
আরা ভিলা ও আরা শহর
এ শহর নির্মাণের জন্য একটা ঘাসফড়িং একটা ঘাস খেয়ে ফেলে। অনেকগুলো ঘাসফড়িং অনেকগুলো ঘাস খেয়ে ফেলে। একজনকে মানলে এ শহরের নির্মাতা একটা ঘাসফড়িং—বসে আছে সে ঘাসফড়িং স্থাপত্য হয়ে শহরের মাঝখানে। অনেকজনকে মানলে এ শহরের নির্মাতা অনেক ঘাসফড়িং—বসে আছে তারা স্থাপত্য হয়ে শহরের মাঝখানে। কেউ মানে এক ঘাসফড়িং—এটা তার স্থাপত্য বিশ্বাস। কেউ মানে অনেক ঘাসফড়িং—এটা তার স্থাপত্য বিশ্বাস। শহরটার জন্ম হয় স্থাপত্য বিশ্বাস থেকে, স্থাপত্য বিজ্ঞান থেকে। বিশ্বাসে বিশ্বাসে যুদ্ধ হয়, বিজ্ঞানে বিজ্ঞানে যুদ্ধ হয়। ঘাস ফড়িং ঘাসে লুকায়, খুঁজবে কে তাকে। থাকুক সে জীবিত, থাকুক সে মৃত ঘাসের অন্তরে।
এ ফড়িংটাকে অথবা এ ফড়িংগুলোকে কে দেখেছিলো? জাহান আরা। এ গল্পের মালিক জাহান আরার শৈশব, জাহান আরার শৈশবের স্থাপত্য জ্ঞান। যে গল্প জাহান আরা কখনো হারাতে চায়নি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এ ঘাসফড়িংটার, এ ঘাসফড়িংগুলোর, এ গল্পটার।
কেউ কেউ এ কথা বলে, এ কথা লেখে, জাহান আরার গল্প থেকে, জাহান আরার বাড়ি থেকে তৈরি হয়েছে এ শহর। এ শহরের প্রথম বাড়ি জাহান আরার। যে বাড়ির নাম আরা ভিলা। জাহান আরার গল্প নির্মাণের পর কিংবা জাহান আরার নামে বাড়ি আরা ভিলা নির্মাণের পর এ শহর নির্মিত হয়েছে, গড়ে উঠেছে ক্রমশ। যেভাবে বৃষ্টির পর পুকুর তৈরি হয়, নদী তৈরি হয় এবং বৃষ্টির যাত্রা থাকে সমুদ্র অবধি।
একজন মানুষ, একটা গল্প বেশিদিন বাঁচলে এই একটা সমস্যা, এই হাজারটা সমস্যা, জানে সে শহরের নর্দমা ও নদীর সকল পথ। জাহান আরা বেশিদিন বাঁচলে, তার গল্প বেশিদিন বাঁচলে জানে জাহান আরা, জানে তার গল্প এ শহরের নর্দমা ও নদীর গন্তব্যস্থল। আর এই কথা জানে সবাই নর্দমা ও নদী বহন করে শহরের সকল সংসারের জল। আর একটা নর্দমা জন্ম দেয় কত নর্দমার, একটা নদী জন্ম দেয় কত নদীর, একটা গল্প জন্ম দেয় কত গল্পের, একটা বাড়ি জন্ম দেয় কত বাড়ির। তারপর এসব বাড়ি থেকে দলে দলে, স্রোতে স্রোতে সংসার হেঁটে আসে, ভেসে আসে।
জাহান আরার গল্প থেকে বেরিয়ে এসেছে তার স্বামী, তার ছেলে-মেয়ে, তার সংসার। সংসারের মাঝে ফুলগাছ জন্মায়, ফলগাছ জন্মায়। ঋতু পরিবর্তন হলে, ঋতু স্বাস্থ্যহীন হলে, ফুল ঝরে, ফল ঝরে। বয়স ঝরে যায়। কথা ঝরে যায়। তার স্বামীর বয়স ঝরে গেলে, স্বামীর কথা ঝরে গেলে, তার স্বামী মারা যায়। তার স্বামী জাহান আরার সঙ্গে বটগাছের ছায়ায় বসে কথা বলার মতো সময় জমাতে জমাতে মারা যাওয়ায় এই আফসোস জাহান আরার, বটগাছের ছায়ায় বসে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার স্নিগ্ধতা কেমন জানা গেলো না।
