
ইতিহাসের নতুন পাঠ নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট ১৯৪১) প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল পাঁচটি প্রবন্ধ। লিখেছেন- আনোয়ারুল করীম, মুনীর উদ্দীন শামীম, রকিবুল হাসান, স্বপন পাল ও বাসন্তি সাহা।
‘ন্যাশনালিজম’ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছেন, ‘Nationalism is sometimes apt to become a narrowing creed. Tagore helped, to some extent, to break these barriers.
‘Nationalism’ বইয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কীভাবে জাতীয়তাবাদ মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ পশ্চিমের হাতিয়ার, যা রাষ্ট্র তার স্বার্থে ব্যবহার করলে শান্তি বিনষ্ট হয়, হানাহানি সৃষ্টি হয়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও সভ্যতা পড়ে যায় সংকটে। রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতীয়তাবাদ আর স্বদেশপ্রেম ভিন্ন উপলব্ধি। ১৯২০ সালে ফ্রান্স থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেন,
‘আমি ভারতকে ভালোবাসি। সেই হিসেবে আমি প্যাট্রিয়ট। কিন্তু ভারতবর্ষ আমার কাছে একটি আদর্শ ও একটি ধারণামাত্র। ভৌগোলিক কোনো বিষয় নয়। সেই অর্থে আমি প্যাট্রিয়ট নই। সমস্ত বিশ্বমানব নিয়েই আমাদের পৃথিবী হতে হবে।’
তিনি একক নেশন বা জাতির ওপর আস্থা রাখেননি। সমাজে নানা রকম বিভক্তি বিদ্যমান থাকায় নেশন নির্মাণ সম্ভব নয়- এটাই ছিল তাঁর অনাস্থার মূল কারণ। ন্যাশনালিজমের নাম দিয়েছেন তিনি ‘জিওগ্রাফিক্যাল ডেমন’। প্রথমদিকে তাঁর ধারণা ছিল, ‘নেশন একটি মানস পদার্থ।’ কিন্তু পরে নেশনকে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে দেখেছেন, যা জনগণকে ‘যান্ত্রিক প্রয়োজনে’ সংঘবদ্ধ করে। তাঁর ব্যাখ্যা, ভারতবর্ষে ন্যাশনালিজম খাটবে না। কারণ, ইউরোপে শাসক-শোষিতের যে ভেদ ঘটেছিল, সেটা জাতিগত বিভেদ নয়; শ্রেণিগত ভেদ। কিন্তু ভারতবর্ষে ভেদ ধর্ম ও জাতির নামে; এর সাথে শ্রেণিগত ভেদ তো আছেই। তাঁর মতে, দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাতি গঠনের চেষ্টা এসব ভেদবুদ্ধিকে আরো বাড়িয়ে দেবে। অন্যকথায় বলতে গেলে, এভাবে কোন জাতি গঠন সম্ভব নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ‘নো-নেশনের’ একটা ধারণা বা কনসেপ্ট সামনে চলে আসে। তবে এখনকার নেশন-স্টেট বা জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাকে রবীন্দ্র্রনাথের দৃষ্টিতে দেখতে নারাজ অনেকেই। তাদের কথা, রবীন্দ্রনাথের ধারণা সেকেলে অর্থাৎ ‘অ-আধুনিক’। আবার কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে ‘উত্তর-আধুনিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারো কারো মতে, রবীন্দ্রনাথের নেশনবিরোধী সমালোচনায় ‘স্টেটবিরোধী’ মতাদর্শ থাকলেও সেখানে স্বদেশপ্রেমের জায়গা আছে, কিন্তু ন্যাশনালিজমের নেই। অভিযোগ আছে, রবীন্দ্রনাথ যতোটা কড়া ভাষায় ‘নেশনের’ সমালোচনা করেছেন, ততোটা ‘চড়াভাবে’ ‘নো-নেশনের’ ছবি আঁকেননি। তিনি ঐক্যের প্রয়োজনে ভারতবর্ষে এক-রাষ্ট্রীয় শাসনের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি নো-নেশন সমাজে জনগণের উদ্ভাবনী শক্তির ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, চীন, জাপান, ইরান, তুরস্ক প্রভৃতি এ ধরনের রাষ্ট্র। আমলাতন্ত্রেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় ‘যৌথতার নতুন নির্মাণের’ প্রশংসা করলেও মানব চরিত্রের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার রীতি তিনি মানতে চাননি। সেখানেও তিনি এক ধরণের আমলাতন্ত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করছেন। রবীন্দ্রনাথ সেই রাষ্ট্র বা ব্যবস্থাকে মানেননি, যে রাষ্ট্র বা ব্যবস্থা স্বৈরাচার। স্বৈরাচারী সমাজের বিরুদ্ধে তাঁর ধিক্কার ছিল স্পষ্ট। ব্রিটিশ যুগে রাষ্ট্র ছিল স্বৈরাচার। রবীন্দ্রনাথ তাই চেয়েছিলেন সমাজকে আলাদা করে নেবেন রাষ্ট্রের সর্বভুক ও বুভুক্ষুগ্রাস থেকে। কিন্তু চাইলেই তো আর সমাজকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে নেওয়া যায় না। যেখানে সারা পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রের আধিপত্য ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এটি বলাই যায় যে, রাষ্ট্রের ধর্মই ক্রমাগত স্বৈরাচার হওয়া। কার্ল মার্কসও বলেছেন, ‘রাষ্ট্র দমনের যন্ত্র’ তথা শোষণ-নিপীড়নের যন্ত্র। তাত্ত্বিক বিচারে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষের গণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধিকল্পে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সেগুলো বিকশিত হতে থাকবে। হ্যাঁ এটা ঠিক, ভারতবর্ষের ইতিহাসে সমাজই প্রধান; রাষ্ট্র নয়। এ কথা তিনি বারবার বলেছেন, খুব জোর দিয়েই বলেছেন।
এই জোর দিয়ে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নতুন ইতিহাস রচনা করেননি, ইতিহাসের নতুন পাঠ নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন। ইউরোপ রাষ্ট্রীয় ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়েছে সবসময়, পাশ্চাত্ত্যের ঐতিহাসিকেরা এটাকে মূল উপাদান বলে মনে করেছেন। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গুরুত্বহীনতায় তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সবসময় সামাজিক ইতিহাসকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই রাষ্ট্রসর্বস্ব ঐতিহাসিকদের মৃদু কটাক্ষ করে বলতে পেরেছেন—
‘ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় দফতর হইতে তাহার রাজবংশমালা ও জয়-পরাজয়ের কাগজপত্র না পাইলে যাহারা ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে হতাশ্বাস হইয়া পড়েন এবং বলেন যেখানে পলিটিকস নাই সেখানে আবার হিস্ট্রি কিসের, তাহারা ধানের খেতে বেগুন খুঁজিতে যান এবং না পাইলে মনের ক্ষোভে ধানকে শস্যের মধ্যেই গণ্য করেন না।’
সব ক্ষেতে এক জাতের ফসল যেমন ফলে না, তেমনি সব দেশের ইতিহাসের উপাদান একই হবে, সেটিও ঠিক নয়। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসের উপাদান সম্পর্কে বিরোধীদের সচেতন করার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ভারতীয় সভ্যতা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়, প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সংঘবদ্ধতার উপর। তাই সমাজকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেননি তিনি। ইউরোপের দেশগুলো নিজের নিজের স্বার্থে খুব সহজেই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ‘সেইখানে তাহারা একাগ্র, তাহারা প্রবল, তাহারা নিষ্ঠুর, সেইখানে আঘাত লাগিলেই সমস্ত দেশ একমূর্তি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান হয়।’ এইভাবে ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে থাকে এবং পর পর দু’টি মহাযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। তিনি মনে করেন, এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সৃষ্টিভূমি কখনোই ভারতবর্ষ নয়। ইতিহাসের প্রচলিত ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের ইতিহাস, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ, আমাদের গৃহ কিছুই নেশন গঠনের প্রাধান্য স্বীকার করে না।’
