
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সাক্ষাৎকার
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বিশ শতকের ফিকশনের ভাষার ওপর তাঁর নির্মেদ ও নিরাবেগী ভাষার ভীষণ প্রভাব ছিল। ১৯৫৪ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। হেমিংওয়ের ১২টি উপন্যাস, ১১টি ছোট গল্প সংকলন এবং ৫টি নন-ফিকশন প্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের অনেকগুলোই আমেরিকান সাহিত্যের চিরায়ত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর সাথে গদ্যশিল্প ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে কথা বলেছেন জর্জ প্লিমটন। সাক্ষাৎকারটির কিয়দংশ অনূদিত হলো। অনুবাদ করেছেন দিলারা রিঙকি।
প্লিমটন: বর্তমানে আপনি যা লিখছেন তা কি আপনাকে তৃপ্তি দিচ্ছে?
হেমিংওয়ে: হ্যাঁ, খুব।
প্লিমটন: আপনার লেখালেখির প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে কিছু বলুন?
হেমিংওয়ে: আমার লেখালেখির প্রক্রিয়াটি খুবই তৃপ্তিপ্রদ। আমি যখন একটি বই অথবা গল্পের ওপর কাজ করি তখন সকাল-সকাল লিখতে বসে যাই। যতদূর সম্ভব ভোরের প্রথম আলো ফোটার পরপরই। ধরেন, এই সময় কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না এবং সময়টাই বেশ শান্ত, নিরিবিলি। আপনি লিখে যান যতক্ষণ না একটা জায়গায় বের হয়ে আসেন। যখন আপনি জানেন এর পরে কী ঘটবে, ঠিক সেখানেই একটু স্থির হন। ভাবেন। তারপর আবার শুরু করেন। আর আমি ঠিক এ প্রক্রিয়াতেই লিখে যাই এবং একটানা দুপুর পর্যন্ত, এমনকি আরও বেশি সময় লিখে যাই যতক্ষণ না আমি শূন্য হই। আর এই শূন্যতাই আমাকে পূর্ণতা দেয়। আপনিও এই প্রক্রিয়াটি অনুশীলন করে দেখতে পারেন। দেখবেন আপনার ভালোবাসা অন্য কারও সাথে হুবহু মিলে গেছে। আপনার বেদনায় অন্যেরাও হু-হু করে কেঁদে উঠছে এবং আপনিও মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন সঞ্চিত কষ্ট থেকে।
প্লিমটন: গতকালের শেষ লেখাটি যখন পড়েন আপনি কি রি-রাইট করেন অথবা যখন পুরো লেখাটা শেষ হয় তখন কীভাবে তা করেন?
হেমিংওয়ে: হ্যাঁ, এটা আমার স্বভাব। আমি সবসময়ই পয়েন্ট ধরে ধরে রি-রাইট করি। আর লেখাটা শেষ হওয়ার পর আপনিও এটা করবেন এবং প্রকাশিত হওয়ার আগপর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রক্রিয়াটি চলতেই থাকবে যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্ট হন। এই যেমন ‘ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠাটি নিয়ে আমাকে অন্তত ৩৯ বার বসতে হয়েছে।
প্লিমটন: একসময় বলেছিলেন আপনি তখনই ভালো লিখেন, যখন আপনি প্রেমে পড়েন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলবেন কি?
হেমিংওয়ে: এটা কেমন প্রশ্ন হলো! যাইহোক প্রশ্নের উত্তরটা এভাবে দেয়া যেতে পারে- আপনি যখন একা, তখন আপনি অনেকটা নৈরাজ্যিক। পরিকল্পনাহীন যা ইচ্ছে করে যাচ্ছেন এবং লিখতেও পারেন, হয়তো সেটা ভালো। কিন্তু আপনার সামনে যদি নির্দিষ্ট বিন্দু থাকে, আপনি ওটাকে ছুঁতে চাইবেন আর ওই ছোঁয়ার সাধনাটাই হলো প্রেম। সেজন্য নির্দিষ্ট পথ ধরেই হাঁটতে হয়। ব্যাপারটা আপনার ক্ষেত্রেও একই রকম।
প্লিমটন: ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টা কি লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? এ সম্পর্কে বলুন।
হেমিংওয়ে: এক্ষেত্রে এটাই বলতে চাই- যদি লেখালেখি করতে চান, আপনার জীবনের মতো তাকে ভালোবাসুন, এটি আপনার অন্যান্য প্রলোভনকে প্রতিরোধ করবে। লেখালেখিটাই হয়ে উঠবে আপনার প্রধান অভ্যাস, সবচেয়ে আনন্দের কাজ। তখন শুধু মৃত্যুই এ অভ্যাসটাকে দমাতে পারে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চেয়ে লেখালেখিই আপনাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে পারে।
প্লিমটন: সেই মুহূর্তটির কথা কি মনে করতে পারছেন, যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আপনি একজন লেখক হবেন?
