
উড্ডয়নসূত্র ॥ পর্ব- ২
এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও চোখ-কান খোলা রাখার দায়িত্ব ছিল শহীদ ভাইদের ওপর। এলাকার বড় ভাই সম্পর্কের শহীদ ভাই তার দলবল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় টহল দিতেন। আমাদের সাথে দেখা হলে বলতেন, ‘পড়ালেখার খবর কী? অ্যাঁ, পড়ালেখার কী খবর?’
যে মানুষটা বি.এ ক্লাসে আটকে গেছে, তিন-তিনবার পরীক্ষা দিয়েও কোন কূল-কিনার করতে পারেনি, তার কাছে পড়ালেখার খবর দিতে আমাদের মন সায় দিতো না। কিন্তু উপায় ছিলো না কোনো। মাথা ঝুঁকিয়ে, যথেষ্ট আদব-কায়দা দেখিয়ে বলতে হতো, ‘চলতাছে ভাই। ভালই চলতাছে।’
আঙুলের ফাঁকে কায়দা করে ধরে রাখা ট্রিপল ফাইভের সিগারেটটায় বিশাল একটা টান দিতে দিতে শহীদ ভাই গম্ভীর স্বরে উপদেশ দিতেন তখন, ‘যা করনের কর, কিন্তুক পড়ালেখাটা যেন ঠিক থাকে। খালি আড্ডাবাজি করলে তো চলবো না। কী চলবো?’
আমরা ‘চলবে যে না – সেরকম’ মাথা নাড়তাম। নাক টেনে তার সিগারেটে পোরা গাঁজার গন্ধটা বুকে ঢুকিয়ে নিয়ে মনে মনে ভাবতাম, খাড়ান ভাই, আমগো দিনও আসতেছে।
সেই দিন যে এত তাড়াতাড়ি আসবে – তা অবশ্য কেউই আশা করিনি। হিসেবে শহীদ ভাইরা আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। তারা কিছুদিন এলাকায় কলার উঁচিয়ে হাঁটবে, তারপর যথানিয়মে সময় এলে বিয়ে-শাদি করে গৃহপালিত বনে যাবে – তখন এলাকায় নেতৃত্ব দিবো আমরা – এটাই ছিলো সহজ হিসেব। এ নিয়ম শুধু আমাদের পূর্ব নাখালপাড়া না, দেশের যে কোন পাড়া, কিংবা এলাকার জন্যই প্রযোজ্য। সে মোতাবেক অপেক্ষা করে থাকতে আমাদের মোটেও আপত্তি ছিল না। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছি, গা ঝাড়া দিয়ে উঠার জন্য দু’এক বছর অপেক্ষা করে থাকা যেতো যথানিয়মেই।
অথচ শহীদ ভাই একদিন আচমকা ‘গুম’ হয়ে গেলেন এলাকা থেকে। না কোন খোঁজ, না কোন লাশ – স্রেফ ‘নাই হয়ে যাওয়া’ যাকে বলে। তার মোবাইল ফোনে কল করলে ‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করুন’-টাও শোনা যেতো না। সদ্য বাই-ইলেকশানে পাশ করা ফালু সাহেবের সাথে শহীদ ভাইয়ের বেশ দহরম-মহরম ছিল। বাজাজের বুম বুম শব্দ করা যে মোটরসাইকেলটি চড়ে তিনি প্রায়ই এলাকায় শোরগোল ফেলে দিতেন, এবং তার সিটে বসে নিজাম বেকারিতে বাখরখানির অর্ডার দিতেন বাকের ভাইয়ের স্টাইলে, সেটা এমপি ফালুর দেয়া বিশেষ গিফট – এ কথা বেশ প্রচলিত ছিল এলাকায়। এমনকি বিকল্পধারায় যোগ দেয়ার আগে আমাদের আসনের প্রাক্তন এমপি আব্দুল মান্নানের সাথে হাসিমুখে ফুল আদান-প্রদানের বাঁধানো ছবিও ছিল শহীদ ভাইয়ের। তা সত্ত্বেও তার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। রাজনৈতিক