হিন্দু-মুসলমানের তীব্র ধর্মীয় বিরোধ তাঁকে ক্রমাগত পীড়িত করছিল। এ ক্ষেত্রে তিনি যথার্থ সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। সবাই যখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত, তখন সমাজের গভীরে চাপা ‘সোস্যাল টেনশনটি’ রবীন্দ্রনাথের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের ভেতরে থেকেই তিনি কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করছিলেন। বিভেদের আসল কারণটি রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরলেন তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে।
‘যে কারণেই হউক যেদিন স্বদেশী নিমকের প্রতি হঠাৎ আমাদের অত্যন্ত একটা টান হইয়াছিল সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রুগদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারি রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না।’
যে সত্যটি রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন, তা হল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা এবং মনুষ্যত্বকে বিনষ্ট হতে না দেওয়া। তিনি বলেছেন এর জন্য চাই, ‘মানুষের সঙ্গে মনুষ্যোচিত ব্যবহার’। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কার্জনের বঙ্গবিভাগের চেয়ে ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে দেশের মানুষের মধ্যে বিভাগ তৈরি আরো ক্ষতিকর। ইংরেজের দেশ বিভাগ না হয় আন্দোলন করে বন্ধ করা গেল, কিন্তু ক্রমশ নিজেদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভেদ বড় হয়ে উঠছিল, তা বন্ধ করাকেই রবীন্দ্রনাথের কাছে বড় কাজ মনে হয়েছে। কিন্তু ‘সেদিকে দৃষ্টি না করিয়া আমরা বয়কট-ব্যাপারটাকেই এত একমাত্র কর্তব্য বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলাম, যে-কোনো প্রকারেই হোক বয়কটকে জয়ী করিয়া তোলাতেই আমাদের সমস্ত জেদ এত বেশিমাত্রায় চড়িয়া গিয়াছিল যে, বঙ্গবিভাগের যে-পরিণাম আশঙ্কা করিয়া পার্টিশনকে আমরা বিভীষিকা বলিয়া জানিয়াছিলাম সেই পরিণামকেই অগ্রসর হইতে আমরা সহায়তা করিলাম।’ এ এক অমোঘ ভবিষ্যৎ বাণী। এই মন্তব্যের চল্লিশ বছরের মধ্যেই সংঘটিত হয়েছিল মর্মান্তিক দেশবিভাগ। আর মনে করা হয়, এই বিষবৃক্ষের বীজ পোঁতা হয়েছিল সেই স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকেই। তিনি ইতিহাসকে দুইভাগে ভাগ করে দেখতে চেয়েছিলেন। History of Ideas Ges History of Tact| তিনি নিজে ছিলেন প্রথম ধারার অনুগামী। History of Ideas বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন—
‘ইতিহাস কেবল জ্ঞানে নহে, কল্পনার দ্বারা গ্রহণ করিলে তবেই তাহাকে যথার্থভাবে পাওয়া যায়।’ প্রকৃতপক্ষে তাঁকে এই মডেলটি তৈরি করে নিতে হয়েছিল। কল্পনার দ্বারা ইতিহাসকে গ্রহণ করলে ইতিহাসের আসল যে রূপটি ধরা পড়বে, তা হল সমকালীন মানবমনের ইতিহাস, তাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ইতিহাস। বাস্তব তথ্য বা ‘সেরেস্তার নথি’ এ ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সবটা নয়। এর সঙ্গে কল্পনাকে মেলাতে হবে। ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরী সম্পর্কে কবি বলেছিলেন যে, এর ভৌগোলিক অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দেহ, কিন্তু ‘কবির জ্ঞান বিশ্বাস মতে এটি সম্পূর্ণ সত্য।’ এই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি প্রত্যক্ষ জগৎ তৈরি করেছিল, তার সঙ্গে কবি তাঁর বিশ্বাসকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, ‘বৃত্তান্ত ত চাকর, তাহার প্রভু আইডিয়া অর্থাৎ বুদ্ধিমূলক কল্পনা।’
