
আয়নামহল
ঘুমঘুম চোখে বাথরুমে এক পা দিয়েই চিৎকার করে ওঠেন আসগর আলী, কে? কে করলো আমার এমন সর্বনাশ? উহু বাবারে… সেই সঙ্গে ডান পা দুহাতে ধরে বাম পায়ে কয়েকটা নাচ দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। চিৎকারের শব্দে আয়নামহল বাড়ির অনেকেই জেগে ওঠেছেন এবং দৌড়ে বাথরুমের সামনে এসে আসগর আলীর রক্তাক্ত দৃশ্যে প্রথমে হতচকিত হয়ে যান। মেজো ছেলের বড় ছেলে, আসগর আলীর নাতি আশিক আলী বসে পড়ে দাদার সামনে, পা তুলে নেয় নিজের কোলে। তাকায় দাদার দিকে, কিভাবে হলো?
কোঁকাতে কোঁকাতে তিনি জানান, বাথরুমে পা দিতেই কাঁচের টুকরোয় পা বিঁধে যায়, উপরে তাকিয়ে দেখি বাথরুমের আয়নাটা ভাঙ্গা, টুকরো টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে গোটা বাথরুমে।
বলেন কী? বাড়ির বয়স্ক কাজের লোক হরিপদ বাথরুমে তাকিয়ে হায় হায় করে, এইডা ক্যমানে অইলো? কেডায় করলো?
হরিপদের চিৎকার শেষ হতে পারে না, দোতলা থেকে ছুটে আসে ছোট ছেলের বৌ কংকা, আব্বা দেখে যান। কিন্তু শ্বশুরকে বাথরুমের সামনে রক্তমাখা অবস্থায় লুটোপুটি খেতে দেখে পটলচেরা চোখে বিস্ময়ের সঙ্গে সবকিছু এক নজর দেখে তাকায় হরিপদের দিকে, কী হয়েছে?
বাথরুমের আয়না কেডায় জানি ভাইঙ্গা রাখচে। ভাঙ্গা কাচে হুজুরের পাও কাটছে…
হরিপদের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কংকার শরীরে একটা অজানা ভয় প্রবেশ করে। থিরথির শরীর কাঁপছে। বসে শ্বশুরের পাশে, আব্বা আমার বাথরুমের আয়নাও ভাঙ্গা।
ব্যথায় কাতর আসগর আলী তাকায় পুত্রবধুর দিকে, তোমাকে কে বললো?
আমি নিজের চোখে দেখে আপনাকে জানাতে এসেছি।
আশীক আলী অনেক কষ্টে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোটা বের করে তাকায় দাদার দিকে, কাঁচ বের করেছি। হরিপদ, তুমি ডেটলের বোতলটা আনো।
জে, আনতেছি- হরিপদ দৌড়ে নিচে যেতে না যেতেই বাড়ির নিচতলা থেকে দৌড়ে উপরে তিনতলায় আসে বড় ছেলে মোমিন আলীর বিধবা বৌ সুখেলা আখতার, আব্বা বাথরুমের আয়না আর আমার পুরোনা ড্রেসিং টেবিলের আয়না আর নাই… শোকবিধ্বস্ত গলা।
হরিপদ ডেটল নিয়ে এলে আশীক আলী ডেটল মেখে পা শুকনা কাপড়ে মুড়িয়ে দিয়ে বলে, দাদা আপনি রুমে গিয়ে বিছনায় শুয়ে থাকুন। আর বেলা একটু বাড়লে ডাক্তার ডেকে আনবো।
বুঝলাম কিন্তু বাড়ির মধ্যে আয়না ভাঙ্গছে কেন?
ঘাড় চুলকায় আশীক আলী, কিছুই তো বুঝতে পারছি না দাদা।
তোর রুমের আয়না ঠিক আছে?