কোন্দলে হত্যা থেকে লুকিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া, এমনকি দুষ্টুপরীরা পরীস্থানে নিয়ে গেছে পর্যন্ত (শহীদ ভাইয়ের স্লিপিং ওয়াকের অভ্যাস ছিল, একবার ঘুমের মধ্যেই মাঝরাতে গেটের তালা খুলে টঙ্গী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে চলে গিয়েছিলেন) – নানান কিসিমের তত্ত্ব চালু ছিল তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। শহীদ ভাইয়ের বাবা বিষয়টা নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ করলেন। থানায় মিসিং পারসনের কেইসে কাজ না হওয়ায় খুনের মামলার লাইনেও চেষ্টা চালালেন। বেশ কিছুদিন দফায় দফায় পুলিশ আসতে লাগলো এলাকায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। যেদিন তিনি ‘গুম’ হয়ে যান, সেদিন রাতে বাসার দারোয়ান তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেছিল, কিন্তু বেরুতে দেখেনি – এ কথা সে হলফ করে পুলিশ এবং এলাকাবাসীকে জানাতে লাগল। এভাবে কেইসে বেশ রহস্য-রহস্য গন্ধ ঢুকে পড়লো বটে, তবে মাঝে থেকে বেচারা নিজে ধরা খেয়ে গেল। শহীদ ভাইয়ের বাবার ভাষ্য মতে, হারামজাদা, গাঞ্জা খাইয়া গেটে দারোয়ানি করে, আমার জলজ্যান্ত পোলারে বাসা থেইক্যা উঠাইয়া নিয়া গেল, আর হারামজাদায় টুঁ শব্দ পাইলো না – এইটা সম্ভব? ‘টুঁ’ শব্দ যে তারা নিজেরাও পেলেন না, তার কারণ হতে পারে, শহীদ ভাই নিচতলার একটা রুমে একা থাকতেন, বাড়ির অন্যান্যরা থাকতো দোতলায়। সুতরাং, কতকটা দারোয়ানের নিবুর্দ্ধিতায় এবং বেশিরভাগটা শহীদ ভাইয়ের বাবার প্ররোচনায় পুলিশ দারোয়ানকে থানায় নিয়ে মেরে আধমরা করে ফেললো। কয়েক দফা ডলা দেয়ার পরও নতুন কোন কথা বেরুলো না তার মুখ দিয়ে। অগত্যা নতুন কোন ক্লু’র অভাবে তাকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না পুলিশের হাতে।
দলনেতার অভাবেই হোক, কিংবা পুলিশের বেমক্কা জেরায় নাজেহাল হয়েই হোক, শহীদ ভাইয়ের সাথে ঘোরাঘুরি করা দলটা মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। শহীদ ভাইয়ের পরে, আকার-আকৃতি এবং ‘লাফাংগাগিরি’ হিসেব করলে যার দলনেতা হবার কথা ছিল, তিনি হলেন সাদেক ভাই। পিঠ অব্দি লম্বা চুল, দুই কানে দুটো গোলাকৃতি কানের দুল ছাড়াও তার শরীরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ঘাড়হীনতা। মাথা এবং ধড়ের জোড়া লাগানোর জন্য আল্লাহতালা বিন্দুমাত্র গলা বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করেননি তার ক্ষেত্রে। অবশ্য ঘাড় কিংবা গর্দান না থাকায় তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না। না-থাকা ঘাড়টাই যে