
উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দর্শন
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা শুরু হয় ইউরোপের উন্নত চিন্তা-চেতনার প্রভাবে। ইউরোপের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে যোগ হয় বেদ-বেদান্ত ও উপনিষদ কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা। বাঙালির মননে ভাব-সংঘাত ও সমন্বয় সমানতালে চলতে থাকে। মুসলিম মানসেও ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাব দেখা দেয়। কিন্তু তারা কোরান হাদিস থেকে মুক্ত হয়ে বিজ্ঞান নির্ভর চিন্তার দিকে অগ্রসর হয়নি। ফলে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উনবিংশ শতাব্দিতে ধর্মাশ্রিত জীবনধারা দেখা যায়। দর্শনচিন্তাতে ধর্মাশ্রিত ভাববাদী ধারা লক্ষ্য করা যায়। এ ধারার প্রধান ব্যক্তি রাজা রামমোহন রায়। তিনি ১৮১৪ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি সংস্কারপন্থীদের নিয়ে ১৮১৫ সালে ‘আত্মীয়-সভা’ স্থাপন করেন। প্রথম দিকে এ সভার অধিবেশন রামমোহনের বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হতো। কলকাতা শহরের ধনীদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয় রামমোহনের রায়ের আত্মীয়-সভা। এই সভায় বৈদান্তিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো। আত্মীয় সভায় শিবপ্রসাদ মিশ্র বেদ পাঠ করতেন এবং গোবিন্দ মালা ব্রহ্মসঙ্গীত করতেন। লোকনিন্দার ভয়ে অনেকে আত্মীয় সভা ত্যাগ করেছিলেন। সমালোচকরা আত্মীয় সভার সদস্যদের নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করতো। সমালাচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ব্রজমোহন মজুমদার, হলধর বসু, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ রামমোহন রায়ের সঙ্গে ছিলেন।
বহু ভাষায় পারদর্শী রামমোহন রায় ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন। তিনি আরবী, ফার্সি ভাষায় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও গ্রন্থ লিখেছেন। সংবাদকৌমুদ এবং পারস্য ভাষায় মিরাট আল আকবর নামে দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে রামমোহন রায়ের বেদান্ত দর্শনের অনুবাদ, ১৮১৫; বেদান্তসার এবং কেন ও ঈশোপনিষদের অনুবাদ, ১৮১৬; কঠ, মুণ্ডুক ও মাণ্ডুক্যোপণিষদের অনুবাদ এবং হিন্দু একেশ্বরবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ ইংরেজি ও বাংলাতে, ১৮১৭; সতীদাহ সম্বন্ধীয় বিচার পুস্তক, বৈষ্ণব গোম্বামীর সহিত বিচার পুস্তক, গায়ত্রীয় ব্যাখ্যা পুস্তক এবং সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ, ১৮১৮; সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তক, মণ্ডুক ও সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়।১ ফরাসী ভাষায় রচিত তুহ্ফাত্-উল্-মুআহ্হিদীন (একেশ্বর বিশ্বাসীদিগকে উপহার) এবং আরবি ভাষায় রচিত মানাজারাতুল আদিয়ান তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ। রামমোহন রায় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক ছিলেন। কলকাতা শহরেই তাঁর ছিল ছয়টি বাড়ি। রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করলেও ধর্মহীন শিক্ষাকে পছন্দ করতেন না। এ-সম্পর্কে প্রচলিত গল্পে আছে, একদিন কোনো একজন রাজা রামমোহন রায়কে এসে বললেন, ‘দেওয়ানজি, অমুক আগে ছিল Polytheist, তারপর হইয়াছিল diest, এখন হইয়াছে atheist, রামমোহন রায় হাসিয়া বলিলেন, শেষে বোধ হয় হইবে beast।’২ রামমোহন রায়কে দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে বাদশার দূত নিযুক্ত করে বিলাতে পাঠিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়েছে। ব্রিস্টলের Arnos Vale Cemetery-তে তাঁর সমাধি রয়েছে। ব্রিস্টলের Arnos Vale Cemetery-তে প্রবেশের মুখেই রাজার সমাধি। রাজা রামমোহন রায়ের সমাধিতে লেখা রয়েছে, Philosopher, Reformer, Patriot, Scholar, A founder father of Indian Renaissance. Arnos Vale Cemetery-তে প্রতিবছর রাজার জন্মদিনে উৎসব হয়। ব্রিস্টলের স্থানীয় লোকজন এই উৎসবের আয়োজন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম রাজা রামমোহন রায়। তাঁর তুহ্ফাত্-উল্-মুআহ্হিদীন গ্রন্থকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গ্রন্থ হিসাবে অভিহিত করা যায়। