
উড্ডয়নসূত্র ॥ পর্ব- ১৫
মোহনের ’স্পেশাল পাত্তির’ সিগারেট আমাদের সবার হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। একটা ঝিম ধরানো গন্ধ ঘরটাতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ধীরে ধীরে, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আমাদের রক্তে, মস্তিষ্কে। ধোঁয়ার রিঙ পাক খেতে থাকে শূণ্যে, তারপর নর্তকী-শরীরের মতো মোহনীয় ভঙ্গিমায় বাঁকতে বাঁকতে বাতাসে মিলিয়ে যায় সহসা। ধোঁয়ার সেই কুঝঝটিকার দিকে চোখ রেখে মোহন আকতারের পিঠে হালকা চাপড় মারে, কুল ডাউন, ম্যান। এত সহজে ছেড়ে দিবো—ভাবিস না।
শালা পলাইছে কই?—জিজ্ঞেস করে জুয়েল।
ক্যান, শুনিছ নাই—তাবলীগ করতে গেছে?—আকতার উত্তর দেয়।
সিগারেট হাত বদল হতে হতে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। আমি খানিকটা দ্বিধা করে সেটা নিই, ছোট্ট টান মেরে কেশে উঠি। তিনজনেই খানিকটা চমকে আমার দিকে তাকায়। ভাবটা এরকম—সিগারেটে টান মেরে কেশে উঠার দিন তো সেই স্কুলেই সেরে এসেছি আমরা। সত্যি বলতে স্বাদটা কেমন বিচ্ছিরি লাগে আমার। এমন তো না যে আজই প্রথম গাঁজার ধোঁয়া খাচ্ছি। তবু আমার গা কেমন গুলিয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি সিগারেটটা জুয়েলের হাতে তুলে দিয়ে বলি, নাহ, ভাল লাগছে না।
মোহন বেশ খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চায়, ভাল লাগছে না? যাস্ শালা। একদম আসল মাল। একবিন্দু ফোর-টুয়েন্টি নাই।
আমি হাসি, এ জন্যই বোধহয় ভাল লাগছে না। ফোর-টুয়েন্টি খেয়ে-খেয়ে অভ্যাস কি-না—
মোহন চোখ টিপে, এসব ঢপ দিয়ো না গুরু। তোমার কাহিনী যে খারাপের দিকে যাইতেছে, সেটা কয়দিন ধরে বুঝতেছিলাম, কিন্তু এতটা খারাপ—সেইটা বুঝলাম আজ।
কী বুঝলি?—আমি প্রতিবাদ করি। ওর কথার ইঙ্গিত কোন দিকে—সেটা বুঝতে না পারার ভান করতে হয় আমাকে।
বুঝলাম—চান্দু তলে তলে এতদূর আগায়া গেছে যে এখন এক নম্বর ধোঁয়া টানলেও পানসা লাগে, মনে হয় কী যেন নাই, কী যেন নাই—
এবারে বাকি সবার মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়। জুয়েল টিপ্পনি কাটে, চান্দু অতদূর না আগাইলে এখনও বোধহয় তেজগাঁও থানায় বইসা থাকতি। তুমি গুরু এসব কথা শুইনো না, তীব্র গতিতে আগায়া যাও, আমি আছি তোমার লগে—
আমি হাত তুলি, দেখ, আমি আগানো-পিছানো—কোন কিছুই করি নাই। অযথা বাজে বকিস না—বাজে কথা? রীতিমত দাওয়াত খাওয়াইয়া আনলি শ্বশুর বাড়ি থেকে —হা হা হা—
আমি একটা ছোট্ট ধাক্কা মারি জুয়েলকে। শালা হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যায়, তবু হাসি থামে না। অন্যরাও হা হা হি হি করেই চলেছে। একসময় ওদের হাসিতে আমাকেও যোগ দিতে হয়। সিগারেট হাত ঘুরে আবার আমার হাতে উঠে এসেছে। এবারে টান দিয়ে দেখি—অত খারাপ লাগে না আর—
