
ইরানের কবি ফোরগ ফাররখজাদ’র একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা
[ফোরগ ফাররখজাদ (১৯৩৫-১৯৫৭) ছিলেন একজন প্রভাবশালী ইরানি কবি এবং চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি ১৯৩৫ সালে তেহরানের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় চাচাতো ভাইকে বিয়ে করেছিলেন। খুব শীঘ্রই তাদের ঘর আলোকিত করে একটি পুত্র সন্তানের আগমন ঘটে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা সিন তাকে বিতর্কের কেন্দ্রে রেখেছিল। তার কাজের অনুবাদক, শোলেহ ওলপে লিখেছেন, ‘ফোরগ একটি সংবেদনশীলতা এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চেতনা দিয়ে লিখেছিলেন যা ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে ইরানের একজন নারী কবির সাহসী প্রকাশ, যিনি সময়ের বিপক্ষে গিয়ে লিখেছিলেন। শিল্পসাহিত্য চর্চার জন্য তার জীবনে একটি উচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে। সমাজ এবং তার পরিবারের প্রতি নেমে এসেছিল অসম্মান, তার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার কাছ থেকে। এজন্য তাকে মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে সময় কাটাতে হয়েছে বহুদিন। তিনি ১৯৬৭ সালে বত্রিশ বছর বয়সে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।]
তোমায় ভালোবেসে
আজ রাতে তোমার চোখের অসীম আকাশ থেকে
আমার কবিতায় তারার বৃষ্টি ঝরছে,
শুকনো পাতার নিসঙ্গতায় যেন
আমার আঙ্গুলসমূহ জ্বলে উঠছে তোমার স্পর্শে
আমার শরীরে জ্বর,
কবিতার চরণগুলো যেন লজ্জার মাথা খেয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছে
শীতল অনুভূতিগুলোকে সে যেন আগুনের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে,
আর ক্ষণে ক্ষণে তৈরি করছে অগ্নিশিখা।
হ্যাঁ, এভাবেই ভালোবাসা শুরু হয়,
এবং যদিও এ পথের শেষ দিগন্তটি মাড়িয়ে গেছো তুমি,
তবুও মনে হয় যেন এ পথ এখনও আছে বাকী।
এ আমার ভালোবাসার অনুভূতি প্রিয়।
অন্ধকারকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন?
হীরেঝরা শিশির ফোঁটায় রাত যেন জ্বলছে
জুঁইয়ের নেশাযুক্ত গন্ধে রাতের হিম শরীরে লেগে থাকে মাদকতা।
আমাকে তোমার মাঝে হারিয়ে যেতে দাও
যতক্ষণ না কেউ আমার সন্ধান না পায়।
তোমার শিশিরের দীর্ঘশ্বাসের উত্তাপ
যেন আমার গানের শরীরে ভেসে উঠুক।
ঘুমের রেশমে মোড়ানো চাদরে
আমার ভেতরে আলোর ডানাকে গজাতে দাও,
খোলা দরজা দিয়ে উড়ে যাচ্ছি
পৃথিবীর সীমারেখা পেড়িয়ে দেয়ালের বাইরে।
তুমি কি জানো আমি কেমন জীবন চাই?
আমি যেমন তোমার সাথেই থাকতে পারি,
তুমি, তুমি শুধুই তুমি,
যদি জীবন হাজার বার পুনরাবৃত্তি হয়,
তবুও তুমি, তুমি, এবং আবারও তুমি।
আমার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি সমুদ্র:
আমি কীভাবে এটি লুকিয়ে রাখতে পারি?
আমি কিভাবে ভিতরে টাইফুন বর্ণনা করতে পারি?