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি পৃথিবীর বহু দূর দেশে গিয়েছি। কখনো সমতল ভূমিতে, কখনো বা পার্ব্বত্য প্রদেশের নানাস্থানে বেড়িয়েছি। সর্ব্বত্রই দেখেছি যে সে সকল দেশের লোকেরা একটি বিষয়ে একমত এই যে এই জগতে সব কিছুরই আদি কারণ ও তার বিধাতারূপে (governor) এক পরম সত্তা বিদ্যমান আছেন।’৩ ঈশ্বরকে তিনি সর্বশক্তিমান হিসেবে অভিহিত করেছেন। ঈশ্বরই জগতের আদি কারণ। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘সর্ব্বশক্তিমান একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসই প্রত্যেক ধর্মের মূলসূত্র। জাতি বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের হৃদয় পরস্পরের প্রতি প্রীতি ভালোবাসা দিয়ে জয় করাই প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা একমাত্র ঈশ্বরের নিকট গ্রহণীয় বিশুদ্ধ পূজা।’৪ রামমোহন রায় খ্রিষ্টধর্মের একেশ্বরবাদ ও নীতিকথার অনুরাগী ছিলেন।৫ তিনি একেশ্বরাদ প্রচার করেছেন।
রামমোহন রায় বেদান্তদর্শনে রামানুজের অনুসারী। শঙ্করাচার্যের মতো তিনি জগতকে মিথ্যা বলেননি। তাঁর দৃষ্টিতে জগৎ বাস্তব। জগৎ মায়া নয়। ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ে, রবার্ট ওয়েন দ্বারা প্রভাবিত রামমোহন রায় জগতের উন্নয়নের জন্য পাশ্চাত্য ধরনের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছেন।
রামমোহন রায় ছিলেন ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর ভাববাদকে বস্তুগত ভাববাদ (objective idealist) হিসেবে অভিহিত করা হয়।৬
রামমোহন রায়ের ভাবশিষ্য উনবিংশ শতাব্দীর আরেকজন আত্মগত ভাববাদী দার্শনিক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মিল, বেন্থামের উপযোগবাদ এবং ইমানুয়েল কাণ্ট ও হেগেল দ্বারা দেবেন্দ্রনাথ প্রভাবিত ছিলেন। পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্য দর্শনের প্রভাবও তাঁর মধ্যে দেখা যায়। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমর্থন করেননি। তাঁর মতে, উপাস্য এবং উপাসক এক হলে উপাসনা করবে কে? শঙ্করাচার্য জীব এবং ব্রহ্মকে এক বলে অভিহিত করেছেন। জীবাত্মা এবং পরমাত্মাকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিন্ন হিসাবে দেখেননি। আত্মতত্ত্ববিদ্যা গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘জীবাত্মা পরমাত্মা হইতে ভিন্ন। আবার জড় হইতে জীবাত্মা যত ভিন্ন, তাহা অপেক্ষা অনন্তগুণে জীবাত্মা হইতে পরমাত্মা ভিন্ন। তাহার সমান আর কেহ নাই, তিনি অদ্বিতীয়।’৭ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ জীবনে দ্বৈতবাদ ত্যাগ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘আত্মা ও পরমাত্মা উভয়েই একত্রে রহিয়াছেন এবং উভয়েই পরস্পরের সখা। এ দুইজন সর্বদা একত্রে থাকেন। একজন আশ্রয়, একজন আশ্রিত; একজন ফলভোগী, আর একজন ফলদাতা। অতএব তাঁহার সঙ্গে আমাদের কেমন নিকট সম্বন্ধ।’৮ জগত এবং মানবাত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিরূপণ করে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘সমুদয় জগতে তাঁহার প্রতিরূপ; কিন্তু আত্মাতেই তাহার রূপ দেখা যায়। সৃষ্টির সৌন্দর্যে, মনুষ্যের মুখশ্রীতে, ধার্মিকের কল্যাণতর অনুষ্ঠানে তাঁহার ভাবের প্রতিরূপ মাত্র দেখা যায়। আত্মাতেই তাঁহার সাক্ষাৎ রূপ বিরাজ করিতেছে।’৯ ঈশ্বর বিষয়ক আলোচনার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সভাপতি এবং অক্ষয়কুমার দত্তকে সম্পাদক করে ১৮৫৩ সালে আত্মীয় সভা স্থাপিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান মনে করতেন। কিন্তু সম্পাদক, সভাপতির পক্ষে মত না দিয়ে বলেন, ‘ঈশ্বর বিচিত্রমান’। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এই বিষয়ে মতভেদের কারণে শেষ পর্যন্ত আত্মীয় সভা বন্ধ হয়ে যায়।১০ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঈশ্বর বিষয়ক মতবাদকে সর্বধরেশ্বরবাদ বা ঈশ্বরবাদ হিসাবে অভিহিত করা হয়। তাঁর অধ্যত্ম্যাবাদের শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে ঈশ্বরবাদ।১১ তিনি লিখেছেন, ‘আমি ঈশ্বরকে সর্ব্বত্র দেখিতে চাই।’১২ কান্ট, হেগেল দ্বারা প্রভাবিত হলেও শেষ পর্যন্ত উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদকে তিনি গ্রহণ করেছেন। সৃষ্টি এবং স্রষ্টা সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