কিন্তু একটা কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে আমার এদের কাছে। রাখীর সাথে সেদিন দুপুরের আলাপের কথাটা ওদেরকে বলি আমি। বলে কিরা কাটি, বিশ্বাস কর, আমার সাথে এর আগে বা পরে কোনদিনও সেভাবে কোন কথাও হয় নাই—
আকতারের রাগী-মুখ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমার পিঠে হাত রেখে বলে, এক দুপুরের গল্পেই এতদূর, রীতিমত সিনেমাটিক স্টাইলে হাজত থেকে ছাড়াইয়া আনা—
দরজায় টোকা পড়ে হঠাৎ। নিশ্চয়ই আজমল ভাই। তারাবীহ শেষ করে ফিরে এসেছেন। সিগারেটটাকে পায়ে পিষে দরজা খুলতে উঠে দাঁড়ায় মোহন।
আজমল ভাই ঘরে ঢোকেন একটা ছোট্ট কাগজের প্যাকেট নিয়ে। সেটাকে টেবিলের উপর রেখে বললেন, জিলাপী। খাও।
তারপর নিজ থেকেই জিলাপীর উৎস সম্পর্কে খোঁজখবর দিলেন, মিলাদের জিলাপী। শহীদের বাপ মিলাদ দিল মসজিদে। তোমাদের জন্য নিয়া আসলাম।
আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে জিলাপীর প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করি। আজমল ভাই দোকানের সামনের ঘরে গিয়ে আলো জ্বালান। ঝাঁপ খোলার শব্দে বুঝতে পারি—দোকান খুলছেন। রোজার দিনে সিডি-ডিভিডির ব্যবসা একটু শ্লথ হয়ে পড়ে বটে, তবে আজমল ভাইয়ের কিছু বাঁধা ‘রাতের কাস্টমার’ আছে। এরা রাত বাড়লে বিশেষ ধরনের ডিভিডি ভাড়া নিতে আসে।
সামনের ঘর হতে আজমল ভাই গলা তুলে জানতে চান, সিনেমাটা দেখছো? কেমন লাগলো?
সিনেমার কথায় আমরা খানিকটা থতমত খেয়ে যাই? কোন সিনেমার কথা জানতে চাচ্ছেন আবার? মুহূর্তে মনে পড়ে—আমরা তো সিক্রেট উইন্ডো দেখতে বসেছিলাম।
মোহন উত্তর দেয়, ভাল লাগছে আজমল ভাই। জনি মারাত্মক করছে, কাহিনীটাও সেইরকম—
গুল মারে মোহন। এসব মুখস্ত কথা খুব বলতে পারে ও। আমরা মিটি মিটি হাসি।
আজমল ভাই এরপরে চুপ করে যান। খুট-খাট শব্দ শুনে বুঝতে পারি জিনিসপত্র ঠিকঠাক করছেন। আমরা ঠিক করি, এখান থেকে এবার উঠে যাব। উনার রাতের কাস্টমারদের বিশেষ সিডি-ডিভিডি এই ঘরটাতে থাকে। বেচারাকে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে দেয়া দরকার।
খানিক বাদে আজমল ভাই আমাদের এখানে উঁকি দেন, চা খাইবা তোমরা?
চা খাব, তবে এখানে না। উনাকে সেটা বলি না। আমরা ’না’ করে দেই। বলি, আমরা বেরুবো আজমল ভাই। যাওয়ার পথে চিরুমিয়াকে বলে যাব আপনার জন্য চা দিয়ে যেতে।
নাহ, দরকার নাই। চিরুকে আমি বলে এসেছি। তোমরা এখনও আছ কি-নাই —সেটা ভাইবা তোমাদের জন্য অর্ডার দেই নাই।
ঠিক করছেন। আপনি থাকেন। আমরা উঠি তাইলে আজ।
আমরা উঠে দাঁড়াই। টের পাই, পায়ে আচমকা ঝিঁ-ঝিঁ ধরেছে। হাতের কাছে একটা কাগজ পেয়ে সেখান থেকে ছোট্ট এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে কানের লতিতে গুঁজে দেই। কুসংস্কার কি-না জানি না, তবে দেখেছি—এতে দিব্যি কাজ হয়। মুহূর্তের মধ্যেই পায়ের ঝিঁ-ঝিঁ কমতে শুরু করে।
আজমল ভাই খানিকটা আমতা-আমতা করে বললেন, একটা কথা বলি, তোমরা কিছু মনে করবা না প্লিজ—
উনার কথা বলার ভঙ্গিতে আমাদের কেমন যেন খটকা লাগে। উপদেশ দিবেন না তো আবার! সমস্বরে বলি, না না, বলেন না কী বলবেন—
