
ইশরাতের পেঁচারা
ইশরাতকে আমি চিনতাম না, চিনবার মতো কোন মুদ্রণপ্রমাদেও জড়িয়ে পড়িনি তখনো পর্যন্ত। বেলা গড়িয়ে পড়ছিল মৌসুম শেষে আমড়াগাছের হলুদ পাতায় পাতায়, প্রতিবেশী ঠাকুরমা কোমরের ব্যাথা নিয়েও দোতলায় উঠে এসেছেন দু’মাস আগে রোদে দেওয়া কেঁচোর তেলের শিশি নীচে নামিয়ে নিয়ে যেতে। আমায় দেখে মৃদু ধমকের আঁচে বললেন, ‘এই তোর চান করার সময়, এ্যাঁ? অবেলায় নাইতে নেই, অসুখে পড়বি’।
সত্যিই ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছিল। গায়ে বিশাইনদী-রঙা একটা শাল চড়াতে চড়াতে তিনি আবার শুধালেন, ‘তুই না একসময় মায়ের গান গাইতি, খোকা? এখন আর গানবাজনা করিস না?’
‘নানা ঝামেলায় এখন থাকি ঠাকমা, হারমনিয়ামটা যে হাতে নিব, ফুরসতই পাই না। তবে ছোটবেলায় তোমাদের বাড়িতে গিয়ে কতবার গেয়েছি, বল!’
মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘হ্যাঁ, একবার তো গাইতে গাইতে তোর কী যে হল, হাউমাউ করে কেঁদে ফেললি। জানিস, তার ক’দিন পর একরাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, একটা মস্ত বড় মাছের পিঠে চড়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণ একা যমুনানদী পার হয়ে আসছেন, তার দুই হাতে দুইটা খরগোশ!’
ছাদ থেকে নামতে গিয়ে তিনি আবার শুধালেন, ‘আচ্ছা বল্ তো, মা লক্ষ্মীর বাহন কী?’ বয়স হলে সবার এমনই হয় বুঝি, খালি এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘ইয়ে মানে পেঁচা বোধহয়, লক্ষ্মীপেঁচা তাই না?’
তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘গোবিন্দভোগ চাল আর নলেনগুড় দিয়ে কাল পায়েস করব, সাথে নাগফজলি আম, ফ্রিজে রাখা ছিল। এসে খেয়ে যাস‘।
তো তখনো ইশরাতকে চিনতাম না ব’লে আঠারো শতকীয় কোন দীর্ঘ প্রেমের কবিতা লিখে উঠতে পারিনি। তাকে দেখার আগে পর্যন্ত আমার বিশ্বাস ছিল, ব্লু মুন কেবল রাতেই ওঠে। রাত মানে তাকে আমার মনন করবার একটা চরম ভৌতিক নিঝুম ওয়াইজা বোর্ড, যার চারিদিকে আমার অসংখ্য প্রতিচ্ছবি হলঘরের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে মাঝে বোর্ডের উপর তার আলোকিত মুখ বসিয়ে দিয়ে, তাকেই মনেপ্রাণে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা, সমস্ত শরীরসহ। আমি জানি, ওফেলিয়া তার প্রিয় চরিত্র, এজন্য ওফেলিয়ার অতৃপ্ত আত্মাকে যদি কোনভাবে তার শরীরের উপর ভর করিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারি, চিরবিষণ্ণ ওফেলিয়াকে জাগিয়ে তুলতে পারি তার স্মরণের মধ্য দিয়ে, আর যাই হোক, তাহলে সে খুবই পুলকিত হবে। পরবর্তীতে আমি সেই চেষ্টাও করেছি, আন্তরিকভাবেই করেছি, কিন্তু ফল পাইনি। কেননা আমি যে তখন পর্যন্ত সৎমার লিবিডোয় ট্র্যাজিক ও উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারিনি! পিতৃহত্যার দায় ও প্রতিশোধ যদিও আমার রক্তে, কালকেউটে জঙ্গলে আদিবাসীয় শিকারের নিশি ও নৈরাজ্যের মতো বইছিল। ফলে, মনে মনে সে শেক্সপিয়রীয় স্মৃতিভাষ্য অতিক্রম করে যেতে পারলেও, হাঁদাগঙ্গারাম আমি এমনকি ঠাকুরের ঘরে বাইরে উপন্যাসের সাহসী সন্দীপ হয়ে উঠতেও পারলাম না, আজ তক্!