সৃষ্টির কৌশল-চিন্তায় স্রষ্টার জ্ঞানের পরিচয় পাই, এবং নক্ষত্র-খচিত আকাশ দেখিয়া বুঝি তিনি অনন্ত-এই সূত্রটুকু ধরিয়া তাঁহার স্বরূপ মনের মধ্যে আরও খুলিয়া গেল। দেখিলাম, যিনি অনন্ত জ্ঞান, তাঁহার ইচ্ছাকে কেহ বাধা দিতে পারে না; তিনি যাহা ইচ্ছা করেন তাহাই হয়। আমরা, সকল উপকরণ সংগ্রহ করিয়া রচনা করি; তিনি, তাঁহার ইচ্ছায় সকল উপকরণ সৃষ্টি করিয়া রচনা করেন। তিনি জগতের কেবল রচনাকর্তা নহেন, তাহা হইতে উচ্চ; তিনি ইহার সৃষ্টিকর্ত্তা। এই সৃষ্ট বস্তুসকল অনিত্য, বিকারী, পরিবর্তনশীল ও পরতন্ত্র; ইহাদিগকে যে পূর্ণ জ্ঞান সৃষ্টি করিয়াছেন ও চালাইতেছেন, তিনি নিত্য, অবিকৃত, অপরিবর্ত্তনীয় ও স্বতন্ত্র।১৩
ঈশ্বর ও আত্মা সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্তর আলোচনা করেছেন। ঈশ্বর ও আত্মা সম্পর্কে দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুরের আলোচনা অধিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর আরেকজন ভাববাদী দার্শনিক কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪)। রামমোহন রায়ের যুক্তিবাদের চেয়ে তিনি ভক্তিবাদ দিয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ‘কেশবচন্দ্রের জীবন ও মনন একাধারে ভক্তিবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদ এবং সমাজ-সংস্কার ও মুক্তির প্রেরণা এক সমন্বিত রূপ পেয়েছে।’১৪ কেশবচন্দ্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তাঁর ঈশ্বর ছিল সর্বব্যাপী। তাঁর মতে, ঈশ্বরই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা; প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর প্রকাশমান, ইতিহাস ও মানবাত্মার মাধ্যমে ঐশি নির্দেশ অভিব্যক্তি লাভ করে।১৫ কেশবচন্দ্র মনে করতেন এশিয়াতেই মানবসভ্যতার পীঠস্থান। এশিয়াতেই জন্মেছেন পৃথিবীর অধিকাংশ মহান ব্যক্তি। রাজশক্তির প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল। ‘ইংরেজদের ভারত আগমনকে কেশবচন্দ্র ঐশি অভিপ্রায় বলে মনে করতেন এবং ইংল্যান্ডের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের স্বপক্ষেই ছিল তাঁর অভিমত।’১৬
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) ঊনিশ শতাব্দীর আরেক ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর দৃষ্টিতে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের সাহায্যে আমরা নতুন কোনো কিছু দেখি না। আত্মার দ্বারা পূর্বে যা দেখা হয়েছিল ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণে কেবল তারই প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। তিনি দ্বৈতবাদ খণ্ডন করে অদ্বৈতবাদ সমর্থন করেন। শেষ পর্যায়ে তিনি অদ্বৈতবাদে স্থির থাকতে পারেননি। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁর অবস্থান দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য,
আমাকে যদি আপনারা জিজ্ঞাসা করেন যে, তুমি দ্বৈতবাদী কি অদ্বৈতবাদী, তবে তার উত্তরে আমি এই বলিব যে প্রথমত জীবেশ্বরের মধ্যে গোড়ার ঐক্য সর্ব্বাবস্থাতেই অটল রহিয়াছি, এবং অটল থাকিবে-এ বিষয়ে আমি অদ্বৈতবাদী। দ্বিতীয়ত জীবেশ্বরের মধ্যে শেষের ঐক্য কস্মিনকালেও ছিল না- এখনও নাই- এবং ভবিষ্যতেও সংঘটনীয় নহে; কেননা কোনো জীবই সর্ব্বজ্ঞ এবং সর্ব্বশক্তিমান ছিল না, হয় নাই, হইবে না। এই বিষয়ে আমি দ্বৈতবাদী। তৃতীয়ত প্রত্যেক জ্ঞানবান জীবের অন্তঃকরণে ব্রহ্মজ্ঞান এবং ব্রহ্মানন্দের বীজ যাহা নিহিত আছে, তাহাই জীবেশ্বরের গোড়ার ঐক্যস্থান; ঈশ্বরোপাসনা রূপ ক্ষেত্র কর্ষণে এবং ঈশ্বরের প্রসাদরূপ বারিবর্ষণে সই বীজ উত্তরোত্তর ক্রমে বিকাশ পাইতে থাকে; যতই বিকাশ পায়, সাধক ততই ঈশ্বরের ঐশ্বর্য্য এবং সৌন্দর্য-জ্ঞানে উপলব্ধি করে; প্রেমে উপভোগ করে এবং যত্নে আত্মসাৎ করিয়া ধর্ম্মভূষণে ভূষিত হয়। এই রূপ গোড়ায় ঐক্য হইতে যাত্রারম্ভ করিয়া সাধক ঈশ্বরের সহিত গাঢ় হইতে গাঢ়তর ঐক্যবন্ধনের দিকে অগ্রসর হয়। উচ্চ হইতে উচ্চতর লোকে উপনীত হয়, গভীর থেকে গভীরতর অন্তরে নিমগ্ন হয়। এই বিষয়ে আমি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।১৭