বিজাতীয় রকম ত্যাড়া ছিল তার, সেটা তিনি যত্রতত্র প্রকাশ করতেন। এলাকায় তার প্রচলিত নামই ছিল, ত্যাড়া সাদেক। অবশ্য সেটা মুখ ফুটে ডাকার কোন উপায় ছিল না তখন। শহীদ ভাই দলনেতা হওয়া সত্ত্বেও বেশ ভদ্র-টাইপের ছিলেন। তার হয়ে হুমকি-ধামকি-চড়-চাপ্পড় যাকে যা দেবার, সেটা দিতেন সাদেক ভাই। শহীদ ভাইয়ের মৃত্যূর পর তাকেই সবচেয়ে বিচলিত দেখা গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই আধাহাত লম্বা দাড়ি গজিয়ে ফেললেন। লম্বা চুল ছোট হয়ে পাঁচ-কল্লি টুপিতে আঁটে, সেই সাইজ হয়ে গেল। সোনার দুল খুলে রাখলেন। যে ফাটা জিন্সের ভেতর দিয়ে তার মাংসল উরুর পশম দেখা যেতো, সেটা পরা বিলকুল বন্ধ করে দিলেন। তারচেয়ে বড় কথা, তাবলীগ জামাতে নাম লেখালেন। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে যান, তাবলিগি দলের সাথে এবাড়ি-ওবাড়ির কড়া নেড়ে ‘গাস্ত’ করেন। তার জ্বালায় প্রতি বৃহস্পতিবারের বিকেল বেলাটা বেশ লুকিয়ে-চুরিয়ে কাটাতে হতো আমাদের। দেখা হলেই কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রাত কাটানোর দাওয়াত দিতেন। তার হাতে থাকতো মক্কা শরীফ আঁকা একটি জায়নামাজ, জায়নামাজ নিয়ে কাকরাইলের উদ্দেশে চলেছেন। এবং প্রায়ই দেখা যেতো, চিল্লায় চলে গেছেন এক-দেড় মাসের জন্য। এরপর আর যারা ছিলেন দলে, তাদের মধ্যে কেউ দালালের সাহায্যে চোরাপথে ইউরোপ চলে গেলেন, কেউ চাকরি-বাকরিতে ঢুকে পড়লেন। আর যারা এ দুটোর কোনটাই করতে পারেননি, তারা বিলকুল ভেজা বেড়ালের মতো চলাফেরা করতে লাগলেন এলাকায়। মোড়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আগে ফ্যা ফ্যা করে হাসতে হাসতে যে মানুষটা চা খেতো, সে এখন ভেতরে ঢুকে টুলের এক কোণায় বসে চুপচাপ চা খেয়ে চলে যায়।
এই সুযোগে, ‘ব্যাচ’ হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের আমরা – দ্রুত শহীদ ভাইদের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাই। সিগারেটের ভেতর গাঁজা ঢুকিয়ে কায়দা মতো টান দেয়াসহ আরো নানাবিধ কায়দা-কানুনের প্রাথমিক পর্ব চলছিল তখন আমাদের।
সে সময়কার – আমাদের পাখা গজানোর কালে – একদিন বিকেলের কথাটিই পাড়ছিলাম তখন।
১৭-নম্বরের ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতায় সুরমন নাক সিঁটকায়। সাইকেল রেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করে সে। সিগারেটের দিকে ইঙ্গিত করে, মোহন চোখের ইশারায় জানতে চায় তার কাছে, ভেতরে জিনিস আছে?
সুরমন সে কথাটার উত্তর দেয় না। ফস্ করে লাইটার বের করে একটা শলা ধরিয়ে আবার বলে, ‘তোদের এলাকার মাইয়া – তোগো কোন খবর নাই। খালি কী খাস আর ঘুমাস?’
