবশ্য সেই হত্যাকারীরা, নিজেরা নিজেরা দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে, নিজেরাই নিজেদের হত্যা করেছিল। হিরার জীবনের আরো দূর্ঘটনা ঘটে, তার এক ছেলে নদীতে ডুবে মারা যায়। তার মেয়েও প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এখন হিরা বড়ই অসহায়, ঠিক জলি খালার মত।
আমাকে পুলিশ খুঁজছে, খুঁজছে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের আরো দুটি গ্রুপ। সব সময় থাকি দৌড়ের উপর, ভয়ের উপর; বুক কাঁপে দুরু দুরু।
ঘাসপাতার জীবন আমার। মানুষের সাথে থাকি কী করে! কবরস্থানের ভিতর পালিয়ে থাকি। জলি খালা খেতে দেয়।
২
জলি খালা- মাত্র নয়-দশ বছর বয়সে জলি খালার বিয়ে হয়েছিল। সে সময় এ বিয়েকে বাল্য বিয়ে বলা হতো না। কিশোরী খালা তখন দ্বায়িত্বশীল বধু। ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াত আর গৃহস্থালিতে ব্যস্ত থাকত। হাস-মুরগীর মত জীবন ছিল।
গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে গৃহস্থ বাড়িই বিয়ে হয়েছিল। গোয়ালঘর পরিস্কার, উঠান ঝাড়ু দেওয়া, থালাবাসন মাজা নিত্যদিনের কাজ ছিল। এর সাথে ছিল ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে ঢেঁকিতে ধান ভানা। সবই করতে হত জলি খালাকে।
তখন ছিল পাকিস্তানী আমল। হুক্কু আর কোইলেতে চিটিগুড়ে মাখান তামাক সাজিয়ে শ্বশুরমশাই ফড়াৎফড়াৎ শব্দ করে হুক্কো টানতো। আর শ্বশুরের চার ছেলে ও রাখাল মিলে ভইড়-ভইড় করে লাঙ্গলের মুঠো ধরে গরু-মোষের পিছন পিছন হাঁটতো।
চলছিল এভাবেই জীবন।
কিন্তু এক কার্তিকের রাতে জলি খালার স্বামী কলেরা রোগে মারা যায়। তখন কলেরা রোগ হয়ে গ্রামের মানুষ মরে উজাড় হয়ে যেত। শূন্য হয়ে যেত বাড়ি ভর্তি মানুষ। কেঁদে কেঁদে এক সময়, মানুষ আবার জীবনের স্বাভাবিক পথে, স্বাভাবিক নিয়মে চলা শুরু করত। যখন জলি খালার স্বামী মারা যায় তখন তার পেটেই ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা আদম ভাই।
সে সময় স্বামী মারা গেলে মেয়েরা সাধারণত বিয়ে করত না। জলি খালাও সমাজের এই মুল্যবোধেই বিশ্বাসী ছিল। আর সে কারণে জলি খালার পেটের সন্তানই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। একদিন মোরগ ডাকা ভোরে ট্যাট্যা করে, উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল, এ বাড়িতে আদম আলী এসেছে। তার চিৎকারে যেন সারা এলাকা কেঁপে উঠেছিল। শিশু আদমের কান্নার স্বরে বাড়িময় খুশির আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল পূর্বদিকের লাল আভা। হনহন করে সূর্য উঠে এসে আলোকিত করে দিয়েছিল মাঠঘাট প্রান্তর।
একটু একটু করে বড় হতে থাকে আদম ভাই। তার খেলার সাথী ছিল মারফত আলীসহ বেশ কিছু দূরন্ত কিশোর।
বার-তেরো বছর বয়স হওয়ার সময়ই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।
আবুরি বাজারের ক্যানেলের ধার বেয়ে দক্ষিণ দিকে এসেই কৃষকনেতা মারফত আলীর বাবার বাড়ি। ভাঙা দেওয়াল আর বেড়ায় ঘেরা। এ ঘর থেকে প্রতিবাদী এই কণ্ঠস্বরের জন্ম হয়েছিল। বন্ধুদের নিয়ে বীরদর্পে যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে এই তরুণেরা। সেই তরুণদের এক সঙ্গী আদম আলী, জলি খালার একমাত্র ছেলে।
মুক্তিযুদ্ধে বেঁচে গেলেও স্বাধীনতার পর মারফত আলীর এই সহযোদ্ধা আদম ভাই প্রতিপক্ষের হাতে মর্মান্তিকভাবে মারা যায়। এতিম ছিল জলি খালা, আদম ভাই মারা যাওয়ার পর একা হয়ে যায়। সঙ্গী হয় এই কবরস্থান। এখানেই তার রাতদিন কেটে যেত। প্রতিদিন কবর পাহারা দিতে দিতে এখন কবরের উলুবনের পাশেই মাটির ঘর করে থাকে সে।
৩
দূর্বাঘাসের সাথে মিশে যাই, মিশে যাই সুন্দরী যুবতী রমনীর বুকের সাথে, মুখ দিয়ে ঘষি নগ্ন নাভী। দু’পাশে কবর, মাঝখানে থাকি আমি। একদিন শুনেছিলাম, মেহেরনগরের আইনালকে সিরাজ বাহিনীর লোকেরা পুকুরের মধ্যে গুলি করে মেরেছে।
তারই দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে এসে জলি খালার আশ্রয়ে থাকা শুরু করে। সেই মেয়ের নাম কমলা। ছোটবেলায় কমলা সুন্দরী যাত্রাপালা দেখতাম। সেই যাত্রার কল্পিত নায়িকা হয়ে যায় আমার চোখে, জলি খালার আশ্রিত সুন্দরী কমলা।
সে দিনের পর দিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাকে খাবার দিয়ে যায়। আর আমি চারপাশের কবরের ফাঁকে একটুখানি জায়গা করে নিই। দূর্বাঘাসকে করি বিছানা। যখন নেশা জেগে যায় আমার, তখন আমি ভুলে যেতে থাকি, এ যে কবরস্থান!
