
উড্ডয়নসূত্র ॥ পর্ব- ১৬
আমাদের বেশিরভাগই ছোটবেলায় ইমাম সাহেবের কাছে আরবী পড়া শিখেছি। প্রতি শুক্রবার সকালে দুই ঘন্টা করে তিনি আরবী পড়াতেন পাড়ার বাচ্চাদের। এখনও সেই প্রক্রিয়া বজায় আছে। পাড়ার ছোট বাচ্চারা উনাকে তাই ওস্তাদজি বলে ডাকে, আমরাও একসময় তাই ডাকতাম। সেই ওস্তাদজির কাণ্ড দেখে আমরা রীতিমত হতভম্ব হয়ে যাই। রাগ করার বদলে আমাদের কেউ একজন হঠাৎ হেসে ফেলে। সেই হাসি সংক্রমিত হয়ে পড়ে সবার মাঝে। ক্রিকেট খেলা বাদ দিয়ে আমরা হা হা হো হো করে মসজিদ গলিতে শোরগোল তুলে ফেলি। কোন একসময় খেয়াল করি, ইমাম সাহেবের ঘরের জানালার পর্দা সামান্য সরানো। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখছিলেন।
খুব সম্ভবত আমাদের হাসিতে ভদ্রলোক অপমানিত, এবং যুগপৎ ভীতি বোধ করতে শুরু করেন। তার ভীত হবার আরেকটা কারণ আছে। উপরের ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমরা যখন কাজিম মিয়ার পতিত জমিনের কোণে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ ইমাম সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হয়ে যায়। উনি নিজাম বেকারি থেকে বাখরখানি নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। চারদিক বেশ থিকথিকে অন্ধকার, আমাদের এলাকার নিয়মমাফিক সন্ধ্যাবেলাকার লোডশেডিং চলছিল। উনাকে দেখামাত্র ফয়সাল লম্বা সালাম দেয়। উনি বোধহয় আমাদের একেবারেই খেয়াল করেননি। তাই অন্ধকার কোণা হতে এমন আচমকা সালাম শুনে ভীষণ চমকে উঠেন। এতটাই চমকে যান যে, সালামের জবাব পর্যন্ত নিতে পারছিলেন না। মুখে বেশ তো তো শব্দ তৈরি হয়। সে ফাঁকেই ফয়সাল চিকন গলায় বলে উঠে, বল কাটার কাজটা কী ভাল হইল হুজুর? পোলাপাইনে যদি দাবী রাইখা দে, তবে তো সেই হাশরের ময়দানে—
ততক্ষণে ইমাম সাহেব কিছুটা সামলে উঠেছেন। নিজের ভীতি ভাবটা ঢাকার জন্য বেশ জোর গলায় বলে উঠেন, কী বলতে চাও? হ্যাঁ, কী বলতে চাও—
ফয়সাল হয়তো ফাজলামোটা চালিয়ে যেতো। আমরা হাত চেপে ওকে থামাই। আমাদের কেউ একজন ওকে কপট ধমক দিয়ে ওঠে, এ্যই, কী ফাজলামো করিস। হুজুর, আপনি বাসায় যান, বাসায় গিয়া বাখরখানি খান। ওগো বল কাটছেন—খুব ভাল করছেন। পাড়ার মধ্যে এইসব হারাম খেলা—
ফয়সালের কথা থেকেই আমাদের মধ্যে হাসির গুড়গুড়ি উঠছিল। সেটাকে বহুকষ্টে চেপে রেখেছিলাম। কিন্তু ‘হারাম খেলা’—কথাটা শুনে আমাদের পক্ষে আর হাসি চেপে রাখা সম্ভব হয় না। আবারো সেই হো হো করি উঠি সবাই। ইমাম সাহেব আর কথা বাড়ান না। আপন মনে গজ গজ করতে করতে দ্রুত পা চালিয়ে বাসার পথ ধরেন।
আমাদের সাথে ইমাম সাহেবের রেষারেষির শুরু সেই থেকে। উনি কোন উপলক্ষ্য পেলেই, বিশেষত শুক্রবার জুমুআর খোতবায় প্রায়ই উঠতি বয়সী যুবকদের নিয়ে তার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে থাকেন, আরবি, উর্দূ এবং বাংলা—এই তিন ভাষার মিশেলে এমন সব বয়ান ঝাড়তেন, শুনলে যে কারো মনে হতে বাধ্য— উঠতি বয়সী যুবক একেকটা সাক্ষাৎ শয়তানের ছেলা, শয়তানের বদ মতলব প্রচারের জন্য এদের আবির্ভাব জগতের বুকে। এমনকি আমরা যে কাজিম মিয়ার জমিনে আড্ডা দেই, সেটা বন্ধ করার জন্য কাজিম মিয়ার ছেলেদের কাছে উনি ধর্না দিয়েছিলেন পর্যন্ত।
এতদিন বাদে বেচারা আমাদেরকে নাজেহাল করার মতো একটা মোক্ষম কিছু পেয়েছে। ইমাম সাহেবকে থ্রেট দিয়ে আসার মতলব বাদ দিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে রেলগেইটের দিকে এগুই। নাখালপাড়ার রাস্তায় প্রদীপ জ্বালিয়ে একটা লোক ডিমসেদ্ধ বিক্রি করছে। সেদ্ধ ডিমের একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। মোহন প্রস্তাব করে, চল, ডিম খাওয়া যাক।
ডিমওয়ালা লোকটা আমাদের পূর্বপরিচিত। নোয়াখালি বা ফেনী অঞ্চলের দিকে বাড়ি। কাস্টমারদেরকে ‘কাগু’ সম্বোধন করে ডাকে। এবং অনর্গল আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যায়। তার মুখের আঞ্চলিক ভাষা শুনতেও কিছু মানুষ ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ডিম খায়, আর শুধু শুধু হাসে। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে লোকটা ডাক দেয়—
—ঐ তো কাগুরা চলি আইছে। আইয়েন আইয়েন।
আকতারের দাদার বাড়ি লক্ষীপুর। সেই সুবাধে ঐ অঞ্চলের ভাষা কিছুটা জানা আছে ওর। ডিমওয়ালার ডাকের উত্তরে জবাব দেয়—
—আণ্ডা আছে নি?