গায়ে জ্বালা ধরানো কথা। তবে অভিযোগটা সত্য। সত্যিই যদি একটা ‘লালু’ টাইপ মেয়ে আমাদের পাড়াতে নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে আসে, তবে সে আমাদের নজরে পড়ার আগে, অন্য পাড়ার ছেলে সুরমনের চোখে পড়লে, বিষয়টা আমাদের জন্য কিঞ্চিত অপমানকর তো বটেই।
জয় কায়দা করে বলল, ‘এ পাড়ার মাইয়াদের দিকে নজর দিস না কইলাম। খামচাইয়া চোখ আন্ধা কইরা দিবো।’
জয়ের বাম হাতের কড়ে আঙুলের নখটি ইঞ্চি দুয়েক লম্বা। আর সব নখ পরিষ্কার করে কাটা হলেও এ নখটি ও যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সেই নখটিই ও সুরমনের চোখের সামনে নাচাল। ওর বলার ভঙ্গিতে আমরা হেসে উঠলাম। এবং হাসতে হাসতেই মনে মনে ঠিক করলাম, ১৭-এর দিকে নজর রাখতে হবে।
এসব ক্ষেত্রে যা হয়, কোন বাড়ির দিকে নজর রাখতে হলে – আমরা সাধারণত সকাল-সন্ধ্যা উদ্দিষ্ট বাড়িটির সামনে গিয়ে আড্ডা দিই। কিংবা, তারো চেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সে গলিতে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। কিন্তু ১৭ নম্বরের সামনে আড্ডা, অথবা ক্রিকেট খেলা – কোনটাই সম্ভব নয়। মাত্র হাতখানেক সরু গলি দিয়ে ঐ বাড়িতে ঢুকতে হয়। এবং রাস্তা থেকে সহজে ও বাড়ির কোন বারান্দাই চোখে পড়ে না। না নিচের তলার, না দ্বিতীয় তলার। তবু সুরমনের চোখে যে দ্বিতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়ানো মেয়েটি চোখে পড়ে, তার কারণ – মেয়েটিকে সে মফিজ ভিলার দোতলা থেকে দেখে এসেছিল।
মফিজ খন্দকার সম্পর্কে সুরমনের খালু ছিলেন। অর্থাৎ, মফিজ ভিলা ওর খালাবাড়ি। আমাদের সাথে দেখা করতে আসার আগে সে তার খালার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সুরমনের খালা দোতলায় থাকেন। মহিলা স্বভাবে গর্তজীবি। উনার নাকি দিনের আলো সহ্য হয় না, চামড়ায় এলার্জি-ফ্যালার্জি হয়, লাল গোটা-টোটা ওঠে সরীসৃপের মতো হয়ে যান। সেজন্য উনার ঘরের জানালায় অতিরিক্ত রকম মোটা পর্দা টানানো থাকে সব সময়। প্রবল গ্রীষ্মের দিনেও পর্দাগুলো সরানো হয় না। ঘরে এসি লাগানো আছে। পর্দা সরানোর দরকারও হয় না। সুরমন যখন ও বাড়িতে যায়, সে-সময়টায় এলাকায় কারেন্ট ছিলো না। তার খালার বাসায় জেনারেটর চলছিল। জেনারেটরের উৎপাদিত বিদ্যুতে বন্ বন্ করে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছিল সুরমনের খালার রুমে। ফ্যানের রেগুলেটর পুরো পাঁচের ঘরে চলছিল বটে, কিন্তু তাতেও যে হাওয়া তৈরি হচ্ছিল, তা ঘরের জানালায় টানানো পর্দাকে সামান্য কাঁপিয়ে তোলা ভিন্ন কিচ্ছু করতে পারেনি। সারা পথ সাইকেল চালিয়ে যাওয়াতে সুরমনের অতিরিক্ত গরম লাগছিল। সে কথা তার খালাকে জানানোতে, তিনি কাজের মেয়েটাকে বলে একটা টেবিল ফ্যান আনান অন্য ঘর হতে। সেটা সুরমনের দিকে তাক করে চালিয়ে দেন। খানিকক্ষণের মধ্যেই সুরমনের গা জুড়িয়ে যায়। সে তখন ফ্যানটাকে বন্ধ না করে, সেটাকে ঘুরিয়ে দেয় উল্টো দিকে। মনে আশা, ফ্যানের বাতাস সামনের দেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে আসবে। এবং সারা ঘরে শীতলতার আভাস ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। সেদিকটাতে ছিল জানালা। টেবিল ফ্যানের বাতাস সরাসরি জানালার পর্দায় গিয়ে আঘাত করে। তাতেই এতক্ষণের অনড় পর্দাটি কেঁপে কেঁপে ওঠে। এবং এই কম্পনরত পর্দার ফাঁক-ফোকর দিয়েই সুরমনের অনুসন্ধানি চোখ দেখতে পায় – পেছনের বাড়ির বারান্দাটি দেখা যাচ্ছে। আর তাতে একটা মেয়ে রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।
