
উড্ডয়নসূত্র ॥ পর্ব- ১৯
অবশেষে ভয়, ততোধিক উত্তেজনা, এবং তারোধিক শংকা নিয়ে যে বস্তুটি পান করি আমরা সেদিন- জগাভাই জানালেন, সেটির নাম—কালি মার্কা। বাদামী-কালো কাঁচের তৈরি ছোট্ট একটি শিশি, গায়ে হিন্দুদের দেবী মা-কালীর ছবি। ছয়জনের জন্য দেড়শো মি.লি। সুরমন বোতলটি দেখেই জানালো, ওরে রে, এই বোতল তো আমাদের বাসায় আনতে দেখছি বহুবার, তয় বাপ শালায় কোনদিন ধরতে দেয় নাই, কয় কাশির সিরাপ।
আমাদের অবস্থা দেখে জগাভাই বুঝে গিয়েছিলেন—এর আগে কোনদিন আমরা মদ খাইনি। তিনি তখন আমাদেরকে ডেকে নিয়ে রেললাইনের এক পাশে বসলেন, তারপর এ জিনিস খাবার নানান কায়দা-কানুন শেখালেন। কীভাবে এবং কতটুকু করে খেলে সহজে মাতাল হয়ে পড়বো না—সেসবের একটা ‘ক্রাশ কোর্স’ করিয়ে দিলেন। অবরোধের আওতায় পড়ে বর্ডার ক্রস করিয়ে আনা তার মালামালগুলো যে যশোর না কুষ্টিয়া সীমান্তে আটকে আছে—গাড়ি না চলায় আনতে পারছেন না —সে সম্পর্কেও জ্ঞান দিলেন। এসব জিনিস যে যেনতেন লোকের কাছ থেকে খাওয়া ঠিক না—সেটাও বোঝালেন। একজন চোরা-মদ বিক্রির দালালের সহৃদয়তায় আমরা তখন মুগ্ধ। নিজেদের অজান্তেই তাকে জগা ভাই ডাকতে শুরু করেছি। সেই থেকে ভদ্রলোকের সাথে আমাদের সহৃদয়তা। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে একটু-আধটু পান করতে ইচ্ছে হলে আমরা জগাভাইয়ের খোঁজ করি।
আজ কিন্তু আমরা জগাভাইয়ের থেকে জিনিস কিনতে আসিনি। কিন্তু ‘মহুয়া’ নামটি কেমন ভাল লেগে যায় আমাদের। আমাদের দোনামোনা ভাব দেখে জগাভাই মহুয়ার বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেন, এটাকে মদ বললে জিনিসটার অপমান হয়, ভাই। স্রেফ মধু, মহুয়া ফুলের মধু দিয়ে তৈরি এক নম্বরের জিনিস। খালি গন্ধটা শুঁকলেই বুঝবেন এর মাহাত্ম্য। আজ বিকালেই চালান আসছে। ইন্ডিয়ার ছত্রিশগড়ের মধু, সাঁওতালদের হাতে বানানো। এক বিন্দু বগিজগি নাই। এক চুমুক কইরা চাখবেন?
রোজার দিনে এসব খাওয়া কী ঠিক হবে!—সে দ্বিধার কথাটা মনে করিয়ে দিলে তিনি দাঁতে জিভ কাটতে কাটতে বেশ কয়েকবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে ফেললেন। জাতে হিন্দু হলেও মুসলমানদের সব ধরনের বুলি উনার মুখস্ত। কিন্তু আমাদের তখন মনে পড়ে যে ‘রোজার দিন’ চলছে বটে কিন্তু এখন তো রাত। রাতে এক চুমুক মধু খেলে কী খুব গুনাহ হবে!
অবশেষে আমরা ঠিক এক চুমুক করে চাখতে রাজি হই। আমাদের সম্মতিতে জগাভাই স্পষ্টতই খুশি হন। ‘একটা মিনিট দাঁড়ান’ বলে তিনি দ্রুত গতিতে একটা ঝুপড়িতে ঢোকেন, এবং অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুটো ছোট ছোট শিশি নিয়ে হাজির হন। শিশি দুটো আমাদের হাতে দিয়ে তিনি পরামর্শ দেন, কিচ্ছু মেশাতে হইবো না, ছোট ছোট ঢোক দিয়া খাইবেন, দেখেন কেমন মজা লাগে—!