আমি তোমার সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছি
আমি সবুজ তৃণভূমি দিয়ে দৌড়াতে চাই,
পাহাড়ের কঠিন পাথরে আমার মাথা ঠেকাব,
নিজেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে সপে দেব।
আমি তোমার সাথে মিশে থাকতে চাই
আমি ধূলিকণার মতো নিজের মধ্যে ভেঙে পড়তে চাই,
আস্তে আস্তে তোমার পায়ে আমার মাথা রাখি,
আপনার ওজনহীন ছায়াকে দ্রুত আঁকড়ে ধরো।
হ্যাঁ, এভাবে ভালোবাসা শুরু হয়,
এবং যদিও এ পথের শেষ দিগন্তটি মাড়িয়ে গেছো তুমি,
তবুও মনে হয় যেন এ পথ এখনও আছে বাকী।
এ আমার ভালোবাসার অনুভূতি প্রিয়।
সঙ্গী
রাত আসে
তারপর অন্ধকার
গত রাতের অন্ধকার-
চোখ
হাত
তারপর, ছন্দময় শ্বাস- ভিতরে-বাইরে
এবং টুপ টুপ
টাপ টাপ
ফোঁটা জল
কল থেকে পিছলে যাচ্ছে
তারপর, দুটি সিগারেট
জ্বলন্ত লাল দুটি দাগ
একটি ঘড়ির টিক টিক
এবং দুটি হৃদয়
নিসঙ্গতায় ডুবে থাকে…
যোগাযোগ
আমার রামধনুর রঙ ক্রমশই কালো হচ্ছে
আমার সেই সরল অনুভূতিগুলো,
একচ্ছত্র সুফিতান্ত্রিক আধিপত্যতায়
বিস্মিত হচ্ছে তার অবাক চোখের সঙ্গীতে
আমি তার উপস্থিতি আমার চারপাশে অনুভব করেছি,
অনন্তের দিকে বিকিরণ
জীবনের অন্য প্রান্তে
আগুনময় লাল পিরামিডের মতো,
মেঘের মত বৃষ্টিতে,
আমাকে সে জড়িয়ে আছে আকাশের মতো
উষ্ণতর নিঃশ্বাসে
তার হাতের স্নিগ্ধ নাচন
যেন বাতাসের গায়ে ভাসছে
আর আমার সমস্ত সত্তার
উপাদানসমূহকে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে।
আমি আমার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করলাম
সুচতুর যাদুকরের ঘণ্টার মতো।
ঘড়িটা উড়ে গেল।
বাতাসের সঙ্গে পর্দা সরে গেল।
আমি তাকে নিজের সত্তায় আঁকড়ে ধরেছিলাম
সেই আগুনের হলকার ভিতরে
আমি তাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম
কিন্তু আমার বিস্মিত অনুভূতি
তার ঘন ছায়াময় দোররায়
যেন পরস্পরকে রেশমের মতো হাওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে
অন্ধকারের গোড়া থেকে
কামনার দীর্ঘ পথ বরাবর
এবং কম্পনের মাধ্যমে
-যে প্রাণঘাতী কম্পন
আমার অবসানের সমাপ্তি ব্যাপী খেলা করছে।
আমি আমার মুক্তি অনুভব করছি।
আমি আমার মুক্তি অনুভব করছি।
আমি ভালোবাসার প্রসারিত আনন্দ থেকে
আমার ত্বকের ভাঙন অনুভব করেছি,
আমার হৃদয়ের জ্বলন্ত অস্তিত্ব ধীরে ধীরে গলে গেল
এবং প্রবাহিত হতে হতে,
পৌঁছে যাচ্ছে চাঁদের মধ্যে,
একটি অশান্ত অস্পষ্ট চাঁদ
একটি খাদে ডুবে যাচ্ছে।
আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম।
আমরা পাগলের মতো এক মুহূর্ত বেঁচে ছিলাম
একে অপরের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী নিবিড়তায়।
পুনর্জন্ম
আমার অন্তর্আত্মা থেকে ভেসে আসছে একটি অস্পষ্ট বন্দনা
নিজের ভেতরই প্রতিস্থাপিত হচ্ছে নিজেরই আত্মা
হৃদয়ের অভ্যন্তরে সে বিস্ফোরিত হচ্ছে
আর আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ফুলশোভিত ভোরের দিকে
আত্ম বন্দনার এই পর্যায়ে
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলছি, আহ! কী অনাবিল শান্তি!
এই স্তবকে,
সে আমাকে বৃক্ষ, জল ও আগুনে রূপান্তর করলো
এটাই হয়তো জীবন
একটি প্রশস্ত রাস্তা মাড়িয়ে একজন মহিলা
প্রতিদিন ঝুড়ি বয়ে নিয়ে যায়
এটাই হয়তো জীবন
স্কুলফেরত বালকের মতো একজন ব্যক্তিকে
স্কুলব্যাগের মতো ঝুড়িতে বয়ে বেড়ায় সে,
জীবন হয়তো একটি ক্রমহ্রাসমান সিগারেটের আগুন
দুজন প্রেমিকের মাদকতাময় অনুভূতি
অথবা পথচারীর বিভ্রান্তিকর পথ।
সে তার মাথার টুপিটি ঠিক করছে
তারপর শুকনো হাসি দিয়ে পথচারিকে শুভসকাল বলছে
হয়তো জীবন সেই অবরুদ্ধ মুহূর্ত
যখন আমার প্রতিচ্ছবি তোমার চোখের মনিতে ভেসে ওঠে
আর আমি নিজেকে একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিই
এই ধ্বংসাত্মক অনুভূতিরও একটি সুখানুভব আছে
এর মধ্যে একটি বোধ খেলা করে
আমি নিজেকে সঁপে দেই স্নিগ্ধ চাঁদের বুকে
আঁধারকে কুর্নিশ করি
আমার একান্ত ঘরে খেলা করে নিঃসঙ্গতা
আমার হৃদয়
এক ভালোবাসার আকার
নিজের সুখগুলোকে সে উপভোগ করে,
ফুলের ঝুড়িতে শুকিয়ে যাচ্ছে ফুল বিবর্ণ সময়ের মতো
আমার ফুল বাগানে তোমার রপিত চারা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে উঠছে
জানালার রেলিং থেকে ভেসে আসে পাখিদের গান
আহ!