তার ছেলে-মেয়েরা জীবিত থাকলে তাদের কথা শোনা যায়। তারা কথা বলছে আরা ভিলা নিয়ে। তারা সাতজন, জাহান আরার চার ছেলে তিন মেয়ে, বেরিয়ে এসেছে জাহান আরার গর্ভ থেকে, বেরিয়ে এসেছে আরা ভিলা থেকে। তারা সিদ্ধান্তে যেতে চাচ্ছে বণ্টন বিষয়ে। বণ্টিত হবে তাদের সম্পত্তি—তাদের মা ও আরা ভিলা। তারা তো বেরিয়ে এসেছে তাদের মা ও আরা ভিলা থেকে। যে স্থান থেকে কেউ বেরিয়ে আসে সে স্থানের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্তে যাওয়া যায়।
(২)
আরা ভিলা দেখার জন্য, জানার জন্য রাতের কাছে যেতে হয়, রাতের ব্যাধির কাছে যেতে হয়। এখন রাত। রাত আসে চাঁদ নিয়ে, চাঁদের ব্যাধি নিয়ে; চাঁদের গল্প নিয়ে, গল্পের ব্যাধি নিয়ে; ফুল নিয়ে, ফুলের ব্যাধি নিয়ে। ব্যাধি আক্রান্ত জাহান আরা কথা বলছে তার সেবিকার সঙ্গে। সেবিকা নূরজাহান মোমবাতি খুঁজতে খুঁজতে উত্তর দেয় জাহান আরার প্রশ্নের।
– আমার শব্দ কি শোনা যায়?
– শোনা যায়।
– আমার শরীরে কতোটুকু শব্দ জমা আছে?
– শরীরের শব্দের পরিমাপ জানি না আমি।
– আমার শরীরে কি চাঁদ আসে ?
– আসে।
– কতোটুকু চাঁদ নামে আমার শরীরে?
– চাঁদের পরিমাপ জানি না আমি।
– আমার শরীরে কি আমার সাত ছেলে মেয়ের শব্দ আছে?
– আছে।
– কতোটুকু শব্দ তারা আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছে?
– আপনার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নাই।
– আমার শরীরে কি আমার স্বামীর শব্দ আছে?
– জানি না। সমাধির শব্দ আমি জানি না।
– তোমার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
– অর্থ ও শব্দের সম্পর্ক।
– তোমাকে মাসিক বেতন দেয়া হয় কী জন্য?
– আপনার সঙ্গে শব্দ বিনিময় করার জন্য আর ঔষধ চিনিয়ে দেবার জন্য।
– তোমার কি শব্দ নিয়ে পড়াশোনা আছে?
– না।
– তবে তুমি শব্দ বিষয়ে জেনেছো কীভাবে?
– শরীর থেকে। শরীরের ক্ষুধা থেকে।
– ক্ষুধার শব্দ কেমন?
-আপনার নামের বাড়িটা জানে।
– এ বাড়িটা কি ক্ষুধার্ত?
– জ্বি। প্রতিটা বাড়ির ক্ষুধা থাকে। আরা ভিলা এ শহরের প্রথম ক্ষুধার্ত বাড়ি।
– এ বাড়ি ক্ষুধার্ত হলে আমিও কি ক্ষুধার্ত?
– জ্বি। এ শহরের প্রথম ক্ষুধার্ত ব্যক্তি আপনি।
– আমি কি আমার ক্ষুধা চিনিনি?
– না।
– আমার ক্ষুধা কি?
– ক্ষুধা অজস্র। তবে এখন আপনার ছেলে মেয়েরা আপনাকে নিয়ে কী ভাবছে সেটা জানার আগ্রহই আপনার ক্ষুধা।
– তারা কী ভাবছে ?
– মানুষের ভাবনার অল্পটুকু জানা যায়।
– তুমি কি সেই অল্পটুকু জানো ?
– জ্বি।
– তবে অল্পটুকু জানাও।
– তারা পাশের ঘরে আরা ভিলা ও আপনাকে নিয়ে কথা বলছে।
– আমি শুনতে পাচ্ছি না কেনো?
– বাড়ির চেয়ে পরিবার বড় হয়ে গেলে, পরিবারের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে গেলে বাড়ির কথা, বাড়ির শব্দ শোনা যায় না।
– তুমি শুনছো কীভাবে?