‘আউট’ হয়ে যাবো নাতো?—আমরা জানতে চাই।
আরে না, দুয়েক চুমুক মহুয়া খাইয়া কেউ আউট হয় না। আপনাগো জোয়ান শরীরে তো টেরই পাইবেন না। তয় ফিলিংটা কেমন হয় দেইখেন—
এবারে আমরা জিনিসটার দাম জানতে চাই। কিন্তু জগাভাই পাত্তা দেন না। বলেন, নতুন একটা জিনিস দিছি, খাইয়া দেখেন, ভাল লাগলে পরে দাম দিয়েন, আমি তো এই ঠেকেই আছি সবসময়, আপনাগো লগে আমি কোনদিনে ব্যবসা করছি?
এ কাণ্ড ভদ্রলোক আগেও অনেকবার করেছে আমাদের সাথে। মদের কারবারী কারো কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার খুব বিরল ঘটনা তো অবশ্যই। আমরা আর কথা বাড়াই না। আমাদের সাথে যে উনি কোনোদিন ব্যবসা করেননি—সে কথায় সম্মতি জানিয়ে শিশি দুটো পকেটে ঢুকিয়ে সামনে এগুতে থাকি। কোথাও বসার পরিকল্পনা ছিলো না আমাদের। এখন পরিকল্পনায় বসার জায়গা ঢোকাতে হল। হাঁটতে হাঁটতে কারণবারি খাওয়া বারণ।
কোথায় বসা যেতে পারে?—আমরা ভাবতে শুরু করি। এবং আমাদের সম্মিলিত ভাবনায় পরস্পরের সাথে কোন পরামর্শ ছাড়াই যে জায়গাটির কথা মনে পড়ে আমাদের, সেদিকে হাঁটতে শুরু করি আমরা। এবারে আর উদ্দেশ্যহীন হাঁটা নয় বলে আমাদের পায়ে কেমন পাখা গজিয়ে যায়। আমাদের সাথে সাথে আকাশের চাঁদটাও দৌড়াতে শুরু করে। আমরা যে পথে এসেছি, সে পথে ফিরে চলেছি এখন।
অধ্যায়- সাত
কাদের মিয়া আমাদেরকে দেখে এতটাই অবাক হল যে বেশ কিছুক্ষণ ওর মুখে কথাই যোগালো না। আমরা হাসিমুখে বললাম, কী খবর কাদের মিয়া, আছ কেমন?
জ্বে, জ্বে, ভাল। ভাল। খবর ভাল।—ধাক্কা সামলে হড়বড় করে ওঠে সে।
তোমার ওস্তাদ কই?—আকতার জানতে চায়।
কেডা? কার কথা কন?
ওস্তাদরে চিন না? না কই আছে সেইটা বলতে চাও না?
আকতারের গলার থ্রেট ভাবটা লোকটিকে এবার আরো ভীত করে তুলে। তো তো করে বলে, সাদেক ভাইয়ের কথা কন? উনি তো তাবলীগে। কই গেছে আমারে বইলা যায় নাই। বিশ্বাস করেন—
আমরা আকতারকে থামাই। কাদের মিয়াকে বলি, ঐ ঘরটা কি তালা মারা?
জ্বে, তালা লাগায়া রাখছি।
ভাল করছো, এখন খোল। ঘরে বসে একটু রেস্ট নিবো। আর মজনু ভাইয়ের দোকানটা থেকে আমগো কথা কইয়া দুই লিটারের দুইটা কোক আনবা। পারবা না?