সমাজতন্ত্রের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনন, চিন্তা ও সংস্কৃতির স্তরে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে নিয়ে যথার্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরীতে ক্রমাগত প্রণোদনা দেয়া। এটি হতে হবে সমাজের মধ্য থেকে গড়ে উঠা বিভিন্ন সংগঠনগুলোকে (সামাজিক, সাংস্কৃতিক) বিকশিত হওয়ার পরিবেশ দেয়ার মাধ্যমে। একসময় ভারত উপ-মহাদেশে সমাজেরই প্রাধান্য ছিল। রাষ্ট্রের উপস্থিতি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষেরা কমই টের পেত। রবীন্দ্র্রনাথের অনেক লেখায় তেমন সমাজের পরিচয় আমরা পাই। যদিও সেই সমাজে শোষণের ব্যাপারটি অনুপস্থিত ছিল না, সেই সমাজ সমাজতান্ত্রিক বিচারে গ্রহণযোগ্য ছিল না, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে সেই সমাজের উপস্থিতি ছিল প্রবল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালান্তর গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত’ প্রবন্ধে লিখেন,
‘চিরদিন ভারতবর্ষ এবং চীনদেশে সমাজতন্ত্রই প্রবল, রাষ্ট্রতন্ত্র তার নিচে। দেশ যথার্থভাবে আত্মরক্ষা করে এসেছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে। সমাজই বিদ্যার ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছে, ক্ষুধিতকে অন্ন দিয়েছে, পূজার্থীকে মন্দির, অপরাধীকে দণ্ড, শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা,—গ্রামে গ্রামে দেশের চরিত্রকে রক্ষিত এবং তার শ্রীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশের ওপর দিয়ে রাজ্য-সাম্রাজ্যের পরিবর্তন হয়ে গেল, স্বদেশী রাজার রাজায় নিয়তই রাজত্ব নিয়ে হাত-ফেরাফেরি চলল, বিদেশী রাজারা এসে সিংহাসন-কাড়াকাড়ি করতে লাগল, লুটপাট অত্যাচারও কম হলো না, কিন্তু তবু দেশের আত্মরক্ষা হয়েছে-যেহেতু সে আপন কাজ আপনি করেছে—তার অন্নবস্ত্র ধর্মকর্ম সমস্তই তার আপনারই হাতে।’
সেই সমাজকেই আরো শক্তিশালী করার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ‘জাতি’ শব্দের চেয়ে ‘দেশ’ শব্দটি বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর কাছে ‘জাতি’ হচ্ছে ইংরেজি Nation-এর বাংলা অনুবাদ। ১৮৮৩ সালে যখন নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছিল ‘ন্যাশনাল’ সাইনবোর্ড ধারণ করে, রবীন্দ্রনাথ তখন ‘জিজ্ঞাসা ও উত্তর’ প্রবন্ধে লিখলেন: ‘জাতীয় তহবিল বা জাতীয় ভাণ্ডার (ন্যাশনাল ফান্ড) নাম করে যখন মুসলমানদিগের নিকট হইতেও টাকা লওয়া হইতেছে, তখন উক্ত ভাণ্ডারকে জাতীয় কিরূপে বলা যায়?’ জাতি বলতে তখন হিন্দুর জাতীয়তাকেই বোঝানো হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই সব কর্মকাণ্ডের ভেতর ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয়। তিনি ওই সমস্ত উদ্যোগকে জাতীয় না বলে দেশীয় বলা শ্রেয় মনে করতেন। শব্দটি দেশীয় হবে আবার অসাম্প্রদায়িকও হবে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমাগত এক ধরণের ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের’ দিকেই ধাবিত হচ্ছিল বলে অন্য আরো কিছু কারণের সাথে এটিকেও আন্দোলনের হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ‘নব্যবঙ্গের আন্দোলনে’ লিখেছেন—