– আমি এসেছি বাজার থেকে। পরিবারের সব শব্দ বাজারে যায় আর বাজারের সকল কথা আমি শুনতে পাই।
– আরা ভিলা তো বাজারের বাইরে।
– না। আরা ভিলা এবং আপনি বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন।
– তারা কী বলছে আমাকে নিয়ে, আরা ভিলাকে নিয়ে।
– তারা আপনার নিকট থেকে, আরা ভিলা থেকে স্থায়ীভাবে বের হতে চাচ্ছে।
– কীভাবে বের হওয়া যায় একজন ব্যক্তি থেকে, একটা বাড়ি থেকে।
– বিক্রি করার কৌশল আয়ত্ব করে।
– আরেকটু ব্যাখ্যা হলে সুবিধা হয়।
– কোনো বস্তুকে, ব্যক্তিকে বিক্রি না করতে পারলে তা থেকে বের হওয়া যায় না।
– আমি কি বিক্রি হয়েছি, আরা ভিলা কি বিক্রি হয়েছে ?
– আপনি আয়নার দিকে তাকান।
– বিয়ের সময়ের এ আয়না।
– আয়নায় কার ছবি?
– আয়নার ছবি।
– আপনার স্বামী বিক্রি হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়ে বিক্রি হয়ে গেছে, আরা ভিলা বিক্রি হয়ে গেছে।
– কে তাদেরকে বিক্রি করলো?
– আপনার দীর্ঘজীবিতা।
– কতো আগে মরে যাওয়া উচিৎ ছিলো আমার?
– আয়নায় আয়নার ছবি প্রতিফলিত হবার আগে।
এ সময় সেবিকা নূরজাহান মোমবাতি খুঁজে পায়। মোমবাতি জ্বললে প্রশ্ন পুড়ে যায়, উত্তর পুড়ে যায়। একটা পোকা মোমবাতির কাছে বসে আহ্বান করছে দূরের পোকাকে, যে পোকা আলো থেকে দূরে বসে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে।
(৩)
শহরের প্রথম বাড়ি আরা ভিলা বিক্রি হবে এ বিজ্ঞাপনটি খবরের কাগজে এলে এ শহরের অধিকাংশ মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে বাড়িটা দেখার জন্য এবং কেনার জন্য। আরা ভিলা যে এ শহরের প্রথম বাড়ি তা খুব কম মানুষই জানতো ও চিনতো। বিক্রির বিজ্ঞাপনে এ বাড়িটা শহরের মানুষদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলতে থাকলেন এবং পত্রিকায় লিখতে থাকলেন এ বাড়িটার প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য আছে। ইতিহাসবিদরা জানাতে লাগলেন এ বাড়িটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহাসিকেরা এ তথ্য আরো জানালেন এ বাড়ির নাম আরা ভিলা হয়েছে জাহান আরার নাম থেকে। আর এ শহরের নাম জাহানারাবাদও হয়েছে জাহান আরার নাম থেকে। এ সময় কেউ কেউ বললো এ বাড়িটা এ শহরের রাজধানী স্বরূপ। যদিও সত্য এ রকম যে একটা দেশের রাজধানী থাকলেও একটা শহরের রাজধানী থাকে না। তাছাড়া একটা বাড়ি কীভাবে রাজধানী হয়। সে সময় গবেষণা হয় যে ব্যতিক্রম বলে কিছু আছে, তা থাকে সর্বত্র। ব্যতিক্রম এক সময় নিয়ম হয়ে যায়। তাই তারা এ বাড়িটাকে অর্থাৎ আরা ভিলাকে বলতে থাকে জাহানারাবাদের রাজধানী। তাছাড়া রাজধানী বললে বাড়িটার গৌরবও বৃদ্ধি পায়।
বিক্রির বিজ্ঞাপনে অনেকের মন খারাপ হয়। আরা ভিলার জন্য অনেকের ভালোবাসা জন্ম নেয়। দলে দলে নারী-পুরুষ আরা ভিলাকে দেখতে আসে। আরা ভিলাকে নিয়ে অনেকগুলো গল্প তৈরী হতে থাকে। এ শহরের লোক এতোদিন এ শহরের উৎপত্তি নিয়ে কোনো গল্প জানতো না, মানতো না। এখন তারা আরা ভিলাকে কেন্দ্র করে জাহান আরাকে কেন্দ্র করে গল্প তৈরি করতে থাকে, বলতে থাকে, শুনতে থাকে। তারা মনে করে শহর তৈরীর গল্প ছাড়া একটা শহর কীভাবে টিকে থাকে, কীভাবে গৌরব বোধ করে সে শহরের লোকজন।