তবু তোমায় আমি বাঞ্ছা করি, ওগো উজানি গাঙের কন্যা।
আকাশে বিশালাকার এক ক্যারামবোর্ডে সোনালী গুটির মতো আমাদের স্মৃতিরা সমানে বাড়ি খাচ্ছিল ষাটের দশকে গ্রাম ছেড়ে শহরে উঠে আসা এক গল্পে—যেখানে দূরের প্রমত্তা করতোয়া নদী বেয়ে কবে যেন ভেসে আসত রড-সিমেন্ট-বোঝাই বড় নৌকা, অবন ঠাকুরের কুঠিবাড়ি নওগাঁ জেলা থেকে। লোকসাহিত্যবিরল এসব গল্প আমি শুনেছি আমার দাদার কাছে, যিনি ভাল ফার্সি জানতেন, গুইসাপের চামড়ায় মোড়ানো তার কবিতার নীল রঙের খাতাও খুঁজে পেয়েছি, এই কয়েক অমঙ্গলবার আগে, জমিজিরাতের বান্ডিল বান্ডিল দলিলদস্তাবেজ ঘাটতে গিয়ে। দাদা চলে গেছেন প্রায় বত্রিশ বছর হল, তবু তার মৌরসীপাট্টা এখানে টানলাম কেন? গ্রামে আমাদের শতবর্ষের অধিক পুরনো জমিদারবাড়ির কাছেই দাদার তৈরি করা দোতলা বৈঠকখানার উপরতলায় অব্যবহৃত মস্ত কুলঙ্গিতে বাস করত উটপাখি-সাইজের জোড়া লক্ষ্মীপেঁচা, যেন সহস্র বছর তাদের বিচরণ এই হীনমন্য বাটপারদের দুনিয়ায়। আর মাঝেমধ্যে কলিঙ্গ-নিশীথে গোলাঘরের চালে দুধসাদা বাস্তুসাপটা ঝুলে থাকলে পেঁচা দুটো অসঙ্গমের আর্তনাদে ডেকে উঠত পরষ্পরের দিকে মুহ্যমান হয়ে। সেও আজ থেকে প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আগের কথা, যখন গ্রাম ছিল শহরে পাড়ি জমানো অপূর্ব রায়ের সাদামাটা তৈলচিত্র।
তো ইশরাতকে আমি চিনতাম না—যেভাবে পদ্মার ইলিশ শীতে জেগে ওঠা সর্বনাশা চর বর্ষাকালেই আগাম চিনে ফেলে, যেভাবে করাতকলের সন্ধ্যা অভয়ারণ্যের আহ্বানে শিহরিত হয়, যেভাবে এদেশে খনিজসম্পদ চুরি হওয়ার ন্যারেটিভে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা সিস্টেম লসের অজুহাত ঢুকে পড়ে—সেভাবে তাকে আর চেনা হল কই! আর ব্যক্তিগত জানাশোনা কিংবা পারষ্পরিক চিন্তার অভিন্নতার ব্যাপারটাই গোলমেলে মনেহয় আমার, পৌর কমিশনারের কাছেও। মূলত একজন মানুষ তার নিজের গোধূলির কাছে, সমস্ত দায়বোধ ও দূরত্বের কাছে অচেনা রয়ে যাবে চিরটাকাল। যখন ক্যালাইডোস্কোপে ছড়িয়ে পড়ে ভয় ভ্রান্তি অপ্রাপ্তি আর হেমন্তের সোনাটা, তখন ফরিদপুরে তার আব্বা-আম্মার পাশে সোফায় বসে চিতোইপিঠা খেতে খেতে—ঢাকায় থাকতে বুদ্ধদেব বসুর সাথে নবাবদের যোগাযোগ হয়েছিল কিনা—এই আলাপ কীভাবে তুলতে পারি? ফলে ইশরাতকে ততটা চিনবার উপায়ও ছিল না আমার, মানে মফঃস্বলের মানে আড়ালপ্রিয় কবির মানে পৌণ্ড্রনগরের দূর্বাঘাস কী করে চিনবে বিশ্বসাহিত্যের এলিট শ্রেণীর কাউকে? কিন্তু চেনা হলো তাকে পৃথিবীর ঐ প্রাচীনতম এক প্রাণ পেঁচার উসিলায়। রজনীতে নদীর পাড় ভাঙার ভয়াল আওয়াজের মতো, মেরির নারীমুক্তি বিষয়ক প্রবন্ধে সরীসৃপ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গিয়ে তার মনে বাসা বাঁধে নানা এন্টিথিসিস আর তাদের সুরাহা না হওয়ার বাহানায় তার সাথে সামান্য পরিচয় হলো আমার।
একবার এডোয়ার্ড পার্কে খুব সক্কালে বয়স্কদের ব্যায়াম চর্চা কেন্দ্রের প্রায় মাঝখানে উপুড় হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার এক কর্পোরেট দোস্ত জিগাইছিল, ‘তোমাদের গ্রামের বাড়িতে ছোট শহীদমিনারের সাইজে দুইটা পেঁচা আছিল না? তা ওজন কতো, হাইট কতো ইঞ্চি হইতে পারে ওগুলার? পায়ের পাতার কালার কেমন, মনে আছে?’