হেমিংওয়ে: মুহূর্তটি ঠিক মনে নেই। তবে সবসময়ই চেয়েছি একজন লেখক হতে।
প্লিমটন: লেখক হওয়ার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন?
হেমিংওয়ে: একজন লেখক মানেই সে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য তার উচিত নিজেকে উন্মুক্ত করা, নিজের সম্পর্কে জানা। আর ভালো লেখাটা অবশ্য অসম্ভব রকমের একটি কঠিন কাজ। এজন্য তাকে নির্মোহ হতে হবে। তার উচিত হবে দয়ামায়াহীন কাটাকাটির দক্ষতা অর্জন।
প্লিমটন: অনেকেই আছেন যারা সাহিত্যের সাথে আপস করে একাডেমিক ক্যারিয়ার গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
হেমিংওয়ে: এটা নির্ভর করছে আপনি আপস বলতে কী বোঝেন তার ওপর। তবে একজন ভালো লেখক লেখালেখি ও শিক্ষকতা উভয়ই চালিযে যেতে পারেন। অনেকে এটা প্রমাণও করেছেন। কিন্তু আমি পারি না, তাই আমি তাদের প্রশংসা করি, যারা এটা পারে। আমি মনে করি যে একাডেমিক লাইফ রাখতে পারে, সে তার বাইরের জ্ঞানচর্চাকেও সমৃদ্ধ করতে পারে। knowledge বা জ্ঞান যাই বলুন, একজন লেখকের দায়িত্ব তাকে বিস্তৃত করা। একজন লেখক সারাদিন লিখে যাবে, যদিও দিনের কয়েক ঘণ্টা মাত্র ব্যয় হয় সঠিক লেখায়। আর প্রকৃত লেখকই পারে ভালো লেখার সাথে নিজেকে তুলনা করতে। যেহেতু লেখকের সংখ্যাও কম নয় সেহেতু ভালোর অনেক প্রকারভেদ থাকতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশুদ্ধ পানির জন্য আমরা কুয়ো খনন করি। আর এজন্য কুয়োর গভীরতাও বাড়াতে হবে এবং তা পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যাইহোক, আমি মনে হয় প্রশ্নের বাইরে চলে যাচ্ছি। তবে আপনার প্রশ্নটিও ততটা ইন্টারেস্টিং ছিল না।
প্লিমটন: আপনি তরুণ লেখকদের সংবাদপত্রে লিখতে বলবেন কি?
হেমিংওয়ে: একজন তরুণ লেখকের জন্য সংবাদপত্রে লেখাটা ক্ষতিকর হবে না, যদি তার মধ্যে বেরিয়ে আসার সক্ষমতা থাকে।
প্লিমটন: আপনি অন্যান্য লেখকদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করেন কি?
হেমিংওয়ে: কখনোই না। আমি সবসময় ভালো লেখার চেষ্টা করি। যারা ভালো লিখে গেছেন তাদের প্রয়োজনীয়তা এখনো অনুভব করি। এখনও পর্যন্ত আমি যেটা ভালো পারি স্বাভাবিকভাবে সেটাই লিখতে চেষ্টা করে আসছি। মাঝেমধ্যে সৌভাগ্যবশত আমি যা লিখতে চাই তার চেয়েও ভালো লিখে ফেলি।
প্লিমটন: সবশেষে আপনার সাহিত্যের একটি মৌলিক প্রশ্ন- একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে আপনার শিল্পের বৈশিষ্ট্যগুলো কী? আপনার সাহিত্যে ঘটনার বিবৃতির চেয়ে ঘটনাটাই বড় হয়ে ওঠে, কেন?
হেমিংওয়ে: এত দুর্বোধ্য প্রশ্ন কেন? আচ্ছা, যাইহোক। কিছু কিছু বিষয় আছে লেখার মধ্যে এমনিতেই এসে যায আর কিছুর অস্তিত্ব পরিকল্পনা থেকেই বিদ্যমান। এর মধ্যে কতগুলো আপনি জানেন, আবার অনেকগুলো জানতে পারেন না। আপনি আপনার আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন কিছু উদ্ধার করতে পারেন, যা শুধু উপস্থাপন করা নয় কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন কোনো সত্যের চেয়েও অন্যকোনো জীবন্ত সত্য, যা আপনার হাতে আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং আপনি যদি এটাকে যথেষ্ট ভালো করে তুলতে পারেন, লেখাটি পেয়ে যাবে তার অমরত্ব। এজন্য আপনি লিখবেন এবং কারণে-অকারণে লিখবেন। কিন্তু একজন পাঠক সবগুলো কারণ জানবে কি?