হাসে নাতী আশীক আলী, আমার রুমে কোনো আয়না নেই, তুমি চলো দাদা। রুমে পৌঁছে দিই…
নাতির কাধে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন আজগর আলী। তাকান বিধবা পুত্রবধূর দিকে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাড়ির প্রত্যেক রুমের , রাথরুমের আয়না কে ভাঙ্গলো? কেন ভাঙ্গলো? কেউ টের পেলো না?
আব্বা, আমি অনেক আগেই বলছিলাম, বাড়িটায় ভূত আছে-
নিজের রুমে দিকে ফিরে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন আসগর আলী, বাড়িটায় ভুত আছে তুমি একা বলছো। আমরা তো কেউ দেখি নাই। বড় বৌ তো আছে পঁচিশ বছর ধরে বাড়িতে, কখনো বলে নাই আমার বাড়িতে ভুতের আছর আছে। আমি বাড়ি বানিয়েছি পয়ত্রিশ বছর, একদিনও ভুতের সঙ্গে দেখা হয়নি।
সবাই চুপ।
হরিপদ?
জে হুজুর!
বাথরুমের কাঁচগুলো তুলে সুন্দর করে ঝাড়ু দিয়ে রাখ। দেখিস কারো পায়ে কাঁচ ঢুকে না যায়। আর বড় বৌমা, আমি দেখতেছি। তুমি যাও, আসগর আলী সবার আড়ালে চলে গেলেন। দুই পুত্রবধূ পরম্পরের দিকে দৃষ্টি রেখে যে যার মতো চলে যায়।
খ
আসগর আলীর তৃতীয় পুত্র রাহাত আলী নিজের রুমে শুয়ে আছেন। চোখ খোলা। চোখ বুজলেই একটা আতঙ্ক- অশরীরী আত্মা অন্ধকারে তাকে ঝাপটে ধরবে। কেনা এমন হচ্ছে? রুমের মধ্যে সুন্দর একটা ড্রেসিং টেবিলের আয়না টুকরো টুকরো। বাথরুমের আয়নাও টুকরো টুকরো করে ছড়ানো গোটা রুম জুড়ে। না ভেঙ্গে উপায় নেই রাহাত আলীর? আয়নার সামনে দাঁড়ালেই দৃশ্যটা…
শুরুতে একটা সুন্দর পা, একটা পায়ের পরে দ্বিতীয় আর একটা পা দেখতে পায়…. সুডৌল মসৃন। পা জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে রাহাত আলীর। চুমুও খেতে চায়…। যখনই চুমু খাওয়ার জন্য ওষ্ঠদ্বয় নিয়ে যায় আয়নার কাছে, ঠিক তখনই পা জোড়ার সুন্দর ফর্সা মাংশ ফেটে টাটকা রক্ত বের হতে থাকে। রক্তের নহরে শরীর শিউরে ওঠে, গুলিয়ে ওঠে নাভীমূল! আর তখনই আয়নার উপর…
রাহাত আলীর মনে হয়, সেই পা জোড়া, রক্তাক্ত পা জোড়া রুমের মধ্যে প্রবেশ করেছে। দ্রুত উঠে বসে শোয়া থেকে। তাকায় দরজার দিকে, না কোনো রক্তপায়ের চিহ্ন নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় চারপাশে, না নেই। কেন এমন হচ্ছে? ঝুমকার কোনো চাল? ঝুমকা যাবার আগে বলেছিল, তোকে আমি এক মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেবো না হারামজাদা। তোর সকল সুখ আমি কেড়ে নেবো। আমাকে চেনো নাই রাহাত শুয়োরের বাচ্চা শুযোর! ঝুমকা যখন ক্রোধে কথা বলে, সুন্দর চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বাইরে আসার জন্য ছটফট করে, আকারে বড় হয়ে যায়, চোখের চারপাশে রক্ত জমে, দেখে ভয়ে রাহাত আলীর শরীর কাঁপে।
ঝুমকা কি কোনো তান্ত্রিক? তারই কোনো মন্ত্রটন্ত্রে…? বিশ্বাস নেই ওকে। এক রোখা মেয়ে, দেখলে মনে হয় বড় গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বেয়ে ওঠা সবুজ স্বর্ণ লতিকা। কিন্তু ব্যবহারের সময়ে বোঝা যায় ও আস্ত সর্প লতিকা। শুরুতে বোঝা যায় না, কয়েক দিন পরেই প্রকাশ পায় আসল চেহারা। ওর মায়েরও নাকি এই রকম বাতিক ছিল। ক্রোধ প্রকাশের সময়ে জিহ্বা সাপের মতো বের হয়ে আসতো মুখের বাইরে…।
ঝুমকা নিজের মতো করে চালাতে চায় রাহাতকে। রাহাত আট ঘোড়ার ধুলোবালির সঙ্গে চলে অভ্যস্ত। কারো শাসনের বা নিষেধের জালে আটকে থাকতে চায় না। স্বামীকে নিজের আয়ত্বে আনতে না পেরে আঙুল তুলেছিল মৃত বড় ভাইয়ের স্ত্রী সুলেখা আখতারের দিকে, মাগী খুব সুখ দেয় তোমাকে?