হায় আমার জীবন!- মানুষই মনে হয় নিকৃষ্ট প্রাণি, যে প্রাণি সেক্স আর স্বার্থের জন্য সব কিছু করতে পারে। আমি বড়ই সুচতুর ও চালাক প্রাণি।
এক সময় কোনো এক সামরিক শাসক আইন করেছিল, যারা এসএসসি পরীক্ষা দিবে, তারা একজন বা দু’জন মানুষকে স্বাক্ষর জ্ঞান শিখাবে। আমি যখন আশাননগরের নদীর ধারে মালিতা বাড়ি কাজ করতাম, তখন ওই বাড়ির মালিকের ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী হয়ে আমাকে এক ঘণ্টা করে পড়াত। তখনই নাম লিখতে ও পড়তে শিখি। তারপর ওই নদীর ধারে নাইট স্কুল হলে নিয়মিত পড়তে যেতাম। বেশ লেখাপড়া শিখে ফেলি। এরই মধ্যে এক পা খুঁড়া, মাথা কাঁচাপাকা কুঁকড়ানো চুল ওয়ালা এক লোক এসে রাতে আমাদের সাথে সঙ্গ দিত। তখন বড় বোয়ালিয়া টু বড়বড়ি রাস্তা পাকা হয়নি, কাঁচা ছিল। নদীর ধারে কাঁচা রাস্তা সংলগ্ন বটগাছের নিচে একটি বাঁশের মাচা পাতা ছিল। সেখানে বসে বসে গল্প শোনাত সেই লোকটি। পরে জেনেছিলাম, উনার নাম কমরেড মধুবাবু। হায়-হায়রে অত বড় আন্ডারওয়ার্ল্ডের লিডারের সাথে কতদিন কত বছর থেকেছি। অথচ কেউ জানাতে পারেনি ইনি অনেক বড় কমিউনিস্ট লিডার। আমরা গ্রামের মানুষ কত বোকা?
কোথায় আমার ঠিকানা, কোথায় আমার চেতনা। গরীব হয়ে জন্মানোই যেন পাপ।
রাখাল, রাখালই থেকে গিয়েছিলাম। এখনো রাখালই আছি।
আমার মালিক যে গরুর ব্যাপারী সে জানে আমি মরে গেছি। এলাকার অনেকেই সেটাই জানে। শুধু জলি খালা জানত আমি তার ছেলে আদম হয়ে বেঁচে আছি কবরের পাশে দূর্বাঘাসের সাথে। এখন আর একজন জানতে পেরেছে, সে কমলা সুন্দরী।
আমার স্বপ্ন সোহাগী, সখের পুতুল। ওকে নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলি। ও খিলখিলিয়ে হাসে করিম ভাই যে কী?
