
আহমদ ছফার সাধনা এবং বাংলাদেশের নষ্ট ‘বুদ্ধিজীবী’ সম্প্রদায়
বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।
—(আহমদ ছফা)
আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে হাড়ে হাড়ে চিনেছেন। শ্রেণীগতভাবে বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় থেকে আগত ‘শিক্ষিত’ গণবিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী। ফরাসী দেশে আঁতেল শব্দটি যেমন বুদ্ধিজীবী অর্থে ব্যবহৃত হয়। আমরা আঁতেল বলতে বিশেষ এক গোষ্ঠীকে বুঝে থাকি এবং এই শব্দটি ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত হয়। যে কারণে ‘অতি-পন্ডিতি’ বা ‘উপর-চালাক’ ব্যক্তিদের আচরণকেও আমরা অনেকে ‘আতলামি’ বলে থাকি। দেশে দেশে অনেক শব্দের অর্থ যেমন পাল্টে যায়, আমাদের এখানেও ‘আঁতেল’ বা ‘বুদ্ধিজীবী’র শব্দের অর্থও তার একটি বঙ্গীয় অর্থ ধারণ করেছে।
আমরা গতানুগতিক ধারার বুদ্ধিজীবীদের, যা আহমদ ছফা চিহ্নিত করেছিলেন তার মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক সকলেই এই অর্থে বুদ্ধিজীবী। আমরা দেখবো, আহমদ ছফা তাঁর ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থে এদের কথাই বলেছেন যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা যে চিন্তা বা ভূমিকা নিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের মানুষ শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীনই হতো না। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীরা বিভ্রান্ত ছিলেন স্বাধীনতার প্রশ্নে। দ্বিতীয়ত এখনো যদি আমরা এই বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনি বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী বলতে সমাজ বা মিডিয়া যাদের চিহ্নিত করছে, তাদের কথা শুনলে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা কখনোই আমূল পরিবর্তন হবে না। এবার আহমদ ছফার এই গুরুত্বপূর্ণ উক্তির সত্যতা কতোটুকু যাচাই করা যাক।
আহমদ ছফা তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন, ’স্বাধীনতার শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা একজোট হয়ে শেখ মুজিবের অগণতান্ত্রিক একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে যদি রুখে দাঁড়াতেন তাহলে আমাদের জাতিকে এতোটা পথ পশ্চাত প্রত্যাবর্তন করতে হতো না। যে কোনো দেশের বুদ্ধিজীবীরা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অসম্মত হন সেই দেশটির দুর্দশার অন্ত থাকে না। বাংলাদেশ সেই রকম দুর্দশাগ্রস্থ একটি দেশ। এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উদ্যোগ, কোনো প্রয়াস কোথাও পরিদৃশ্যমান নয়।’ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে এর থেকে স্পষ্ট বক্তব্য আর কী হতে পারে?
আহমদ ছফা যথার্থভাবে বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশের লুন্ঠনের অর্থনীতির বিকাশের মধ্যেই। তিনি ঐ একই গ্রন্থের ভূমিকাতে এই দেশের লুটেরা পুঁজিপতিদের উত্থান প্রসঙ্গে লিখছেন ’শেখ মুজিবের রাজত্বকালে এই কোটিপতিদের জন্ম। জিয়াউর রহমান তাঁদের লালন করেছেন এবং বাড়িয়ে তুলেছেন। এরশাদ সমাজ জীবনে তাঁদের আইনগত বৈধতা দিয়েছেন। হাল আমল পর্যন্ত এসে তাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রটা তাঁদের কব্জার মধ্যে এনে ফেলেছেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া কোনো সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। তাঁদের সক্রিয় মদদ ছাড়া কোনো দল সরকার গঠন করতে পারে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছোটোখাটো দলের সভা কিংবা শোভাযাত্রার জন্য তাঁদের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হয়।’ ছফার এই বিশ্লেষণ বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য ভাষণ।