সঙ্গে সঙ্গে চড় মেরেছিল ঝুমকার দুই গালে, একের পর আরেক। লাল গালে কালশিটে দাগ পড়েছিল বিচ্ছু সাপিনীর। অবাক কান্ড, হাইহিল জুতোর হিলের মতো ছিপছিপে মেয়েটি কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল, এক ফোটাও জল পড়েনি চোখ থেকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে রুমের মধ্যে টানছিল আর লাটিমের মতো ঘুরছিল । রাহাত আলী ডিভানে শুয়ে শুয়ে দেখছিল একটা দুপেয়ে শুয়োপোকার মর্মান্তিক আস্ফালন। সিগারেট শেষ হলে রাহাতের সামনে এসে দাঁড়ায়। একে একে খুলে ফেলে ব্রা, ব্লাউজ, শাড়ি, পেটিকোট। নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিষ্পলক রাহাত আলী, ঝুমকাকে কতো দেখেছে, ছেনেছে, মেখেছে কিন্তু কোনোদিন বুঝতে পারেনি, ঝুমকা তরবারির মতোই সুন্দর! চোখ ঝলসে যায়.. ।
ঝুমকা কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আলমারী খুলে জামা কাপড় ব্যাগে ভরে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দূর থেকে রাত দুপুরে দেয়াল ভেঙ্গে সেই চেনা গানের সুর ভেসে আসে, তুমি চলে গেলে আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম .. বলার কিছু ছিল না…। ঝুমকা চলে গেছে তাও ছয় মাস। নিজেকে কুন্ডলী পাকানো সাপের খোলসে আটকে রেখেছিল রাহাত আলী কিন্তু গত রাতে কে ডাকছিল ঘুঙুর বাজিয়ে!
গ
আসগর আলীর বড় পুত্র মোমিন আলী মারা যায় বছর আটেক আগে, ট্রেনের নিচে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে। ছেলেটা বড় একরোখা আর আনমনা ছিল। বিয়ে করতে চেয়েছিল আপন খালার মেয়ে সুলতা আজমেরীকে। কিন্তু রাজি ছিলেন না আসগর আলী। কারণটা খুলে বলা না গেলেও তিনি জানতেন। নিজের স্ত্রী মাসুমা খানমের তিন বছরের ছোট সুলতা আজমেরীর মা লুবনা খাতুনের সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার রাত্রি যাপন করেছিলেন এবং সেই রাত্রি যাপন জানতেন নিজের স্ত্রী মাসুমা খানমও। কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করেননি, বুঝতেও দেননি যে তিনি জানেন ঘটনা। করোটির দেয়ালে ঢং ঢং বাজে, কেন কোনো প্রতিবাদ বা ঝগড়া বা ঘৃণা করেনি মাসুমা খাতুন? গোপনে মাসুমা খাতুনও কি কোথাও কারো সঙ্গে মন্ত্র জপছিলেন?
অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনো ঠিকুজি বা চিহ্ন আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু গিট খুলে দিয়ে যায় মৃত্যুর সময়ে মাসুমা খাতুন নিজে, আমার পেটে তোমার ছোট ভাইয়ের ঔরসেই সকল সন্তান। তোমার পিতা হওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই টের পেয়েছিলাম তোমার অক্ষমতা। কিন্তু আমাকে তো প্রমাণ রাখতে হবে আমার গর্ভ ক্ষমতার।
দুগ্ধ সাদা শয্যায় মরণাপন্ন স্ত্রীর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে আসগর আলী হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছিল না যখন, ঢোকে লুবনা খানম।
আগসর আলীর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বোনের পাশে বসে পরম মমতায় মুখের উপর ঝুঁকে বলেছিল লুবনা খানম, আপু জীবনে তোর উপকার কোনোদিন ভুলবো না।
মাসুমা খানম শীর্ণ হাত তুলে বোনের চোখে মুখে বুলাতে বুলাতে চিরকালের জন্য স্থির হয়ে যায়। লুবনাকেও সে কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি এ সম্পর্কে। আর জানা হলো না আসগর আলীর, মাসুমা খানম কী উপকার করেছিল বোন লুবনা খানমের!
বড় ছেলে মোমিন আলী নিজের পছন্দের মেয়ে সুলতা আজমেরীকে বিয়ে করতে না পেরে পিতার পছন্দে বিয়ে করেছিলো সুলেখা আখতারকে। কিন্তু ষোলো বছরের দাম্পত্য জীবনে একটি মাত্র মেয়ে শম্পা সুনয়নাকে রেখে এক নির্জন দুপুরে বাড়ির সামনে রেললাইনে ট্রেনের নিচে ঝাপ দিলো ছেলেটা! আহা, ছেলেটা টুকুরো টুকরো মাংসের দলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল রেল লাইনের ঠান্ডা লোহার সঙ্গে! চারপাশে ছড়িয়ে ছিল টাটাকা রক্তের ফুল আলপনা। ছুটে এসেছিল রেললাইনে রাজ্যির কুকুর। কান ফাটিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করেছিলো ঘেঁউ ঘেঁ…উ… ঘেঁ….ঊ…..। কী ছিল সেই চিৎকারের ভাষা, কেউ অনুবাদ করতে পারেনি।
শুনেছেন আসগর আলী, প্রায়ই মোমিন আলী রেল লাইনের পাশে বসে রেলের পাতের দিকে চেয়ে থাকতো। ও কি রেলের পাতের ধার দেখতো! নিজের মনে সবুজ ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে দিয়ে চিবাতো আর গানের সুর ভাজতো, ও নদীরে… একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…। পরের লাইনে গাইতো ও রেল লাইনরে… কোথায় তোমার বাড়ি …। নদীর সঙ্গে রেল লাইন জুড়ে দিয়ে গান?
আসগর আলী জানেন, পুত্র মোমিন আলী প্রতিভাবান। কিন্তু প্রতিভার কোনো বিকাশ হয়নি। এ কেমন যন্ত্রনা, পছন্দের এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলো না বলেই প্রতিভা বিসর্জন? রেল লাইনের উপর থেকে বাড়িতে ধরে এনে রুমে আটকে রাখতেন আসগর আলী। তিনি জানেন, একটা সন্তানেরও মালিক নন কিন্তু মমতা মায়া আর স্নেহের করুন রসে তিনি এতোটা সিক্ত থাকতেন যে, প্রত্যেক সন্তানকে মনে হয় আত্মার প্রতিধ্বনি। মাঝে মাঝে আসগর আলীর প্রশ্ন জাগে, স্ত্রী মাসুমা খানম মৃত্যুর আগে গোপন জগতের দরজা খুলে দিলেন কেন? যেমন বন্ধ ছিল বা রেখেছিলেন নিশ্ছিদ্র কলসী সেই রকম রাখলে কি ক্ষতি হতো? বুকের ভেতরের এই অন্ধ এস্রাজের কুহক নৈঃশব্দ্য যন্ত্রনার কাঁটার উপর রাখে। রাতের ঘুমটা হারাম হয়ে গেছে। সারাজীবন কাকের সংসারে কোকিলের ছানা লালন পালন করলেন! ছোট ভাই কেরামত আলী গ্রামে থাকে, সেখানে সংসার পেতেছে, সংসারে তিন মেয়ে তিন ছেলে। এতোগুলো সন্তানের জনক কেরামত আলী? আর নিজে? শূন্য? শূন্যের মাঝেই বসবাস করে গেলাম আমি আসগর আলী!