ওর কথায় আমার নেশা ধরে যায়। আমরা দুজন হয়ে পড়ি আদিম মানুষ। সভ্য সমাজের বাইরের দু’জন প্রাণি। ইচ্ছেমতো থাকি কবরজঙ্গলে। পাশে পুরোনো কবরের বুকে আতাগাছ জন্মিয়ে বড় হয়েছে। সেই আতাগাছের এক চিলতে ছায়ায় দু’জনে মিলেমিশে শুয়ে থাকি। পোষাকহীন শুয়ে থাকার আদিম বাসনা আমাদের দু’জন নিত্যসঙ্গী হয়ে যায়।
৪
মধুবাবুর গল্প শুনতাম মুগ্ধ হয়ে। খাঁচায় বন্দী টিয়া পাখির ট্যাট্যা শব্দ শোনার মত অবস্থা। মনে মনে উড়তাম সমাজতন্ত্রের নীল আকাশে।
তার মুখেই শুনেছিলাম চে’গুয়েভার, হোচিমিন, ফ্রিদেল কাস্ট, মাওসেতুং বা কার্লসমাক্সের কথা। পৃথিবীকে বদলিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির কথা শোনাতেন। শুনতে শুনতে মনে মনে বিপ্লবী হয়ে উঠতাম। এর বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় এসে রাতের আঁধারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় কৃষকনেতা মারফত আলী। দিন যায় আর হত্যার পর হত্যা হতে থাকে। হত্যার শিকার হয়, মানু চেয়ারম্যান দিনদুপুরে। হত্যা হয়, রমজান, মন্টু, ছাত্তার, সালাম এবং রাহাতসহ তারা চার ভাই।
আইনশৃংখলার ব্যাপক অবনতির কারণে পুলিশ ও যৌথবাহিনী মাঠে নামে।
একদিন রশীদ তালেবকেও পুলিশ গুলি করে নিয়ে যায় থানায়। মিশ্র প্রতিক্রিয়া হতে থাকে মানুষের মাঝে। কেউ বলে ঠিকই হয়েছে, কেউ বলে ঠিক হয়নি। হত্যার পালা যখন বাড়তে থাকে তখন হারিয়ে যায় মধুবাবু।
তারপর শুনেছিলাম তিনিও মারা গেছে ক্রসফায়ারে।
এদিকে গোরস্থানে থাকতে থাকতেই একদিন পুলিশ এসে জলিখালার বাড়ি তল্লাসী চালায়। সেদিন আমি আর কমলা নতুন একটি কবরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম।
পচালাশের গন্ধে কমলা হকহক করে বমি করছিল। ওর বমির শব্দে আমি জীবনের ভয়ে অন্য কবরের মধ্যে শিয়ালের মতো ভিতর থেকে ভিতরে ঢুকে পড়ি।
কমলা যে কবে কখন গর্ববতী হয়ে উঠেছে আমি টের পাইনি।
সেদিনই ওকে কাছে পেয়ে অজান্তে ওর ফোলা ফোলা মুখ আর হালকা বড় তলপেট দেখে বুঝে ফেলি।
সে রাতে না খেয়ে ঝড়জঙ্গলে ভরা কবরে থাকতে গিয়ে আমাকে সাপে কামড় দেয়। সাপের বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। ঠিক তখনই পুলিশ এসে জলি খালা ও কমলাকে তুলে নিয়ে যায়।
আমি অন্ধকারে হারাতে থাকি। আমার চারদিক গাঢ়কালো আঁধার নেমে আসে। আমার মা যেন আমাকে ডাকছে, করিম আয় বাপ, কোলে আয়।
আমার মাও দুঃখের সংসার ছেড়ে বিষ খেয়ে মারা গিয়েছিল। যে বাড়ি গোয়াল ঝাড় দিত, থালাবাসন মাজত, সেই বাড়ির উঠানে বিষ খেয়ে চিৎকার করছিল, বাঁচাও গো বাঁচাও। মা আমার ভুল করে ধানে দেওয়া পোকামারা বিষ খেয়েছিল। ভেবেছিল পেট ব্যথার ঔষধ। মা’র পেটে যন্ত্রণা হত। তখন আমার বয়স আট কি দশ বছর ছিল। মায়ের পেট ব্যথা উঠলে ককিয়ে ককিয়ে কাঁদত,আমাকে নিয়ি নেও গো আল্লাহ। এত যন্ত্রণা সহ্য করতি পারছিনি। মায়ের পেটে কিসের কী যন্ত্রণা ছিল আমি জানতামও না, বা বুঝতামও না। তখন ডাক্তারও তেমন ছিল না। কবিরাজরা ঔষধ দিতো। মাদারগাছের ছাল, কাঁচাহলুদের রস অথবা নিমপাতা বেটে খেতে হত।
মা যেন তার দুহাত এগিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি জোরে চিৎকার করতে পারছি না। মুখ দিয়ে ভাতের ফেনার মত উতলিয়ে বেরিয়ে আসছে একটা কিছু।
ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ি একটি সাদা পুরানো কাফনের উপর। কাফনের উপর পড়ার সাথে সাথে পচপচ শব্দে পচা পানি বেরুতে থাকে। আমার সারা দেহে সে পচা রস জড়িয়ে ভিজে যেতে থাকে।
নাকে আর কোনো গন্ধ পাচ্ছিলাম না, শিয়ালগুলো খ্যাক খ্যাক করে কামড়াকামড়ি করছিল আর লাশ টেনে নিয়ে যাওয়ার সড়সড় শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি দেখতে পারছি এলাকার রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা লাশগুলো শিয়ালে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সব লাশ আমার দেহের উপর চেপে বসতে থাকে।