—আছে নি মানে? মোরগ লগে লইয়া ঘুরি। আন্ডা শেষ অওনের সুযোগই নাই। শেষ হওনের আগেই কোঁৎ করি পাড়াই হালামু—
—উঁ হুঁ, মোরগের আণ্ডায় হইতো ন, ঘোড়ার আণ্ডা লাগবো। ঘোড়ার আণ্ডা আছে নি আপনের কাছে?
—কী কন? গরু ঘোড়া ভেড়া—বেক জাতের আণ্ডা আছে আঁর কাছে। খালি কোনটা লাগবো—কন।
কথার পৃষ্টে লোকটার এমন অবান্তর কথা চালিয়ে যাবার ক্ষমতায় মুগ্ধ হতে হয় আমাদের। আমরা হা হা করে হাসি। হাসতে হাসতে টের পাই, মনের কোণে জমে থাকা মেঘ খানিকটা হলেও হালকা হতে শুরু করেছে। বেশ বড় সাইজের খোসা ছাড়ানো চারটা সেদ্ধ ডিম আমাদের চারজনের হাতে তুলে দেয় লোকটা। লবণ ও মরিচের গুঁড়া মাখানো ডিমটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি আমরা।
দূর থেকে জয়কে আসতে দেখা যায় এবার। রিকশায় বাবু হয়ে বসে আছে। বসে বসে কিছু একটা দেখছে ফোনের স্ক্রিণে। নিজের ভাবনায় ও এতটাই মশগুল ছিল যে আমাদেরকে খেয়ালই করেনি একদম। কাছে আসতেই আমরা চারজন আচমকা লাফ দিয়ে ওর রিকশার গতি রোধ করে দাঁড়াই। রিকশাওয়ালা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুহূর্তে রিকশা দাঁড় করিয়ে ফেলে। আচমকা ব্রেক কষায় জয় বেচারা সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয় কোনোমতে। তারপর আমাদেরকে দেখে লাফিয়ে নামে রিকশা থেকে।
প্রায় চিৎকার করে হাঁক দেয় ও, এই শালা ড্রাগ ব্যবসায়ীর দল—এত রাতে যাস কই?
ড্রাগ বেচতে যাই। যাবি?—আমি জিজ্ঞেস করি।
যাবো না মানে! তোগোরে আর একা ছাড়ন যায়! এই মামু, আর ভিতরে যাবো না। কত দিমু কও?
রিকশাওয়ালার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে ও। রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে উত্তর দেয়, আপনার যা খুশি দেন।
জয় মানিব্যাগ খুলে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেয়। তারপর আমাদের প্রত্যেকের সাথে একদফা হাত আর বুক মেলানো হয়ে গেলে ও জানতে চায়, ডিম খাবি?
এই মাত্র খেয়ে শেষ করা ডিমটার আমেজ আমাদের মুখের মধ্যে মিলিয়ে যায়নি এখনো। কিন্তু আরো একটা ডিম খেতে আমাদের বিন্দুমাত্র অনিহা হয় না। সে কথা জানাই ওকে। জয় ডিমওয়ালার দিকে তাকিয়ে ফরমায়েশ করে,
—নোয়াখাইল্যা কাগু, বড় দেইখ্যা পাঁচটা ডিম দাও। আর ঝালটা একটু বাড়াইয়া দিবা।
রাস্তায় মসজিদ ফেরত লোকজনের জটলা এখানে ওখানে। খানিকটা দূরে চটপটিওয়ালা বসেছে। তার চটপটির পাতিল থেকে সাদাটে ধোঁয়া উপরের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার রেখা অনুসরণ করে আকাশের দিকে চোখ পড়ে আমাদের। দেখি—বিশাল চাঁদ উঠেছে আকাশে। আজ নিশ্চয়ই পূর্ণিমা!