জল উপর থেকে নিচের দিকেই গড়ায়। বাংলাদেশের সমাজে আজ যে ভয়াবহ অসুস্থতা ও বিকারগ্রস্থতা সর্বত্র বিরাজমান, তার উৎস কিন্তু উপরে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন, তাদের তাবেদার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মাধ্যমেই নিচের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে নষ্ট সংস্কৃতি। এই দেশের ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সকল পেশাজীবী শ্রেণীর আজকের সংস্কৃতির পেছনে এই লুটেরা অর্থনীতি ও তার ঘনীভূত প্রকাশ রাজনীতির মধ্যেই নিহিত। আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানের চিন্তার দৈনতা এবং পশ্চাতপদতা সম্পর্কে লিখেছেন অসাধারণ এক পর্যবেক্ষণমূলক প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। যদিও এখানে একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে, বাঙালি মুসলমানের পশ্চাতপদতার কারণসমূহ চিহ্নিত করেছেন তিনি। কিন্তু সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমরা বলবো, সকল বাঙালির দৈনতার পেছনের কারণগুলো কিন্তু প্রায় একই। যদিও বাঙালি মুসলমানের পিছিয়ে থাকার বিশেষ কিছু কারণ যথার্থই চিহ্নিত করেছেন আহমদ ছফা। এই প্রবন্ধটি নিয়েই দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
ছফার বহুল পঠিত একটি ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস ‘গাভী বৃত্তান্ত’। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নোংরা দলীয় রাজনীতি, চাটুকারিতা এবং সর্বোচ্চ পদাধিকারী উপাচার্যের যে নষ্টামির চিত্র এঁকেছেন, সেখানে আসলে তিনি শিক্ষা ও জ্ঞানালোক থেকে শত-সহস্র মাইল দূরে থাকা ভ্রষ্ট শিক্ষকদেরই চরিত্রই চিত্রন করেন। আহমদ ছফা যে সময়ে ‘গাভী বৃত্তান্ত’ লিখেছেন এবং তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে যেখাবে চিত্রিত করেছেন, বর্তমান সময়ে এর আরো ভয়ংকর ও নিকৃষ্টরূপে অবনমন ঘটেছে। এখন নতুনরূপে একটি ‘গাভী বৃত্তান্ত’ লেখার সময় এসেছে। ‘গাভী বৃত্তান্ত’ উপন্যাসে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে চিহ্নিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধঃপতনের চিত্র এর থেকে চমৎকারভাবে বাঙলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে লিখিত হয়নি।
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সম্পর্কে আহমদ ছফার প্রকাশিত সকল সাক্ষাৎকার এক অনন্য সাধারণ সম্পদ। ছফা একটি সাক্ষাৎকারে সৈয়দ শামসুল হক ও হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে বলছেন, এঁদের একজনের প্রতারণা হচ্ছে ‘শিশ্নে’, আরেকজনের ‘মস্তিস্কে’। এককথায় বাংলাদেশের সাহিত্য জগত সম্পর্কে এই রূপকধর্মী ইঙ্গিতে অনেক কথা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশের সাহিত্য বিশেষত কথাসাহিত্য চর্চা এবং পাঠকের পাঠ প্রবণতায় ব্যতিক্রম বাদে এই দুই জনের বলয় ও অনুকরণের মধ্যেই এখন পর্যন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে হয়। এঁদের ‘বলয়’ থেকে কথাসাহিত্যকে মুক্ত না করলে বাংলাদেশের সাহিত্য অগ্রসর হতে পারবে না।
আহমদ ছফা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এর সাথে তুলনীয় সাক্ষাৎকার বাংলা ভাষায় খুব বেশি নেই। দুইজন চিন্তকের কথোপথনে উঠে এসেছে এদেশের ঐতিহাসিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ধারাক্রম এবং এই অঞ্চলের সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-ভাবনা ও কাজের ভূমিকা। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থশাস্ত্র, দর্শন, বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো ইত্যাদি এমন কোনো বিষয় নেই যে গুরু-শিষ্যের এই আলাপচারিতায় উঠে আসেনি।