“শ্রীযুক্ত বাবু কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার ‘গীতসূত্রসার’ নামক অতি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের এক স্থলে লিখিয়াছেন, ‘ভারতীয় লোকের প্রাচীন বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আদর আছে বটে। কিন্তু তাহা ইতিহাস- প্রিয়তাজনিত নহে, তাহা আলস্য ও নিশ্চেষ্টতার ফল।’ এ কথা আমার সত্য বলিয়া বোধ হয়। মনে আছে বাল্যকালে যখন ন্যাশনাল ছিলাম তখন অর্ধশ্রুত ইতিহাসের অনতিস্ফুট আলোকে অহরহ প্রাচীন আর্যকীর্তি সম্বন্ধে জাগ্রতস্বপ্ন দেখিয়া চরম আনন্দ লাভ করিতাম। ইংরাজের উপর তখন আমাদের কী আক্রোশই ছিল! তাহার কারণ আছে। যখন কাহারো মনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, তিনি তাঁহার প্রতিবেশীর সমকক্ষ সমযোগ্য লোক, অথচ কাজকর্মে কিছুতেই তাহার প্রমাণ হইতেছে না, তখন উক্ত প্রতিবেশীর বাপান্ত না করিলে তাঁহার মন শান্তিলাভ করে না। আমরা ন্যাশনাল অবস্থায় ঘরে বসিয়া এবং সভায় দাঁড়াইয়া নিষ্ফল আক্রোশে ইংরাজ জাতির বাপান্ত করিতাম; বলিতাম, আমাদের পূর্বপুরুষ যখন ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করিতেছেন তখন ইংরাজের পূর্বপুরুষ গায়ে রঙ মাখিয়া কাঁচা মাংস খাইয়া বনে বনে নেকড়িয়া বাঘের সহিত লড়াই করিয়া বেড়াইতেছে। আবার বিদ্রূপ করিয়া এমনও বলিতাম—ডারুয়িন ইংরাজ তাই আদিম পূর্বপুরুষদিগকে বানর বলিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইংরাজের লালমূর্তি ও কদলীপ্রিয়তার উল্লেখপূর্বক চতুর্ভুজ জাতীয় রক্তমুখচ্ছবি জীবের সহিত তুলনা করিয়া ন্যাশনাল পাঠকদিগের মনে সবিশেষ কৌতুক উদ্দীপন করিতাম। ইংরাজি বই পড়িতাম, ইংরাজি কাগজ লিখিতাম, ইংরাজি খাদ্য একটু বিশেষ ভালোবাসিতাম, ইংরাজি জিনিসপত্র বিশেষ আদরের সহিত ব্যবহার করিতাম, মূর্তিমান ইংরাজ দেখিলে মনে বিশেষ সম্ভ্রমের উদয় হইত, অথচ তাহাতে করিয়া ইংরাজের প্রতি রাগ বাড়িত বৈ কমিত না। দেশে ডাকাতি হয় না বলিয়া আক্ষেপ করিতাম, বলিতাম, অতিশাসনে দেশ হীনবীর্য হইয়া পড়িল, আবার গ্রামের কাছাকাছি ডাকাতির সংবাদ পাইলে ইংরাজ শাসনের শৈথিল্যের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট হইত।”
রবীন্দ্রনাথের কথায়-
‘আমার দেশ আছে, এই অস্তিকতার একটি সাধনা আছে। দেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই দেশ আমার, এ হচ্ছে সেই-সব প্রাণীর কথা যারা বিশ্বের বাহ্য ব্যাপার সম্বন্ধে পরাসক্ত। কিন্তু, যেহেতু মানুষের যথার্থ স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মশক্তিসম্পন্ন অন্তরপ্রকৃতিতে, এইজন্যে যে দেশকে মানুষ আপনার জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রেমে কর্মে সৃষ্টি করে তোলে সেই দেশই তার স্বদেশ। ১৯০৫ খৃস্টাব্দে আমি বাঙালিকে ডেকে এই কথা বলেছিলেম যে, আত্মশক্তির দ্বারা ভিতরের দিক থেকে দেশকে সৃষ্টি করো, কারণ সৃষ্টির দ্বারাই উপলব্ধি সত্য হয়।’
এ কথা তো চিরকালীন কথা। আজো দেশকে নিয়ে এমন করে ক’জন ভাবে! আমাদের দেশের কথাই যদি বলি স্বাধীনতা লাভের প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো, তবুও এই যে ভেতর থেকে গড়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভাবাটা সেইভাবে এখনো হয় না।