দ্বিধার ভাবটা কাটিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে আজমল ভাই তড়বড় করে বেশ কিছু কথা বলে উঠলেন। সেসবের সারমর্ম হচ্ছে এরকম: আজ মসজিদের ইমাম সাহেব তারাবীর পর ড্রাগ, নেশা—এসব নিয়ে লম্বা লেকচার দিয়েছেন। কথায় কথায় এ পাড়ার ড্রাগ ব্যবসার কথাটাও উঠে এসেছে। এলাকার উঠতি যুবকরা যে এসবে আসক্ত হয়ে পড়েছে, এবং একই সঙ্গে এসবের বাণিজ্যেও নেমে পড়েছে—এ ব্যাপারে এলাকার সবাইকে বিশেষ সর্তক থাকার নসিওয়ত করেছেন। এ ধরনের যুবকদেরকে কোন রকম প্রশ্রয় দেয়াটা কত বড় গুণাহর কাজ হবে—সেকথাটাও বিশদ বর্ণনা করেছেন।
আজমল ভাইয়ের কথা শুনে—সকলেই বুঝতে পারি—আমাদের কান-মাথা গরম হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা উনার কথা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। আজমল ভাই আমাদের জানান, শুধু ইমাম সাহেব একা না, এলাকার মুরুব্বীরাও দেখলাম বেশ কথা চালাচালি করছে বিষয়টা নিয়ে।
এসব তথ্য দেয়া হয়ে গেলে তিনি থামেন। হয়তো আমরা কী বলি, কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাই—সেটা যাচাই করে নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমরা তখনো চুপচাপ। এ পর্যায়ে আজমল ভাইয়ের আমতা আমতা ভাবটা আরো প্রকট হয়। তার কথা-বার্তার মধ্যে প্রায় তোতলামি ঢুকে পড়ে। তিনি তোতলাতে তোতলাতে আমাদেরকে বলেন, তোমরা কিছুদিন এদিক-ওদিক ঘোরাফেরাটা বন্ধ রাখো। বুঝই তো— পাবলিকের মুখ! ঘাস আর শাকপাতার পার্থক্য করতে পারে না। তারা তো ভাবতেছে, মানে, বুঝই তো—
মোহন খানিকটা তীব্র গলায় বলে উঠে, ভাই কি বলতে চাচ্ছেন—আপনার এখানে যাতে আর না আসি?
আজমল ভাই তাড়াতাড়ি করে জবাব দেন, না, না, আসবা না কেন? অবশ্যই আসবা। তোমরা আমার আপন ছোটভাইয়ের মতো। মতো-ইবা বলি কেন? ছোটভাই-ই তো। আসবা। তবে বুঝই তো, কয়টা দিন, মানুষের কানাঘুষা একটু ঠাণ্ডা হইতে দাও—মানে, প্লিজ কিছু মনে কইরো না। আমার দোকান তোমাদের জন্য সবসময়ই খোলা, বুঝলা না, এদিকে ব্যবসা তো করতে হইব—
আমরা আর দাঁড়াই না। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসি। পেছন থেকে আজমল আবারো বলে উঠেন, আসবা কিন্তু—
রাস্তায় নামতেই একটা শীতল হাওয়া আমাদের গায়ে শিরশির করে ঢুকে পড়ে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, ভেতরটা জ্বলছে। জুয়েল প্রস্তাব করে, চল তো, এই শালা ইমামটার লগে দেখা কইরা আসি—দেখি শালায় পাবলিককে কী ওয়াজ শুনাইছে—
জুয়েলের সাথে আকতারও লাফ দিয়ে উঠে, হ, চল যাই। দেখি কী কইতে চায়—
আমি থামাই ওদেরকে। মোহনও নিরাসক্ত গলায় বলে উঠে, বাদ দে আপাতত। এ নিয়া ক্যাচাল করার সময় এখন না। চল রেললাইনের দিকটায় যাই।
জুয়েল তেড়ে উঠে, বাদ দিবি মানে, শুনছ নাই কী বলল আজমল ভাই—
আমি উত্তর দেই, শুনছি তো! এখন কী করবি? ইমাম সাহেবকে থ্রেট দিয়া আসবি? লাভটা কী হবে—? মাথা গরম না কইরা বরং সুযোগের জন্য অপেক্ষা করা দরকার—