মজনু ভাইয়ের দোকান থেকে এর আগেও নানান জিনিস এনে দিয়েছে কাদের মিয়া। কথা না বাড়িয়ে সে রাজি হয়ে যায়। কোমরের ঘুপসি হতে একটা চাবি বের করে দেয় আমাদের। আমরা দোতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই।
দোতলায় উঠে মনির সাহেবকে দেখবে বলে আশা করি আমরা। প্রায় দিনই উনার সাথে বারান্দায় দেখা হয়ে যায়। ঘুমুতে যাওয়ার আগে আধা ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাতে মেসওয়াক ঘসেন। পেশায় সোনালি ব্যাংকের তেজগাঁও ব্রাঞ্চের ক্যাশিয়ার হলেও এই ভদ্রলোককে দেখলে মনে হবে কোন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। মাথায় টুপি, চোখে সুরমা, কানে আতরের তুলো, পায়ের টাকলু গিরার উপরে ঢোলা পাজামা। আমাদের সাথে দেখা হলেই কেমন যেন সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েন, খানিকটা ভীত মুখে ‘কী খবর—ভাল?’ বলতে বলতে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েন। আজ দেখলাম—বারান্দা খালি। উনার ঘরেও আলো নেই। শুধু উনার ঘরে কেন, এ মেসবাড়ির প্রায় সবগুলো ঘরই অন্ধকার। চারদিকটা বেশ শুনশান। লোকজন সব বোধহয় ঈদের ছুটিতে বাড়ি চলে গেছে।
সাদেক ভাইয়ের এই মেসে নানান ধরনের মানুষ আছে। গার্মেন্টসের শ্রমিক থেকে প্রাইভেট কলেজের শিক্ষক—সব ধরনের মানুষের একটা সহাবস্থান এখানে। যে কোন দিন সন্ধ্যার পরে সবগুলো ঘরের বারান্দা দিয়ে হেঁটে এলে নানান ঘর থেকে ক্যাসেট কিংবা সিডিতে যেসব গান শোনা যাবে—তা থেকেও এখানকার মানুষগুলোর সামাজিক অবস্থানের একটা মোটামুটি আঁচ করে ফেলা সম্ভব। কথাটা মোহনের, এবং কথাটি শুনে প্রতিক্রিয়ায় জয়ের উত্তর ছিল, এই ধরনের জেনারাইলেশান করা মধ্যযুগীয় মানসিকতার নমুনা—ব্যাপারটা বুঝিস? পল্লীগীতি শুনলেই গার্মেন্টস শ্রমিক, আর রবীন্দ্রসংগীত শুনলেই উচ্চকেতার ভদ্রলোক—এ জাতীয় ধ্যানধারণা থেকে বেরুতে পারছিস না এখনো—আশ্চর্য!
দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেটাই কি ঠিক নয়?—মোহন নিজের কথার পক্ষে যুক্তি দেখায়, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শিক্ষা পেটে না থাকলে রবীন্দ্রসংগীতের ভাষা বোঝাটা অত সহজ! ভাবের কথা না হয় বাদই দিলাম।
অর্থাৎ তোর ধারণায় শিক্ষিতের মাপকাঠি হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতের শব্দ এবং ভাব বুঝতে পারার সক্ষমতা?—জয়ের পাল্টা আক্রমণ, শিক্ষিতের এতো ন্যারো ধারণা নিয়ে লোকজনের দিকে তাকাস?
তাহলে তোর ধারণাটি শুনি, শিক্ষিতের কোন ব্রড ধারণা নিয়ে তুই লোকজনের দিকে তাকাস?—মোহন তীব্র গলায় প্রশ্ন করে।
এ তর্ক চলতে চলতে এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যে, দুজনে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। এর সবই এই ঘরটাতে বসে, মাত্র দিন কতক আগে। অথচ এখন এ ঘরটার তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে মনে হলো—এসব বুঝি বহুবছর আগের কথা!
ঘরের ভেতরটা যে এলোমেলো-লন্ডভন্ড অবস্থায় দেখে গিয়েছিলাম আমরা, তার চিহ্ন মাত্র নেই এখন। সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো। ট্রাংক দুটো তাদের নিজ নিজ জায়গায় সরে গেছে। ভাঙ্গা তালা সরিয়ে নতুন তালা লাগানো হয়েছে।
আমরা ঘরে ঢুকে হাত-পা ছড়িয়ে বসি। কেউ কেউ জুতাসহই বিছানায় শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাদের মিয়া একটা পলিথিনের ব্যাগে করে ঘরে ঢুকে। ব্যাগের মধ্যে দুই লিটার বোতলের লাল মাথা দেখা যাচ্ছে। ব্যাগটাকে টেবিলের উপর রেখে সে খানিকটা ভয়ে ভয়ে জানতে চায়, ভাইজানরা কি রাতে এখানে থাকবেন?