আরা ভিলায় কী কী আছে। যারা দেখতে যায় তারা নিয়ে আসে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা, ভিন্ন ভিন্ন গল্প। সবার বর্ণনা ও গল্প একরূপ হয় না। তাহলে কী আরা ভিলা যাদুর বাড়ি। যে বাড়ি একরকম থাকে না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সে তার আয়তন, আকার, চেহারা পাল্টায়। যারা কয়েকবার সেখানে যায়, তারা বলে তারা প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখতে পেয়েছে আরা ভিলাকে। এবং এবার তাদের অবসর হয় নিজেদের বাড়িকে দেখার। তারা বুঝতে চায় তাদের বাড়িও বদলে বদলে যায় কী-না সময়ের বিভিন্ন ভাগে। তারা খুব বিস্মিত হয়ে দেখে তাদের বাড়িগুলোও এক রকম থাকে না সব সময়। সেগুলোও নানারূপ ধারণ করে নানান সময়। আহারের সময় এক রকম, বিশ্রামের সময় আরেক রকম; ভালোবাসার সময় এক রকম, ঘৃণার সময় আরেক রকম; দিনে এক রকম, রাতে আরেক রকম।
এক দম্পতি, যারা ভ্রমণ ভালোবাসে, জানায়, আরা ভিলায় আছে একটা গার্ডেন। এটা এ শহরের প্রথম গার্ডেন। তবে এ গার্ডেনটা আরা ভিলা নির্মাণের আগে না পরে হয়েছে সে বিতর্ক থেকে যায়। যে গার্ডেনে আছে নানারূপ ফুল ও ফল গাছ। এ সকল ফুল সব সময় গন্ধ ছড়ায় আর এ সকল ফল সব সময় গন্ধ গ্রহণ করে। তাদের এ গল্প শোনার পর এ শহরের অনেকে সে গার্ডেনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। অনেকে নিজেদের বাড়ির সঙ্গে গার্ডেন তৈরির কথা ভাবে।
আরেক দম্পতি আরা ভিলা পরিদর্শন করে এসে এ রকম গল্প বলে যে জাহান আরা আর তার স্বামী প্রথম মিলিত হয় যে পালংকে সে পালংকটা এখনো আছে আরা ভিলায়। এ গল্প শুনে অনেক প্রেমিক প্রেমিকা কৌতুহলী হয়ে ওঠে সে পালংকের বিষয়ে। তারা এ ইচ্ছাও পোষণ করে এ রকম ডিজাইনের পালংক তারা বানাবে বিয়ের পূর্বে।
আরেক দম্পতি যারা সারাক্ষণ ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়, তারা জানায় আরা ভিলায় আছে এমন এক আয়না যেখানে মুখ দেখা যায় না। এ আয়না সবার মুখ লুকাতে জানে। জাহানারাবাদ শহরের একটি বিদ্যালয়ের কয়েকজন কিশোরী এ বাড়ি দেখতে এসে একটা দারুণ কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় আবিষ্কার করে। বাড়িটার যেখানে বাড়িটার নাম লেখা আছে আরা ভিলা, তার নিকটে তারা খেয়াল করে অস্পষ্টভাবে চার লাইন কিছু লেখা। তারা সে চার লাইন লেখা পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু লেখাটা এতো অস্পষ্ট যে তারা সেটা পড়তে ব্যর্থ হয়। তবে এই অস্পষ্ট লেখা ভাষা গবেষকদের মাঝে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি করে। তারা বলে এই চার লাইন এ শহরে প্রথম কবিতা। এই চার লাইন পড়া গেলে এবং তার অর্থোদ্ধার করা গেলে এ শহরের সাহিত্যের জন্য একটা বড় বিষয় হয়ে যাবে।
এভাবে গল্প ও কথা তৈরী হতে থাকলে জাহানারাবাদের ঐতিহাসিকেরা ঘোষণা করে আরা ভিলার এ সব গল্প আসলে জাহানারাবাদ শহরের ইতিহাস। এ শহরের গৃহনির্মাণের আগের ও পরের ইতিহাস। এসব গল্প ইতিহাস হিসাবে স্বীকৃত হয়ে লিখিত হওয়া উচিৎ।