প্রসঙ্গত বলা দরকার, সে সুযোগ আমরা একসময় খুব ভাল মতোই কাজে লাগিয়েছিলাম। সে বিষয়টা যথাসময়ে বলা হবে বিধায় আপাতত শুধু ইমাম সাহেবের খানিকটা পরিচয় পেশ করে রাখা যাক।
ইমাম সাহেবের সাথে আমাদের বেশ কিছুদিন ধরেই খানিকটা রেষারেষি চলছিল।
আমাদের পাড়ার মসজিদের নিয়মিত ইমাম—মওলানা জহিরুদ্দিন রব্বানি— এ এলাকারই স্থায়ী বাসিন্দা। মসজিদের ঠিক পাশেই পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের মালিক। বিল্ডিংয়ের নাম—রব্বানি ভিলা। এক তলায় নিজে পরিবারসহ থাকেন। বাকি চারতলা ভাড়া দেওয়া। তার বাড়ির ভাড়াটিয়াদের ভাষ্য মতো: এমন খচ্চর বাড়িওয়ালা আল্লার দুনিয়ার আর কোথাও নাই। বাড়িওয়ালা হিসেবে তার ভাড়াটিয়াদের জন্য দৈনিক পানি বন্টনের ব্যাপারটা বললেই তার ‘খচ্চরামির’ একটা ছোট্ট নমুনা পাওয়া যাবে। তার বাড়িতে দৈনিক একবেলা পানির ট্যাংকি ছাড়া হয়। সকাল সাতটা থেকে আটটা —এই এক ঘন্টা। এ সময়ে ভাড়াটিয়াদের কাজ হলো কল ছেড়ে দিয়ে বালতি-পাতিল-বদনা-থালা ইত্যাদি যতরকম জিনিসে পানি জমানো সম্ভব—সারাদিনের জন্য সেপরিমাণ পানি সঞ্চয় করে ফেলা। আটটার সময় নলে পানি আসা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর কেউ যদি কান্নাকাটিও করে—আর পানি ছাড়বেন না উনি। কোন ভাড়াটিয়া যদি যথেষ্ট পানি সংগ্রহ করে রাখতে ব্যর্থ হয়, সেটা তার নিজস্ব সমস্যা, সেই পরদিন সকাল বেলা পর্যন্ত পানি ছাড়া থাকতে হবে তাকে। ভদ্রলোকের চেহারা কাতল মাছের মতো। মুখে দাড়ির স্বল্পতার জন্য কাতল ভাবটা আরো প্রবল আকারে দেখা যায়। চেহারা অনুযায়ী ভারি ধরনের শরীর। সেই শরীর থেকে সারাক্ষণ আতরের সুগন্ধ আসতে থাকে। উনার গলার স্বর বেশ সুরেলা। সুরেলা গলার জন্যই বোধহয় প্রতি শুক্রবার উনার ওয়াজ-নসিয়ত শোনার জন্য বেশ লোক সমাগম হয় জুমার নামাযে। ইমাম সাহেবের বয়স পঞ্চাশের উপরে। রাস্তায় ছোট-বড়—যার সাথেই দেখা হয়— সুমধুর স্বরে সালাম দেন। এবং সেটা ‘আসসালামু আলাইকুম’-এ শেষ হয় না। রীতিমত ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ওয়া জান্নাতু ওয়া মাগফিরাতু’ পর্যন্ত চলে যায়।
আমাদের সাথে উনার রেষারেষির সূচণা বছর খানেক আগে এক হরতালের দিন দুপুরবেলায়। রিবোধী দলের ডাকে হরতাল চলছিল। খুবই কড়া হরতাল। দুয়েকটা রিকশা ছাড়া আর কিছু চলছে না। আমরা এ সুযোগ নিয়ে মসজিদের গলির দুই পাশে কয়েকটা পুরনো টায়ার জড়ো করে রাস্তা ব্লক করে দিলাম। তারপর শুরু করলাম ক্রিকেট খেলা। ব্যাট করছিল (খুব সম্ভবত) জয়। দুম-দাড়াক্কা পিটানো ওর স্বভাব—সেটা পাড়ার গলিতেই হোক, কিংবা তেজগাঁওয়ের মাঠেই হোক। আফসোস, টি২০ খেলাটা তখনও আর্ন্তজাতিক লেভেলে সেভাবে শুরু হয়নি, তবে আমরা অন্তত বছর পাঁচেক ধরেই এ ফর্মেটে ক্রিকেট খেলে আসছি—শুধু যদি বুদ্ধি করে প্যাটেন্টটা নিয়ে রাখতাম! যাই হোক, জয়কে বারবার সাবধান করে দেয়া সত্ত্বেও