‘নেশন’কে কিছুটা মানতে পারলেও ‘ন্যাশনালিজম’কে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯১৬ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান ও আমেরিকায় ন্যাশনালিজমের ওপর বক্তৃতা করেন। এই ন্যাশনালিজম তাঁর মতে, বিশ্বের জন্য ভয়াবহ বিপদ এবং এর পেছনে চালিকাশক্তি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও লুণ্ঠনের অতি উগ্র বাসনা।
রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য বক্তৃতায় ধর্ম, জাতি, সমাজ, শিক্ষা, স্বদেশ, মুক্তি, সভ্যতা— নানা বিষয়ে তাঁর দর্শন ব্যক্ত করেছেন। ১৯১৭ সালে জাতীয়তাবাদের ওপর একটি ইংরেজি বক্তৃতায় রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর অনুধাবন এই উপমায় বুঝিয়েছেন: রাষ্ট্রের কাজ ডিমের খোসার মতো। এই ডিম ও খোসার উপযোগিতা একেকজনের কাছে একেক রকম। ডিমের খোসাটি ডিমের ভেতরে থাকা ছানাটিকে নিরাপত্তা দেয়। আর সকালের প্রাতরাশকারীর কাছে এই খোসার কোনো মূল্য নেই। পরাধীন ভারতবর্ষে যে রাষ্ট্রকে রবীন্দ্রনাথ নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জেনেছেন, সেটি প্রাতরাশকারীর কাজে লেগেছে, ডিমের ভেতরে ছানার কোনো উপকার করেনি। এ রাষ্ট্র ছিল নির্মম, ভয়াবহ, যে বোতল দিয়ে সে দুধ খাওয়াত শিশুকে, অর্থাৎ দিত শিক্ষা, সেটা গিয়েছিল শুকিয়ে; কিন্তু স্ফীত হয়ে উঠছিল সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, সিআইডি ও টিকটিকি। এ রাষ্ট্রকে রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত সমাজের প্রতি। ব্রিটিশ-ভারতের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে দেখেছিলেন ইংরেজদের। আর সমাজ ভারতবাসীর। তৎকালীন রাজনৈতিক দল কর্তৃক ইংরেজদের প্রতি আবেদন-নিবেদনকে রবীন্দ্রনাথ কখনো সমর্থন করেননি। এর মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তি কখনো সম্ভব নয়, এ কথা বলেছেন বহুবার।
ন্যাশনল ফন্ড প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন,
‘যে-সকল দেশহিতৈষীদিগের Political agitation একমাত্র ব্যবসায় তাহাদের উপর আমার বড়ো শ্রদ্ধা নাই। আমাদের দেশে Political agitation করার নাম ভিক্ষাবৃত্তি করা। যে নিতান্তই দরিদ্র সময়ে সময়ে তাহাকে ভিক্ষা করিতেই হয়, উপায় নাই, কিন্তু ভিক্ষাই যে একমাত্র উন্নতির উপায় স্থির করিয়াছে, তাহার প্রতি কাহারও ভক্তি থাকিতে পারে না। ভিক্ষুক মানুষেরও মঙ্গল নাই, ভিক্ষুক জাতিরও মঙ্গল নাই, ক্রমশই তাহাকে হীন হইতে হয়। ইতিহাস ভুল বুঝিয়া আমাদের এই-সকল বিড়ম্বনা ঘটিয়াছে। আমরা ভুলিয়া গিয়াছি যে স্বাধীন দেশে Political agitation-এর অর্থ, আর পরাধীন দেশে উহার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অর্থ। সে দেশে Political agitation-এর অর্থ নিজের কাজ নিজে করা, আর এ দেশে Political agitation-এর অর্থ নিজের কাজ পরকে দিয়া করানো। কাজেই ইহার ফল উভয় দেশে এক প্রকারের নহে’।
ইংরাজদের কাছে ভিক্ষা করিয়া আমরা আর সব পাইতে পারি, কিন্তু আত্মনির্ভর পাইতে পারি না। আর, তাহাই যদি না পাই, তবে আসল জিনিসটাই পাইলাম না। কারণ, ভিক্ষার ফল অস্থায়ী, আত্মনির্ভরের ফল স্থায়ী। আমাদের সমস্ত জাতির যদি এই একমাত্র কাজ হয়, ইংরাজদের কাছে আবদার করা, ইংরাজদের কাছে ভিক্ষা করা, তাহা হইলে প্রত্যহ আমাদের জাতির জাতিত্ব নষ্ট হইতে থাকিবে, ক্রমশই আমাদের আত্মত্ব বিসর্জন দিতে হইবে। তাহা হইলে আমরা শুভ্র ইংলন্ডের গায়ে একটা কালো পোকার মতো লাগিয়া থাকিব ও ইংরাজের গায়ের রক্ত শোষণ করিয়া আবশ্যকের অভাবে আমাদের পাকযন্ত্র অদৃশ্য হইয়া যাইবে! এইজন্যই কি ন্যাশনল ফন্ড?’
সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমের বিষয়টি এমন করেই ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ।
এটা আগেই উল্লেখ করেছি যে, অনেকেই মনে করতেন নেশন না হতে পারার অস্বীকৃতির মধ্যে এক ধরনের অপমানবোধ লুকিয়ে ছিলো। যেন জগতের চোখে আমরা বর্বর হয়ে গিয়েছি। নেশনের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়, এটাই ছিলো নেশন হতে চাওয়ার মূল কারণ। তাই এত পতন স্খলনের পরও এই আত্মসম্মানের প্রয়োজনেই একবিংশ শতাদ্বীতে নেশনের ভাবনা টিকে রয়েছে— এরকম ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। স্বদেশী সমাজ পর্বের লেখায় রবীন্দ্রনাথও অনেকটা এমন বলার চেষ্টা করেছেন যে আত্মসম্মানের স্বীকৃতির জন্যই নেশনকে গড়ে তোলা দরকার। ফরাসী মনীষী রেঁনার ছক ধরে বোঝার চেষ্টা করেছেন ইউরোপ যে প্রয়োজনে নেশন হয়েছে সেভাবে আমরাও নেশন হতে পারি, তবে ভিন্ন ধারায়। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের ভিত্তিতে এক মহাজাতি নির্মাণের প্রস্তাব ছিল তার। এজন্য তিনি স্বদেশী সমাজের সংবিধানও রচনা করেছিলেন। এই ছিলো রবীন্দ্রনাথের নেশন ভাবনার গোড়ার পর্ব। কালের হিসাবে এ পর্বের শুরু বিবিধ প্রবন্ধ দিয়ে এবং এর শেষ হয় ১৯১০ সালে ‘গোরা’ উপন্যাস প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। জমিদার বনাম কৃষক, হিন্দু বনাম মুসলমান, ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্র সমাজ বনাম নিরক্ষর লোকসাধারণ, এই ত্রিবিধ সামাজিক বিভক্তিকে জিইয়ে রেখে উপর থেকে নেশনের রাজনৈতিক ঐক্য, নেশন নির্মাণ সম্ভব নয়, এটাই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। সামাজিক বিভাজন, নেশনের মানসিক ঐক্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার বিশিষ্টতা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। সামাজিক এ বিভাজন শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত হয়নি। এর মধ্যে জড়িয়ে আছে সম্প্রদায়গত অবহেলা। যে কারণে তিনি বহুবার লিখেছেন, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিবেশীসুলভ মনুষ্যচিত সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা পায়নি। এ নিয়ে দুয়ের মধ্যে অনেকদিন থেকেই ‘একটা পাপ চলিয়া আসিতেছে’ এবং এটা ধর্মবিহিত নয়। আবার একই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের সামাজিক ব্যবধান এতটাই যে ‘এক দেশে থাকিলেও’ এক দেশে নাই। এমন অবস্থায় শিক্ষিতরা যদি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনে অশিক্ষিতের দ্বারস্থ হয়, তবে তারা বলাবলি করতে শুরু করে ‘বাবুরা বোধকরি বিপদে পড়িয়াছে’, নইলে তাঁদের শহর ছেড়ে এই গাঁওগেরামে আসার কথা নয়। কিন্তু এখানেও রবীন্দ্রনাথ তার রাষ্ট্রনৈতিক মতের আলোচনায় শুরুর দিকে জাতীয়তাবাদ শব্দটি ব্যবহার করেননি। চিরকাল তিনি ইংরেজি ‘নেশন’ ও ‘ন্যাশনালিজমই’ ব্যবহার করেছেন। এর বাংলা যে তিনি জানতেন না, তা নয়। এটা তিনি করেছিলেন সচেতনভাবেই। আর এটা তিনি স্পষ্ট করেছেন ‘নেশন কি’ প্রবন্ধে।