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর দর্শনের মৌলিক বিষয় জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্রাহ্মসমাজের নেতা নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে (১৮৪৩-১৯১৩) ভাববাদী দার্শনিক হিসাবে অভিহিত করা হয়। জ্ঞান ও বিশ্বাস, সংশয় ও বিশ্বাস, অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ, মানব আত্মার সঙ্গে সত্যের সম্বন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা রয়েছে। ধর্মজিজ্ঞাসা তাঁর উল্লেখযোগ্য দর্শনের গ্রন্থ। জ্ঞানের সঙ্গে ধর্মকে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, জ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের যোগ না থাকলে ধর্ম অনিষ্ঠকর ও কুসংস্কারে পরিণত হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৬-৮৬) ভারতবর্ষের অন্যতম ভাববাদী দার্শনিক। তিনি দ্বৈতবাদ, বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। তিনি বলেছেন, এক ঈশ্বর, তাঁহার অনন্ত শক্তি, প্রত্যেক শক্তির স্বতন্ত্র ভাব এবং স্বতন্ত্র রূপ। অনন্ত শক্তির উৎস ঈশ্বরকে যে কোনো উপায়ে উপাসনা করা যায়। সেই প্রকার এক ঈশ্বরকে, যে যে ভাবেই উপাসনা করুক, তাহাতে কোনো দোষ নাই।১৮ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) হিউমের সংশয়বাদ এবং স্পেন্সারের অজ্ঞেয়বাদ দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে শঙ্করাচার্যের মায়াবাদকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলেছেন। বিবেকানন্দ কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁর দর্শনচিন্তায় শঙ্করাচার্য এবং বুদ্ধের চিন্তার মিশ্রণ দেখা যায়। শঙ্করাচার্যের বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদকে তিনি দর্শনচিন্তার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিবেকানন্দের দর্শনের ব্যবহারিক দিকটায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব রয়েছে। তিনি বলতেন, ‘শংকরাচার্য বেদান্তকে নিয়ে গিয়েছিলেন অরণ্যের বিদ্যাচর্চায়। আমি সেই বনের বেদান্তকে এনেছি জীবনের সর্বক্ষেত্রে কার্যে পরিণত করার জন্য।’১৯ রামকৃষ্ণের মত তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। তিনি মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। যদিও দু’জনের পথ ভিন্ন। কিন্তু লক্ষ্য অভিন্ন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির দর্শনচর্চায় পাশ্চাত্যের আধুনিক দর্শন ও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বেদ-বেদান্ত উপনিষদের প্রভাব দেখা যায়। বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির দর্শনচিন্তায় রয়েছে। পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন বাঙালিরা কতক নিয়েছে আবার কতক বাদ দিয়েছে। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের দর্শনে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের প্রভাবই বেশি। বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ন, মহাভারত, ত্রিপিটক উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি দার্শনিকদের মনন জগতে অধিকক্রিয়াশীল। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানেরা ইউরোপের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাঁদের চেতনা জগতে ছিল কোরান হাদিস। তাঁরা কোরান হাসিদকে অবলম্বন করেই এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। হিন্দু এবং ব্রাহ্ম নেতারা বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ ত্যাগ করতে পারেনি তেমনি মুসলমানেরাও কোরান, হাদিস ত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা চেতনা করতে পারেননি। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো ছিল কিন্তু সে ব্যাতিক্রম কখনো সামনের কাতারে দাঁড়ায়নি।
উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্ধ-সংঘাত ও সমন্বয়ে দুই ধারায় দর্শনচর্চা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দর্শনচিন্তায় আধুনিক উইরোপীয় দর্শনের প্রভাব থাকলেও বেদ বেদান্ত উপনিষদের প্রভাব বেশি। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম দার্শনিকদের দর্শনচিন্তায় ইউরোপীয় দর্শনের প্রভাব থাকলেও কোরান এবং হাদিসই তাঁদের দর্শনের মূল উৎস ছিল। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই জগৎ এবং জীবন জিজ্ঞাসায় কোরান এবং হাসিদকে মূলনীতি হিসেবে নিয়েছেন। তারা কোরান এবং হাদিসের ওপপ নির্ভর করে জগৎ ও জীবনের রহস্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।
তথ্যনির্দেশ
১. অন্নদাশঙ্কর রায়, “বাংলার রেনেসাঁস : পুনর্ভাবনা”, বাংলার রেনেসাঁস, শিবনারায়ণ রায় (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১
২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০
৩. রাজা রামমোহন রায়, তুহ্ফাতু-উল্-মুআহ্হিদীন, (একেশ্বর বিশ্বাসীদিগকে উপহার), মুহম্মদ আবূ তালিব (সম্পা.), (মালদদা : আদর্শ পুস্তকালয়, ১৯৯৫), পৃ. ২৩
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭
৫. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, প্রথম খণ্ড, (কলকাতা : জি, এ, ই, পাবলিশার্স, তৃতীয় সংস্করণ ১৯৯১), পৃ. ৬৯
৬. V. Brodov, Indian Philosophy in Modern Times,( Moscow : Progress publishers, 1984, Second printing 1988, p. 145
৭. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মতত্ত্ব বিদ্যা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উদ্ধৃতিটি সুশীলকুমার গুপ্তের ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। সুশীলকুমার গুপ্ত, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালর নবজাগরণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫
৮. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান (প্রথম প্রকরণ ও দ্বিতীয় প্রকরণ) ও মাসিক ব্রাহ্ম সমাজের উপদেশ একত্রে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রকাশিত, কলকাতা, ১৯৪৫. পৃ. ১৭, সুশীলকুমার গুপ্ত, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালীর নবজাগরণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬
৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭
১০. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪
১১. V. S. Naravane, Modern Indian Thought, A Philosophical Survey, Asia publishing house, Calcutata, Bomnay, New York…Reprinted 1967, p.37
১২. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী (সম্পা.), (কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, প্রথম প্রকাশ ১৮৯৮, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৬২), প্রাগুক্ত, পৃ. ২২
১৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫
১৪. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, প্রথম খÐ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬
১৭. দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অদ্বৈতমতের প্রথম ও দ্বিতীয় সমালোচনা, আদি ব্রহ্মসমাজ, কলকাতা, ১৮৯৭, পৃ. ৪১- ৪২, এম. মতিউর রহমান, বাঙালির দর্শন : ব্রাহ্ম ভাবধারা, প্রথম খণ্ড, (ঢাকা : বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১২), পৃ. ১০৮
১৮. সেবক রামচন্দ্র, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনবৃত্তান্ত, সেবকমণ্ডলী কর্ত্তৃক প্রকাশিত, (কলকাতা : তৃতীয় সংস্করণ, ১৩১৪), পৃ. ৮২
১৯. বিবেকানন্দের এই উদ্বৃতিটি নেয়া হয়েছে, স্বামী জিতাত্মনন্দের, “আত্মার স্বরূপ পূর্ণমানুষ বিবেকানন্দ’’ প্রবন্ধ থেকে। শাশ্বত বিবেকানন্দ, নিমাইসাধন বসু (সম্পা.), (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৯৯২), পৃ. ৩১