আমি আসমান চিইড়া পড়তে পড়তে হেঁচকি আটকায়ে বললাম, ‘এইসব ক্যান জিগাও? ঘটনা কী?’
‘আছে বস, জরুরত আছে। আগে ক্লিয়ার কর, তাদের কী অবস্থা এখন? চাইলে পাওয়া যাবে?’
তার ফণায়মান ঈঙ্গিত খানিকটা আন্দাজ করতে পেরে বললাম, ‘গ্রামে তো যাই না ম্যালা দিন, দরকার পড়ে না আরকি, তয় পেঁচাগুলা কি এদ্দিন বাঁইচ্চা আছে? তোমার সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কবেই ঘটে গ্যাছে গা…’
সে কিছুক্ষণ মেঘমেদুর থেকে ফের ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘আমরা না হয় টাল খাইছি, তা তোমরা কী কী করলা এদ্দিন, এ্যাঁ? এক্কেবারে, সবার জন্য দুনিয়া বানায়ে ফেলছ না বড়?’
টাইব্রেকারের সামনে বেমক্কা পড়ার মতো শোচনীয় হয়ে বললাম, ‘না, তা তো পারি নাই’
‘তাইলে? তিস্তার পানিতে আবাদ করবা আবার তারে নিয়া রাজনীতিও করবা লেকিন গা ভিজাইবা না, তাইলে হবে?’
দেখলাম এই প্রেমের গল্পটা আস্তে আস্তে বনে আগুনে-পোড়া হরিণমাতার পেটে কালাশনিকভ-চিহ্নিত পথ হয়ে উঠতে চাইতেছে, তাই খিস্তি আর না বাড়ায়ে কণ্ঠ নীচু কইরা তারে ধরলাম, ‘উস্তাদ তোমার আরব্য রজনীর খবরাদি কী? অখনো চালু রাখছ স্মৃতি দেওয়া-নেয়া?’
গার্ট্রুডের শয়তানি হাসি লুকায়ে সে আমারে বাইসেক্সুয়ালিটির ডকইয়ার্ডে টাইনা নিয়া কয়, ‘হালায় কও কী, এ্যাঁ? তোমারে কই হুতুমের বাসা, আর তুমি জোড়া দিতে দিতে তারে লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়া তুলছ? এজন্যই তো তোমরা সার্ত্রের চেয়ে নিটশেরে আজ বেশি তোল্লা দিতাছ…’
‘ক্যান, এ্যাডোনিসের চেয়ে তো দারবিশরেই ঘনঘন অনুবাদ করতেছি আমরা, ঠিক কিনা?’
‘হ, ঐ পর্যন্তই, সফদার হাশমির চাদর তো আর গায়ে জড়াইবা না। কমফোর্ট জোন বাড়াইতে হয়, বুঝলা?’