কী শান্তি!
অনাবিল শান্তি
আমার আত্মা স্বর্গসুখ অনুভব করছে
বন্ধ জানালার পর্দার ওপাশে বিস্তর আকাশ আমাকে কেড়ে নেয় সুদূরে
আমি পরিত্যক্ত সিঁড়ি বেয়ে পাতালে নামছি যেন
জীবন থেকে ক্ষয়ে পড়ছে সময় আর কিছু নষ্টালজিক অতীত
আমার স্মৃতির বাগানে তাদের উল্লাসহীন স্মিত পদচারণা
কোন এক দুঃখাক্রান্ত কণ্ঠ থেকে ভেসে আছে একটি কথা:
‘ভালোবাসি
তোমার নিটল হাত’
আমি ফুলের বিছানায় রোপন করবো তোমার স্পর্শে
আমি প্রস্ফুটিত হবো , হতে থাকবো, হতে থাকবো, আমি জানি
এই শান্তির নীড়ে চড়ুয়ের ডিম শোভা পাবে
আমার আঙ্গুলে শোভা পাবে তোমার উপহার
আমার কানে ঝুলবে একজোড়া চেরির দুল
আমার কান বৃত্তাকার হয়ে থাকবে
আমার নখে ঝড়ে পড়বে ডালিয়ার পাপড়ি
একটা গলি আছে
যেখানে ছেলেরা একসময় আমার প্রেমে পড়েছিল,
আমার খোলা চুল, সরু ঘাড় ও লম্বাটে পা তাদের আকর্ষিত করতো
এখনো সেই ছোট্ট মেয়েটির নিষ্পাপ হাসির কথা মনে পড়ে
একরাতে সে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল নিঃশব্দে
একটা নিরব শুনশান গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার শৈশব
যেন সে আমার ছেলেবেলা চুরি করে বসে আছে
এ পথের রেখা বরাবর পড়ে আছে বিবর্ণ সময়
আমার অনুর্বর কবিতাগুলো নিয়তই ফলবতী হচ্ছে
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার শোকার্ত আত্মা
তার ভেতরে বাজছে ভাঙনের গান
এটাই একমাত্র নিয়তি
কেউ চলে যায় অনন্তে
আর কেউ থেকে যায় অপেক্ষায়।
জেলে তার জাল থেকে মুক্তো ছাড়াচ্ছে
ছোট ছোট স্রোত আছড়ে পড়ছে তীরে
চিরদুঃখী জলকন্যার মতো
আমার সাগরে বসবাস
কেউ একজন মৃদু স্বরে
বাঁশের বাঁশিতে আলতো ফুঁ দিচ্ছে
যেন ও বাঁশির ভেতর আমারই হৃদয়
আমি একটি ছোট্ট দুঃখী মীনকন্যা
রাতের বুকে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
ভেসে বেড়াবো বাতাসের সাথে
ক্রমশ শেষ হচ্ছে এই স্বল্পকালীণ রাত
বাতাসে দুলে উঠছে গাছের পাতা
গাছের পাতায় লেখা আমার রাতের গল্প
যন্ত্রণার গল্প
শোন
তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বিদীর্ণ অন্ধকারের চিৎকার?
রাতের এই অচেনা উল্লাস দেখে আমি হতাশ হই
শোন তুমি কি আঁধারের আওয়াজ শুনতে পাও?
ক্রমশ রাত এগিয়ে যাচ্ছে
চাঁদ বেসামাল লাল হয়ে ঝুলে আছে আকাশে
এই ছাদের উপরে
যেখানে ভেঙে পড়ে একটি ধ্রুবক ভয়
মেঘ, শোকের মিছিলের মতো
বৃষ্টির মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে।
এক মুহূর্তেই
মিলিয়ে যাচ্ছে সব
জানালার ওপাশে উষ্ণতায় কাঁপছে রাত
পৃথিবীর বাতাস থমকে গেছে যেন
এই জানালার বাইরে
অচেনা কোন চোখ তোমাকে এবং আমাকে দেখছে।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবুজের ছড়াছড়ি
জ্বলন্ত স্মৃতির মতো তোমার হাত রাখো
আমার ভালোবাসার হাতে
তোমার ঠোঁট চুম্বন করুক
আমার প্রেমময় ঠোঁট,
কাছাকাছি থাকার উষ্ণ উপলব্ধির মতো
বাতাস আমাদের নিয়ে যাবে দূরে
বাতাস আমাদের নিয়ে যাবে অনন্তে।