থাকতেও পারি। দেখা যাক। মুডের ওপর নির্ভর।—আমরা উদাস গলায় উত্তর দেই।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মিনমিনে স্বরে জানতে চায়, আর কিছু লাগবে আপনাদের?
হ, লাগবে। কয়েকটা গ্লাস বের করে ধুয়ে দিয়া যাও।
গ্লাস তো নাই। কাপ আছে, দিবো?
দাও। গ্লাস নাই তো কাপই সই।
ঘরের উত্তর কোণায় দুই দরজাওয়ালা একটা কাঠের আলমিরা আছে। কাদের মিয়া সেটি হতে পাঁচটা ছোট ছোট কাপ বের করে। তারপর কাপগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এ মেস-বাড়ির প্রতি তলায় একটা করে কমন বাথরুম, টয়লেট, আর রান্নাঘর। এ ঘরেই একমাত্র লাগোয়া বাথরুম, গোসলখানা। কাদের মিয়া খুব সম্ভবত রান্নাঘরের দিকে গেছে কাপগুলো ধুতে।
জয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে আমাদের, ইয়াবা কথাটার অর্থ জানিস?
আমরা ঘাড় নাড়ি। জানি না।
জয় হাসতে হাসতে জানায়, ইয়াবা থাই শব্দ। এর অর্থ পাগলা ঔষুধ। তোরা তো ইয়াবা ব্যবসায় ধরা পড়ে থানায় গেলি, আর আমি এই ফাঁকে জিনিসটা নিয়ে বেশ খোঁজখবর করে ফেললাম।
তা গবেষণায় কী জানতে পারলি?—আমরা জিজ্ঞেস করি। ইয়াবা যে একটা ড্রাগ— এর বেশি আমরা তখনো কিছুই জানি না।
জয় আধশোয়া হয়ে ছিল। এবারে উঠে বসে। বুঝতে পারি, ও জ্ঞান দেবার মওকা পেয়েছে। আমরা আপত্তি করি না। জিনিসটা সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। এমন একটা ড্রাগ, যেটা সাদেক ভাইয়ের মতো মানুষ—কে জানে কতদিন ধরে—করে আসছে, আর আমরা এর নামটা পর্যন্ত ঠিক মতো শুনিনি! অথচ সেই ড্রাগের সাথে নাম জড়িয়ে হাজত-বাস হয়ে গেলো আমাদের!
জয় জিজ্ঞেস করে, ইয়াবা কে প্রচলণ করে, জানিস?
কে? সাদেক ভাই?—না জানার অজ্ঞানতা আমরা সস্তা রসিকতায় ঢেকে দিতে চাই।
জয় বক্তৃতা দেবার গলায় শুরু করে, স্বয়ং হের হিটলার। নাৎসী সৈন্যরা যাতে দিনের পর দিন জেগে থাকতে পারে—এই চিন্তা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওদের নার্ভগুলো উত্তেজিত রাখার জন্য ইয়াবা বড়ির ব্যবহার শুরু করা হয় ঐ বদমাইশের আদেশে। পরবর্তীতে বাজারে ড্রাগ আকারে বিক্রি হতে শুরু করে। বিশেষত যৌন-উত্তেজক বড়ি হিসেবে এর হেভ্ভি প্রচলন শুরু হয়।
খাইছে!—আমরা নড়েচড়ে বসি।
জয় চালিয়ে যায়, অবশ্য সত্যি কথা হলো, ইয়াবা সাময়িক উত্তেজনা দেয় ঠিক আছে, তবে কিছুদিন সেবনের পর ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটতে শুরু করে, ব্যবহারকারির যৌন ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ধর তুই ইয়াবা খেলি, দেখা যাবে চার-পাঁচদিন তোর শরীরে প্রচণ্ড উদ্দীপনা দেখা যাবে, ক্লান্তি বলে কোন কিছু যে আছে—সেটা টেরই পাবি না।
আমরা বলে উঠি, উদ্দীপনা তো খারাপ কিছু না। টায়ার্ড-ফায়ার্ড লাগলে তো খাওয়া যেতে পারে—