কিছুদিন পর এ শহরের মেয়র ঘোষণা করে, এ সকল গল্প একটা বইয়ে সংকলিত করার সকল ব্যবস্থা সে গ্রহণ করেছে। এবং দ্রুতই এ বই ছাপা হবে। মেয়র আরো জানায় এ বই ছাপা হওয়ার পর আরা ভিলা বিষয়ে আর কোনো গল্প অন্তর্ভুক্ত হবে না এ বইয়ে।
এ বইটি কয়েকটি ভাষায় লিখিত ও ছাপা হয়। আর আরা ভিলা বিষয়ক গল্পের বইকে জাহানারাবাদের মানুষ নিজেদের জেনেসিস বিষয়ক বই জ্ঞান করতে থাকে। তারা এই বলে গর্ববোধ করে যে অবশেষে তারা তাদের ইতিহাস জানতে পেরেছে, পরিচয় জানতে পেরেছে। পরিচয়হীন, ইতিহাসহীন মানুষ অসহায়। আরা ভিলা বিষয়ক বইটি তাদেরকে সাহস দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, পিছনের দিকে তাকানোর বীরত্ব দিয়েছে। এই কথা হয়তোবা ঠিক, মানুষেরা সর্বদা বলতে চায় তাদের পিছনের বীরত্বের কথা।
(৪)
বিক্রি হবার কালে মালিকের নাম জানতে হয়। এখন জানা হয় বাড়ির নাম আরা ভিলা হলেও এর মালিক জাহান আরা নয়। তার স্বামী মৃত্যুর আগে এ বাড়ির মালিকানা দিয়ে গেছে তাদের সাত ছেলে-মেয়েকে। এ সময় এ শহরের একজন সৌখিন ঐতিহাসিক লক্ষ্য করেন, এ শহরের অধিকাংশ বাড়ির নাম মা ভিলা। তবে একটা বাড়ির মালিকানাও মায়েদের না। এ সৌখিন ঐতিহাসিক আরো একটু ভাবে রাত গভীর হলে। এ শহরে যাকে বীর বলা হয় তার বীরত্ব নাই; যাকে কবি বলা হয়, তার কবিত্ব নাই; যাকে লেখক বলা হয়, তার লেখকত্ব নাই ; যাকে সৎ বলা হয়, তার সততা নাই ; যাকে স্বামী বলা হয়, তার স্বামীত্ব নাই; যাকে স্ত্রী বলা হয়, তার স্ত্রীত্ব নাই।
জাহানারাবাদের মেয়র আরা ভিলার মালিক জাহান আরার সাত ছেলে-মেয়েকে ডেকে পাঠায়। মেয়র তাদেরকে বলে এ বাড়ি রাষ্ট্র নিতে চায়। কারণ এ বাড়ির সঙ্গে জড়িত আছে এ শহরের উৎপত্তির গল্প। এ শহরের আদি ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য আরা ভিলা রক্ষা করা প্রয়োজন। আরা ভিলা কেউ কিনতে পারবে না রাষ্ট্র ছাড়া। রাষ্ট্র আরা ভিলা নিয়ে নেয়ার বিনিময়ে তাদের সাত ভাই বোনকে এ শহরের সবচেয়ে সুন্দর সাতটা অ্যাপার্টমেন্ট দিবে। সাত ভাই-বোন মেয়রের এ প্রস্তাবে আনন্দিত হয়। তবে তারা দু’টো অনুরোধ করে মেয়রকে। তাদের মা যতদিন বাঁচবে ততদিন আরা ভিলায় বাস করবে। দ্বিতীয়, তারা যেহেতু তাদের মাকে খুব ভালোবাসে তাই তারা যে সাতটা অ্যাপার্টমেন্ট পাবে সেগুলোর অন্তত একটার নাম আরা ভিলা রাখতে চায়। মেয়র তাদের মাকে আরা ভিলায় একজন সেবিকাসহ রাখার প্রস্তাব গ্রহণ করে কিন্তু তাদের কোনো অ্যাপার্টমেন্টের নাম আরা ভিলা রাখার বিষয়ে সম্মতি দেয় না। বরং মেয়র একটা আইন জারি করে যে এ শহরে কোনো ব্যক্তি তার বাড়ির নাম আরা ভিলা রাখতে পারবে না।
(৫)