আহমদ ছফা সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে আত্মত্যাগী ও সততার সাথে সৃজনশীলতার চর্চা যাঁরা করেছেন, তাদেরকে অত্যন্ত উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন। দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে এনেছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর সামনে। তিনি চিত্রশিল্পী সুলতানকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ‘বাঙলার শিল্প ঐতিহ্য : সুলতানের চিত্রসাধনা’ প্রবন্ধে। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দ্বান্দ্বিক মূল্যায়ন করেন ‘শত বছরের ফেরারী’ প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও শিল্পসাধনার স্বরূপ উন্মোচন করেন ‘সংস্কৃতি সাধন’ নামক ছোট্ট প্রবন্ধে। বাট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন ‘বাট্রান্ড রাসেল’ প্রবন্ধে। আহমদ ছফার সকল প্রবন্ধের দিকে দৃষ্টিপাত দিলে লক্ষ্য করা যায় যে, তিনি তুলে আনতে সক্রিয় বাঙলা বা বিশ্বসাহিত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক সকল ইতিবাচক সম্পদকে। একই সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের নামে নষ্ট আবর্জনাকে নির্ধিদ্বায় ছুড়ে ফেলতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আহমদ ছফা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি।’ আহমদ ছফা বিশ্বসাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ গ্যাটের মহাকাব্য ‘ফাউস্ট’ অনুবাদ করেছেন বহু বছরের নিরলস পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে। তিনি ‘তানিয়া’ অনুবাদ করেছেন। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন। অপরদিকে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে উপজীব্য করে লিখছেন অসাধারণ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ-পুরাণ’ এর মতো উপন্যাস। ছোট্ট অথচ দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ সৃষ্টি হয়েছে ছফার হাতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘অলাতচক্র’ উপন্যাস লিখছেন যেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলী, দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং প্রেম উপজীব্য হয়ে উঠে। একজন ‘বিশাল’ নেতার উত্থান-পতন নিয়ে লিখেন ‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’ উপন্যাস। এক মন্ত্রীর নষ্টামি, ভন্ডামি যা মন্ত্রিরই স্মৃতিচারণায় উঠে আসে ‘মরণ বিলাস’ নামক উপন্যাসে। আহমদ ছফার প্রত্যেকটি লেখাই একদিকে তাঁর চিন্তার দায়বদ্ধতার সৃষ্টিশীল প্রকাশ, অপরদিকে সমাজের নষ্টামি, ভন্ডামির মুখোশ উন্মোচন করে সুচারু ও দুঃসাহসের সাথে। আহমদ ছফা’র সকল সৃষ্টিকর্মে কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে একই সাথে দ্রোহ ও শিল্পের মিলিত প্রয়াস অসাধারণ বাঙ্ময় হয়ে উঠে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ, মাত্র ২১ বছর বয়সে লেখা উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটির ভিন্নধর্মী বক্তব্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য আখ্যান বলা যেতে পারে। আহমদ ছফার বিচিত্র প্রেম ও তার বহু বর্ণিল মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন ‘অর্ধেক নারী, অর্ধেক ইশ্বরী’ উপন্যাসে। পরিপূর্ণভাবে একজন লেখককে আবিষ্কার করতে হলে তার সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের সাথে অবগত হওয়া জরুরী। এই প্রবন্ধটিতে আলোচ্য লেখকের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে কিছুটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। আহমদ ছফাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর রচনাবলীর দ্বারস্থ হওয়ার বিকল্প নেই। আহমদ ছফা’র ভ্রাতুষ্পুত্র লেখক নূরুল আনোয়ার আহমদ ছফার বিচিত্র জীবন নিয়ে লিখেছেন ’ছফামৃত’। ছফার জন্ম, বেড়ে উঠা, শৈশব, কৈশর, তারুণ্য, প্রেম, ভালোবাসা, রাজনৈতিক চিন্তা, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি গ্রন্থ এটি।