ঘ
ঘুঙুরের শব্দে আধশোয়া আধোঘুমের রাহাত আলীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। কে নাচে এই গভীর রাতে ঘুঙুর বাজিয়ে? রিনিক ঝিনিক নাচ! সত্যি নাচে কেউ আয়নামহলে? আগে তো কখনো আয়নামহলে ঘুঙরের শব্দ শুনিনি। পিতা আসগর আলী কি আয়নামহলে নাচনেওয়ালী এনেছেন? এই লোক, মানে আসগর আলী যাত্রার পাগল ছিলেন। যেখানে যাত্রা হতো, দেখতে যেতেন। যাত্রার নাচনেওয়ালীদের নাচ খুব ভালোবাসতেন তিনি। বিয়ের পর অবশ্য গিয়েছেন কি না, জানা যায়নি। আরও শোনা যায়, যাত্রার এক নাচনেওয়ালী মিস ফুল্লরা খানমকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফুল্লরা খানম যাত্রার মালিক হেমন্ত কুমার চৌধুরীর কাছে অনেক টাকায় বাঁধা ছিলেন…। সেই টাকাটা তরুণ আসগর আলী সংগ্রহ করতে না পারায় মুক্তি পায়নি ফুল্লরা খানম। হায়, সেই ফুল্লরা খানম এখন কোথায়?
রাহাত আলী ঘুম থেকে উঠে বসেন। বিছানা থেকে নেমে চটি পায়ে রুমের বাইরে আসেন। কান পাতেন বারান্দায়…। হ্যাঁ ঘুঙুরের শব্দ পাচ্ছেন রাহাত আলী। মনে হচ্ছে নাচের ঠমকে কাঁপছে পুরোনো দিনের বাড়িটা, আয়নামহল। নিজের রক্তের মধ্যেও এক ধরনের উন্মাদনা অনুভব করেন তিনি। নি:শব্দে ঘুঙুরের শব্দ অনুসরণ করতে করতে এসে দাঁড়ালেন শম্পা সুনয়নার ঘরের দরজার সামনে। দরজা ঈষৎ ভেজানো। ভেতর থেকে আসছে শ্যাম্পেন আলো। শম্পা সুনয়না, মেয়েটির শরীর সাদা ফকফকা। মাথায় প্রচুর চুল। চোখ দুটো ভাসমান লাটিম। বুক জোড়া উদ্যত সাপের কুন্ডলী। মেয়েটা বাকহীন কিন্ত সারাটা শরীরে যৌবনের দ্রাক্ষারসে টইটুম্বর। বুদ্ধিরও একটু আকাল মেয়েটির। সব সময়ে চোখে চোখে রাখতে হয়। নারী পুরুষের ভেদ বা অভেদ বুঝাতে পারে না। বাড়িতে ছেলেরা আসলে নিজেই এগিয়ে যায়, জড়িয়ে ধরতে চায়। বড় দুঃখী মেয়ে, কিন্তু পরিস্থিতি বোঝে না মোটেই। ভেসে যায় সব স্রোত শরীরের উপর দিয়ে। শম্পা সুনয়না মায়ের লিপিস্টিক ব্যবহার করে নিজের ঠোট দুটোকে রক্তমুখ করে তুলছে।
আয়নায় দেখতে পায় সুনয়না একটা মাথা, মাথার পরে মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রক্তাভ ঠোঁটজোড়া নিয়ে এগিয়ে যায়, জানতে ইচ্ছে কেমন হয়েছে, বলো।
ঙ
রাহাত আলী বাথরুমে ঢুকে দেয়ালে ঝোলানো আয়নার দিকে না তাকিয়ে ট্রাউজার খুলে মেঝেয় রেখে শরীরে পানি ঢালতে থাকেন। অনেক দিন পর শরীরের নির্মল অবসাদে ঘুম ঘুম চোখে অনেকক্ষণ ভেজার পর আঃ, কী সুখ! চোখ খুললেন রাহাত আলী। চোখ যায় আয়নায়। অবাক তাকিয়ে, আয়নায় কী দেখছেন?