তারা বলে, ধন্যবাদ মেয়রকে, ধন্যবাদ মেয়রের সরকারকে, মেয়রের রাষ্ট্রকে, যারা সুন্দর সুযোগ করে দিয়েছে আরা ভিলা দেখার। জাহানারাবাদের শিশু, নারী, পুরুষ এতোদিন পর চোখ ভরে আরা ভিলা দেখে আনন্দিত হয়। আরা ভিলা না দেখতে পেলে তাদের জীবন যেন ব্যর্থ হয়ে যেত। এ শহরের সবাই জীবনে একবার অন্তত আরা ভিলা দেখতে চায়। আরা ভিলা এখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। যেহেতু জাহান আরা এখনো জীবিত, এখনো বাস করে আরা ভিলায়, তবে সেও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলে বিবেচিত হয়। কোনো ব্যক্তি বা জনগণ যে রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হয় তা এ শহরের লোকজন এখন জানে। এবং অনেকে ভাবে ব্যক্তির রাষ্ট্রের সম্পত্তি হওয়া বিষয়টা খুব গৌরবের ও সম্মানের। রাষ্ট্রের সম্পত্তি কীভাবে হওয়া যায় সেটা নিয়ে ভাবে এ শহরের বুদ্ধিজীবিরা।
আরা ভিলাকে আরো চমৎকার দর্শনীয় স্থান করার জন্য মেয়র উদ্যোগ নেয়। আরা ভিলার দু’পাশে দু’টো দীর্ঘ লেক খনন করা হয়। লেকে মাছ ও হাঁস ছেড়ে দেয়া হয়। কয়েকটা হরিণ ও কয়েকটা বানর আরা ভিলার গার্ডেনে রাখা হয়। শহর ও শহরের বাইরের পর্যটকেরা যেন ঠিক মতো আরা ভিলাকে দেখতে পায় সে জন্য বেশ কয়েকজন গাইড নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারী ছুটির দিনসহ সপ্তাহে সাতদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে আরা ভিলা।
(৬)
এখন রাত। রাত এখন গাছ। বড় অন্ধকার গাছ। এ গাছের নিচে বসে কথা বলছে জাহান আরা তার সেবিকা নূর জাহানের সঙ্গে। জাহান আরার কত প্রশ্ন, তার শরীর প্রশ্নময়, তার মন প্রশ্নময়। তার সকল উচ্চারণ প্রশ্নময়, সকল নীরবতা প্রশ্নময়।
– আমার নামে বাড়ি অথচ এ বাড়ির মালিক আমি নই।
– জ্বি।
– আমার শরীরের নাম জাহান আরা। আমার শরীর কি আমার?
– এখন আপনার শরীর রাষ্ট্রের।
– কীভাবে আমার শরীর রাষ্টের হয়?
– রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতর যা কিছু সে সব কিছু রাষ্ট্রের। লিখিত এসব। স্বীকৃত এসব।
– রাষ্ট্র কে ?
– রাষ্ট্র মালিক।
– মালিক কী ?
– জানা নাই আমার।
– জানে কে ?
– জানে না কেউ।
– আমার স্বামী রাষ্ট্র?
– হতে পারে।
– আমার সন্তানেরা কী রাষ্ট্র ?
– হতে পারে।
– মেয়র কী রাষ্ট্র?
– হতে পারে।
– সরকার কী রাষ্ট্র?
– হতে পারে।
– সমাজ কী রাষ্ট্র?
– হতে পারে।
– ধর্ম কী রাষ্ট্র?
-হতে পারে।
-রাষ্ট্র কতো কী হতে পারে?
-অজস্র কিছু হতে পারে।
– আমাকে ও আমার নামে বাড়িকে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে কেনো?
-আপনার ও আপনার বাড়ির প্রদর্শন মূল্য আছে।
– এ মূল্য কে নিচ্ছে?
– রাষ্ট্র।
– আমি নিজে কেন আমাকে প্রদর্শন করতে, বেঁচতে পারছি না?
– কারণ আপনি রাষ্ট্রের।
– রাষ্ট্র কি অমর?
– অমর। যতোদিন কেনা-বেচা আছে।
– আমি আত্মহত্যা করতে চাই।
– পারবেন না। রাষ্ট্রের অনুমতি নাই।
– আমি রাষ্ট্র থেকে বের হতে চাই।
– পারবেন না।
– কারণ?
– রাষ্ট্রের বাইরে কিছুই নাই।
– তুমি কি আমার সেবিকা নও ?
– না। রাষ্ট্রের সেবিকা। আপনাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
– আমি কী কারাগারে?
– সঠিক উত্তর নাই।
– আমি ঘুমাবো।
– ঔষধে ঘুম জমা আছে।
(৭)
দর্শনার্থীরা টিকেট কেটে দেখতে এসেছে আরা ভিলা আর জাহান আরাকে। জাহান আরার সাত সন্তানও টিকেট কেটেছে আরা ভিলা ও জাহান আরাকে দেখবে বলে। ফ্যামিলি রিইউনিয়ন।