ডিম খাওয়া হয়ে গেলে পুরো নয়টা ডিমের দাম মিটিয়ে দেয় জয়। তারপর আমরা নাখালপাড়া রেলগেইটের দিকে হাঁটতে শুরু করি।
রেলগেইটের কাছে এসে দেখি—বিশাল হইচই। গেইট নামানো। ট্রেন আসছে কোন দিক থেকে। একটা রিকশা আটকে গেছে মাঝখানে। খুব সম্ভব গেইট নামতে না নামতে পার হতে পারবে ভেবে রিকশাওয়ালা জোরে রিকশা চালিয়ে দিয়েছিল। রিকশার একটা চাকা মাঝপথে এসে বেমক্কা রাস্তার গর্তে আটকে গেছে। ইতিমধ্যে দুপারের গেইটই বন্ধ হয়ে গেছে। দূর থেকে মৃদু হুইসেল শোনা যেতে শুরু করেছে। রিকশাওয়ালা বেচারা রিকশাটাকে ঠেলে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। দুইপাশে অপেক্ষমান পথচারীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হৈ হৈ করে যাচ্ছে— কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। কয়েকটা সিটি বাজানোর শব্দও শোনা গেল। বেশ বড়সড় তামাশা সৃষ্টি হয়েছে যাহোক। বড় সমস্যা হলো, যে লাইনের ওপর রিকশাটা আটকে গেছে, সেই লাইনেই ট্রেন আসছে। অনেকেই রিকশাওয়ালাকে রিকশা ফেলে জানা বাঁচানোর পরামর্শ দিচ্ছে।
হঠাৎ মোহন হাঁক দিলো, এই চল তো, চল, চল, কুইক।
বলেই ও গেইটের নিচে মাথা গলিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। ট্রেনটাকে এখন বেশ কাছে দেখা যাচ্ছে। দৈত্যের মতো ভয়ংকর চোখে লাইট জ্বলছে, থেকে থেকে কান ফাটা হর্ণ বাজিয়ে এগিয়ে আসছে প্রচণ্ড গতিতে। কতটা দূরে ট্রেনটা এখন? একঝলক তাকালাম ওদিকে। বড়জোর কয়েকশ গজ দূরে হবে। ট্রেনের স্পট লাইটের আলোয় রিকশা, রিকশাওয়ালা এবং মোহন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমরা বাকি চারজন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গেইটের নিচে মাথা গলিয়ে দিলাম। তারপর ছুটে গেলাম রিকশাটার দিকে। ছয়জনের মিলিত ধাক্কায় রিকশাটার গর্তে পড়া পাশটা মুহূর্তে শূণ্যে উঠে এলো। সেটা নিচে নেমে আসতে না আসতেই রিকশাটাকে সামনের দিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে আমরা সটকে সরে গেলাম রেললাইনের উপর থেকে। আমরা সরে যাবার বড়জোর দশ কি পনের সেকেণ্ড— তারপর চারদিক ঝম্ ঝম্ করে কাঁপিয়ে ট্রেনটা পার হয়ে গেল রেলগেইট। ট্রেনের প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাবার দশা আমাদের। ছিটকে মাটিতে পড়ে আছি অনেকটা। রিকশাটা লাইনের ওপারে যেতে পেরেছে কি-না—নিশ্চিত ছিলাম না কেউই, গর্তে পড়া চাকাটা ভালো রকম বেঁকেচুরে গেছে। কান সয়ে আসতেই বুঝতে পারলাম—চারদিকে বিশাল হাততালি পড়ছে। ভাল তো! শালার পাবলিক— বিনে পয়সার সিনেমা দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে!
খেয়াল করলাম, রিকশাওয়ালা আমাদের এ পাড়ে নেই, রিকশার সাথে সাথে ওদিকে ছিটকে গেছে। আমরা তো রিকশাটাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে এসেছি, ও বেচারা বোধহয় হ্যান্ডেল ধরে রেখেই ওপাশটাতে গেছে। গায়ের ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দেখি, রিকশাটা নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। চোখ আমাদের দিকে। সে চোখে ভীতি, বিস্ময়, অবিশ্বাস। মোহন আচমকা গিয়ে ওর গালে একটা চড় বসালো।
—শালা, মরতে বেরিয়েছিস, নাহ?
ওর হাত আবার উঠে এসেছে। আমরা গিয়ে মোহনকে থামাই। রাগে ফেটে পড়ছে ওর চোখমুখ। ওর চড় খেয়ে রিকশাওয়ালাটাকে কিন্তু সামান্য পরিমাণও দুঃখিত মনে হলো না। গাল ধরে রেখে কেমন বোকার মতো হাসছে। চোখে অদ্ভুত এক চাহনি।
(চলবে)