দীর্ঘকাল ধরে ১৭-এর দোতলাটি খালি পড়ে ছিল। ও বাড়ির গায়ে এবং গলির মোড়ে একটা ‘টু-লেট’ বোর্ড ঝুলেছিল বহুদিন ধরে। সুতরাং, হঠাৎ করে ওখানে নতুন ভাড়াটিয়া- তাও আবার একটা মেয়েকে দেখে, সুরমন প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে ওঠে। সে খালার সাথে কথা বলতে বলতেই সামনে-পেছনে ঝুঁকে দৃশ্যটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু, তেমন সফল হয় না। পর্দাটি কাঁপছিল অনিয়মিতভাবে। আর তাতে খুব সামান্য ফাঁকা তৈরি হচ্ছিল। পর্দার কম্পন আরেকটু বাড়ালেই তার দেখা-দেখির কাজটা সম্পন্ন হয়ে যায়। খালা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে একটা উলের কাঁটা বুনতে বুনতে তার সাথে কথা বলছিলেন। কথা বলতে বলতে যেই তিনি উলের ঘর গুনতে থাকেন মনোযোগ দিয়ে, মূলত সেই সময়টাই হচ্ছে বাইরে দেখার সুযোগ। ফলে বেশ একটা চোর-পুলিশ খেলায় মেতে উঠেছিল সে। কিন্তু পর্দার আলসেমিতে কাজটা আরো কঠিন হয়ে পড়ছিল তার জন্য। এমন সময় সুরমনের খেয়ালে আসে, টেবিল ফ্যানটা দুইয়ে চালানো। তড়াক করে সে ফ্যানটা তিনে চালিয়ে দেয়। মুখে কৈফিয়তের মতো দেয়, ‘এত যে গরম পড়ছে!’ দুইয়ে ঘোরাতে পর্দাটি যতটুকু সরে যাচ্ছিল, তিনে নিশ্চয় তার দিকে অনেক বেশি সরতে বাধ্য হবে – এই হচ্ছে তার খায়েশ। এবং সত্যি বলতে, তা হচ্ছিলও। কিন্তু মাত্র একবার। তাতেই মেয়েটিকে আরেকটু ভালো করে দেখার সুযোগ পায় সুরমন। বুঝতে পারে, ‘পুরাই লালু’ একটা মেয়ে। দ্বিতীয়বার দেখার আশায় সে খালার সাথে কথা চালাতে চালাতে দৃষ্টি তীক্ষ্ম করে রাখে – কখন ফ্যানটি ঘুরতে ঘুরতে পর্দার ঐ জায়গাটিকে উড়িয়ে দিবে। অথচ ঠিক সে সময়ই কারেন্ট চলে আসে। খালা তাকে সিলিং ও টেবিল – দুটো ফ্যানই বন্ধ করে দিতে বলে রিমোট কন্ট্রোল টিপে এসি চালিয়ে দেন। পর্দার ওড়াউড়ির আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ বাদেই আমাদের আড্ডায় এসে সুরমন বলে ওঠে, ‘দোস্ত, মেয়েটা কে রে?’
আমাদের মধ্যে আকতার ‘মাসল ম্যান’। শীত-গ্রীষ্ম বলে কোন ব্যাপার নেই ওর কাছে, সবসময়ই হাতাকাটা একধরনের গেঞ্জি পরে ঘুরে বেড়ায় ও। এবং তক্কে তক্কে থাকে কখন সেটাও খুলে ফেলা যায়। কোন-কোন দিন একটু বেশি গরম পড়লে, কিংবা বৃষ্টির মধ্যে আড্ডার সময়টায় সে অবধারিতভাবে গায়ের গেঞ্জিটা খুলে ফেলে, এবং ফুলে ওঠা বাইসেপস এবং ট্রাইসেপসে একধরনের ঢেউ খেলাতে থাকে, যাতে না চাইলেও চোখ চলে যায় আমাদের। ওই থরে থরে সাজানো মাংসখণ্ড কেন আমাদের শরীরেও জেগে উঠছে না এবং নিঃশ্বাস বন্ধ করে, বুকের ছাতি ফুলিয়ে অনেক কায়দা-কানুন করা সত্ত্বেও কেন সেগুলোতে কোন ঢেউ ওঠে না – তার সম্ভাব্য কারণ জানা থাকা সত্ত্বেও আমরা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলি, এবং আকতারের আড়ালে নিজেরা বলাবলি করি, ‘শালা একটা আড়ম্বুষ।’
চলবে…