আমার একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা। অনেকেই জানেন, আহমদ ছফা অত্যন্ত পরোপকারী একজন ব্যক্তি ছিলেন। শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁর অতি পরিচিত, স্বল্প পরিচিত এমনকি অপরিচিত কেউ যদি সহযোগিতার জন্য যেতো তিনি তাঁর সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে টাকা-পয়সা, চাকুরীর ক্ষেত্রে সুপারিশ, বই প্রকাশ করাসহ নানা বিষয়ে সাধ্যমতো সহযোগিত করতেন। নব্বই দশেকর মাঝামাঝি আমাদের ছাত্রাবস্থায় একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ করতাম। উন্মুক্ত স্থানে অধ্যয়নচক্র এবং সেখানেই লেখা বাছাই বা সম্পাদনারও কাজ চলতো। একদিন আমাদের এক বন্ধু বলে, ছফা ভাই’র কাছে গিয়ে দেখতে পারি, তিনি হয়তো বসার একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। আমরা সত্যি সত্যি একদিন আজিজ সুপার মার্কেটে দোতলার মাঝের সিড়ির সাথে তাঁর ‘উত্থানপর্বে’র অফিসে উপস্থিত হই। পরিচয় দিয়ে জানাই আমাদের ‘আবদারে’র কথা। সব শুনে তিনি আমাদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাচ্চাদের স্কুলে, শিল্পী সুলতান পাঠশালায়, যেটি আজিজ সুপার মার্কেটেরই তিন তলায় ছিলো, আমাদের সাপ্তাহে ৩দিন ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে দেন। সেদিন আমরা ভেবেছি, আহমদ ছফার মতো লেখক ও সংগঠকের জন্য এটা একটা দায়িত্ব বটে এবং এটা তাঁর পালন করারই কথা। আজ এতো বছর পর আশেপাশের নষ্টভ্রষ্ট, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ছফা আসলে কতো বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন! এখন এই সময়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা দূরে থাক, বিপদ-আপদেও আত্মরতিতে ভোগা বর্তমান সময়ের কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাবে কীনা, এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমরা আহমদ ছফার মতো মানুষের শূণ্যতা বড়ো বেশি অনুভব করি এই বন্ধ্যা সময়ে।
আমহদ ছফা চর্চায় অনেকে অতি আবেগ এবং অতি উৎসাহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মাঝে মাঝে। কেউ কেউ আহমদ ছফার একমাত্র ‘উত্তরাধীকারী’ সেজে আহমদ ছফাকে অতি মূল্যায়নের মাধমে তাকে বৃক্ষের মগডালে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তাঁকে এভাবে মগডালে বসিয়ে ‘ভূত’ বানানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ‘আগুন’ হয়ে ‘ভূত’ সৃষ্টিকারী গুণীনদের তাড়িয়ে দিতেন। সত্যিকার অর্থে রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে তিনি মাঝে মাঝে ‘আগুন’ হয়ে যেতেন। আসলে আহমদ ছফা একেবারে মাটির সাথে সম্পৃক্ত একজন লেখক ও মনীষী। আহমদ ছফার সকল লেখালেখি, শিল্প-সাধনা এই মাটি ও মাটি সংলগ্ন মানুষদের নিয়ে। আহমদ ছফা আমাদের বাঙলাদেশের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা থেকে মুক্তি এবং সমাজ ব্যবস্থার সার্বিক মুক্তির জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
হাতে গোনা দু’একজন ব্যক্তি ছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত নষ্টামি, রাষ্ট্র ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও’র দালালি এবং সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে, এদের কাছে প্রত্যাশার আর কিছু নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা দেখছি বাংলাদেশের দুর্দশার পেছনে বুদ্ধিজীবীদের একটা নিকৃষ্ট ভূমিকা রয়েছে। আজকের বাংলাদেশের চিত্র আহমদ ছফা’র বক্তব্যে স্পষ্ট-
’বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রেণি। এরা চিরদিন হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। প্রবৃত্তিগত কারণে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই কামনা করে। কেননা একমাত্র ফ্যাসিস্ট সরকারই কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্মান শিরোপা দিয়ে পুষে থাকে। অল্পসংখ্যক বাছাই করা লোককে দিয়ে নিজেদের প্রচার প্রোপাগান্ডা করিয়ে দেশের জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা এবং প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদ সমাজে শক্ত হয়ে বসে। চিন্তাশূন্যতা এবং কল্পনাশূন্য আস্ফালনই হল ফ্যাসিবাদের চারিত্র্য লক্ষণ।’