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন ‘নেশন’ শব্দটা না হওয়াই উচিত। লক্ষ্যনীয় যে, তিনি ইংরেজের কাছ থেকে প্রাপ্ত ভাবের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না। বরং তার প্রয়োগসম্ভাব্যতা নিয়ে তিনি বেশি চিন্তিত। তাদের নেশনের বিপরীতে আমাদের নেশন কিভাবে গড়ে উঠতে পারে এ নিয়ে তিনি নানারকমের পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে। তবে এটাও তিনি বলেছেন, ‘নেশনই যে সভ্যতার অভিব্যক্তি, তাহার চরম পরীক্ষা হয় নাই।’ অন্তত ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার আলোকে তার মনে হয়েছে নেশনের ‘চরিত্র আদর্শ উচ্চতম নহে। তাহা অন্যায়, অবিচার ও মিথ্যার দ্বারা আকীর্ণ ও তাহার মজ্জার মধ্যে একটি ভীষণ নিষ্ঠুরতা আছে।’ কিন্তু প্রাচ্যসভ্যতার নেশন অন্যরকম পথের সন্ধ্যান দিতে পারে, তখনও রবীন্দ্রনাথ মনে হয় এমন আশা করেছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ ত্রিশ বছরে তার এ দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটাই বদলে যায়।
এর পরবর্তী পর্যায়ে নেশন ভাবটিকেই তিনি প্রশ্ন করতে শুরু করেন। নেশন নির্মাণ করতে গিয়ে তার মনে হতে থাকে, এ তো দেবতার নয়, অপদেবতার পূজা করা হচ্ছে। ইংরেজিতে চিহ্নিত করেছে জিওগ্র্যাফিক্যাল ডেমন বা ভৌগলিক অপদেবতা বলে, যার বেদীতে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই অপদেবতা কেবল নিজেদের মধ্যে মহাযুদ্ধই বাধায়নি, পরাধীন ভারতবর্ষও সৃষ্টি করেছে কংগ্রেস-মুসলিম লীগে, হিন্দু-মুসলমানে, উচ্চবর্ণে-নিন্মবর্ণে বিভক্তি। রবীন্দ্রনাথ ১৯১০ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রচনাগুলোতে নেশনের ভেতরের এই বিভক্তিকে নানাভাবে দেখিয়েছেন। কখনো ন্যাশনালিজম প্রবন্ধগুচ্ছে, কখনো ‘গোরা’ বা ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে, কখনো ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’ বা ‘মুক্তধারা’ নাটকে। কালান্তরে সংগৃহীত এ পর্বের বেশ কিছু প্রবন্ধ এই বিভক্তিরেখার সাক্ষী।
লেখাটি শুরু করেছিলাম জওহরলাল নেহেরু’র কথা দিয়ে, শেষদিকে এসেও তাঁর কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে চাই।
১৯৩২ সালের ১৪ ডিসেম্বর কারাগারে বন্দি অবস্থায় কন্যা ইন্দিরাকে নেহেরু লিখেছেন, ‘জাতীয়তাবাদ হয়তো কখনও ভাল, কিন্তু বন্ধু হিসাবে খুব একটা বিশ্বস্ত নয়, ইতিহাস সম্বন্ধে জাতীয়তাবাদ আমাদের অনেক সময় অন্ধ করে রাখে, সত্যকে বিকৃত করে।’
১৯৫৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে লিখছেন, ‘উগ্র জাতীয়তাবাদের একটি বিপজ্জনক দিক হল, সংখ্যাগুরুরা মনে করে তারাই সমগ্র জাতি এবং সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তার মধ্যে গ্রাস করে নিতে চায়।’
শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে ১৯৬১ সালে নেহরু বলেছিলেন, ‘আমাদের শিখতে হবে উদ্ধত জাতীয়তাবাদ থেকে কী ভাবে আমাদের মুক্ত করা যায়।’
রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের এই নতুন পাঠ নির্মাণেরই একটা বড় প্রয়াস চালিয়েছেন তাঁর নানাবিধ রচনা ও বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে, যা এখনো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।