ও বারবার চার-ছক্কা পিটিয়ে যাচ্ছে, আর সেটা এ বাড়িও-ও বাড়ির দেয়ালে ঠক্ ঠক্ করে লাগছে। এমনি একটা ছক্কা ইমাম সাহেবের ঘরের জানালার গ্রিল ভেদ করে তার ঘরে ঢুকে পড়ে। পরমূহূর্তে আমরা একটা প্রচণ্ড ‘আউ-আউ’ এবং একই সঙ্গে ‘ইন্নালিল্লাহ ইন্নালিল্লাহ’ শুনতে পাই। এমন শোরগোল হচ্ছিল—আমরা ভেবেছিলাম ক্রিকেট বলের আঘাতে কেউ বোধহয় মারাই গেছে। একটু পরে চিৎকার-চেঁচামেচি থামে, বারান্দায় ইমাম সাহেব উঁকি দেন। খালি গা। সারা গায়ে গরিলার মতো বড় বড় পশম। ইমাম সাহেবের হাতে আমাদের লাল টেপে মোড়ানো ক্রিকেট বল। ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে থামালেন। মিনমিনে স্বরে বললেন, ঘুমাইয়া ছিলাম তো, বল গিয়া লাগছে গায়ে। ভয়ে এমন চ্যাপরা খাইছি—
ইমাম সাহেবের লম্বা আচকানের তলায় গোলগাল ঠেলে উঠা পেটটা নিয়ে আমাদের এতকাল বেশ উৎসুক্য ছিল। এখন সেটা প্রকাশিত দেখে আমাদের কেমন যেন বিবিমিষা জাগে। উনি আমাদের খেলা নিয়ে কিছু বললে তার প্রত্যুত্তর করার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। সেসময় ছিল আমাদের নিজেদেরকে পাড়ার সবার কাছে ‘সেয়ানা হয়ে ওঠা’ প্রমাণ করার কাল। তাই আমাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ কিছু বললেই আমরা সাথে সাথে গরম কথাবার্তা চালাতাম, প্রচ্ছন্ন হুমকি-ধামকি দিতেও পিছপা হতাম না। হয়তো আমাদের উগ্র মূর্তি দেখেই উনার ঐ মিনমিনে স্বর। সমস্যা হলো, এমন স্বরের সঙ্গে কথা চালাচালি করা যায় না। গরম কথার উৎসাহ হারিয়ে আমরা আন্তরিক স্বরেই জানতে চাই, আহারে! ব্যথা পান নাই তো—
তিনি তার পেটে হাত বোলাতে বোলাতে উত্তর দেন, না না ব্যথা পাই নাই। চ্যাপরা খাইছি।
পেটের উপর হাত বোলানো দেখে মনে হলো—বলটা বোধহয় ভদ্রলোকের পেটেই লেগেছে। আমরা চুপ করে থাকি। উনার হাতে বল। সেটা তখনো ধরে রেখেছেন।
মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে তাড়া দিতে হয়, বলটা দেন। আর দরজা বন্ধ করে ঘুমান গিয়া। তাইলে আর বল ঢুকতে পারবো না।
তিনি উত্তর দেন, হরতালের দিন। তোমরাও গিয়া ঘুমাও তো একটু।
ফয়সাল (বন্ধু বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেটা না, মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলতে আসতো আমাদের সাথে) একটু ফচকে স্বভাবের ছিল। খানিকটা নিচু গলায় উত্তর দেয়, বউ নাই, দুপুর বেলায় কী আর ঘুম আসে—কন?
আমরা হা হা করে হেসে উঠি। উনি আর কথা বাড়ান না। হাতে ধরা বলটা রাস্তার দিকে ছুঁড়ে মারেন। তারপর থমথমে মুখটা নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েন। তার সাথে সাথে বারান্দার দিকের দরজাটা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনতে পাই আমরা।
বলটা হাতে নিয়ে দেখি—ফাটা। আগা গোড়া টেপ প্যাঁচানো—ফাটার কথা তো না। আরেকটু সর্তক চোখে দেখা যায়—আসলে ফাটেনি, দা কিংবা ছুরি দিয়ে কাটা। নির্ঘাত ইমাম সাহেবের কাজ।
(চলবে)