সেদিনের সেই আলাপ পরে কখনোই আর আমাদের গ্রামের বাড়ির বৈঠকখানার দোতলায় সংসার পাতা প্রাগৈতিহাসিক পেঁচা দুটোকে বিদেশীদের কাছে বেঁচে দেওয়ার এথিকস-আনএথিকসের দিকে এগোয়নি।
আসলে ইশরাতকে জানতে গিয়ে ক্রমশ পেঁচার গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি, নাকি পেঁচার সারল্যে, ত্রিকালদর্শীতায় আমি ধীরে ধীরে ইশরাতের মননে-মজ্জায় এক ব্যাকুল শামাগান হয়ে উঠতে চেয়েছি— তা এখনো দক্ষিণরায় দিগন্তে স্পষ্ট নয়। মোটকথা সীসার খনি বেয়ে উঠে আসা অন্ধ তীরন্দাজের অভিশাপ আমায় ছাড়ছে না এ জীবনে। আমি জানি, ইশরাত কখনোই আমায় পার্বতীর মতো নি:শর্ত ভালবাসতে পারবে না, তবু আমি চাই সে ওফেলিয়া সিনড্রোম থেকে বেরিয়ে আসুক, বুইড়া কবি-অনুবাদকদের বদআছর থেকে নিস্তার পাক, প্রাণখুলে নাচগান করুক, অ্যালপিনিস্ট হতে চাক, তিনশ বছরের জ্ঞানী দুষ্টু কাছিমের মতো সে আমাদের শানবাঁধানো পেল্লাই পুকুরে কোজাগরী রাতে ভেসে ওঠা জ্বীনদের সোনার সিন্দুকের উপরে বসে আমার দীপ-জ্ব্বলা পাতার নৌকোদের কামড়িয়ে তছনছ করে দিক। তার রূপোর রিভলবারের সামনে আমার তামাম ভবিষ্যৎ উদ্বাহু হয়ে দাঁড়াতে রাজি আছে, শুধু একবার তার পেঁচাগুলি যদি জীবন্ত হয়ে উঠত ঈশ্বরের করোটিতে! অথচ শনির বলয় নিরুদ্দেশ হবার সেই নিশুতিতে, দূর থেকে একটা সাদা হাতিকে এগিয়ে আসতে দেখেছে অনেকেই, পিঠে একজন মাহুতবন্ধু, অল্পবয়সী, চাঁদকে বাঁশী বানিয়ে যিনি বাজাচ্ছেন, খাজা মঈনুদ্দিন তাহার নাম। এবার আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি, ইশরাতের পেঁচারা সুরের এক-একটা মূর্ছনা হয়ে মাহুতের বাঁশি থেকে উড়ে উড়ে এসে বসছে আমার ফুসফুসে, জায়নামাজে, বাঞ্ছাবাহিত রাস্নায়।
সেই থেকে পাখিদের শূন্য গ্যালারি আমায় ‘ইশরাত’ নামে ডাকে, পাহাড় মাড়িয়ে নেমে আসা প্রাচীন বাণিজ্যপথ আমায় ‘ইশরাত’ নামে ডাকে, নষ্ট জিপের বনে জমতে থাকে কানাঘুষো, এই সারোগেট-সভ্যতাও কোথাও বা প্রমাণ করতে মরিয়া—আর কেউ নয়, আমিই হলাম ইশরাত এবং আমার স্মৃতিরা হল ব্যাংকপাড়ায় দীর্ঘছায়া ফেলে উড়ে চলা কয়েকটি উপনিবেশিক পেঁচা! অথচ ততদিনে আমার গহনজলে, প্রতিবিম্বে দেখি কী… স্বয়ং ওফেলিয়া তার সকল নিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠেছে! এবং এও স্পষ্ট হতে থাকে যে, প্রেম হচ্ছে আগুন না ধরানো সেই মোমমূর্তির মতো, হ্রদে যার অসুখী ছেলেবেলা কেটেছে আর পাতা ঝরছে, দৃষ্টির বাইরে অসমাপ্ত পাতা ঝরছে বেজে চলা সারেঙ্গীতে অথবা শিব-উপাসকদের সারিসারি অগ্নিকুণ্ডে। সেই থেকে পৃথিবীর সুউচ্চ মিনারে-মিনারে উঠে, ফুলদের শ্বাসকষ্টের মতো, যুগল পেঁচার কণ্ঠে সমস্ত নভোমণ্ডলজুড়ে আহ্বান করেছি, ‘ইশরাত, ও ইশরাত, আমিই তোমার চিরকাঙ্ক্ষিত ওফেলিয়া! শান্ত হও সন্ধ্যারতি হও এবং ক্রমশ নিষ্ঠুর হতে শুরু কর। দেখো, পারমাণবিক অঞ্চলে কারা যেন একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাতে চাচ্ছে, প্রেতযোনিরা বিষধ্বনি দিচ্ছে তোমায়, সাহসী হও, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও তুমি, অত:পর সর্বভূতে হত্যা কর আমায় শুদ্ধতম এক আলিঙ্গনে। হত্যা কর মোরে। আমার চিরপ্রস্থান বিনে তোমার যে আর কোন সুস্থতা নেই স্বতশ্চল নেই! বিদায় ইশরাত’