আয়নায় একটা মেয়ের ধবধবে সাদা উরুসন্ধিতে রক্তের চিকন ধারা…। রাহাত আলী তাকালেন দেয়ালে। নেই কিচ্ছু। আবার চোখ আয়নায়, আবার মেয়েটির উরুসন্ধির টাটকা রক্তের মিহি ধারা নামছে। রাহাত আলী আয়না টাওয়ালে মুছলেন, মোছার সময়ে সেই রক্তাক্ত উরুসন্ধি থাকে না কিন্তু টাওয়াল সরালেই…। মাথার মধ্যে দ্রিম দ্রিম বোম পড়তে থাকে। কী করবেন? বাথরুমের হাঁপাতে থাকেন রাহাত আলী!
আয়না! ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রোধে আহত বাঘের শক্তিতে ঘুষি লাগায় আয়নার উপর, এক দুই তিন চার পাঁচ…। আয়না ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাথরুমের মেঝের উপর। শরীর পরিষ্কার করা দরকার, নিজের বাথরুম থেকে বের হয়ে উপরে পিতার বাথরুমে যান। বাথরুমে ঢুকেই চোখ যায় আয়নায়। সেই দৃশ্য… । আবার ঘুষি, আবার আয়না টুকরো টুকরো…। পিতার বাথরুম থেকে বের হয়ে নিচে ছোট ভাইয়ের বৌ কংকার রুমের সামনে। কংকার রুমের বাইরে ওর বাথরুমে ঢুকে আয়নার দিকে তাকাতেই সেই রক্তাপ্লুত সাদা উরু…। আবার ঘুষি… এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয়…। গোটা রুমে ছড়িয়ে আয়নার টুকরো টুকরো অংশ। নিজে অবশ হয়ে বসে পড়েন মেঝের উপর। আয়নামহলে এ কোন অশরীরী খেলা শুরু হলো! নিজেকে মনে হচ্ছে চামড়া ছেঁড়া একটা বাঘডাসা। ঘুরে বেড়ায় মুরগীর বাজারে কিন্তু একটা মুরগীও মুখে নিতে পারছে না। রাহাত আলী ফিরে আসেন সকালের আলো ফুটবার আগে নিজের রুমে। কিন্তু সকালের আলোয় আয়নামহলের আয়না ভাঙ্গার ঘটনা ছড়িয়ে পরে চারদিকে ঘন্টা বাজিয়ে, আয়নামহলের একটা আয়নাও অক্ষত নেই।
চ
হরিপদ আয়নামহলের সকল ভাঙ্গা আয়না কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে। প্রতি সকালে আসগর আলীর অভ্যাস বাথরুমে ঢুকে নিজের মুখটা দেখা আয়নায়। আয়নামহলে আয়না নেই, কেউ বিশ্বাস করবে? বাড়িতে নতুন আয়না আসে। কিন্তু আসগর আলীর মাথা থেকে বের হতে পারে না, কে আয়নামহলের সব আয়না ভাঙ্গলো? কেন ভাঙ্গলো? আয়নামহলে সত্যি ভূত প্রবেশ করেছে? জীবনে শুনিনি, বাড়ির আয়না ভাঙ্গে ভূতে! তাহলে? কী হবে বাড়ির? নতুন আয়না কী অক্ষত থাকবে?
বাড়ির সবাইকে ডেকে বসেছিলেন আসগর আলী। জানতে চেয়েছেন, আয়নামহলের আয়নাগুলো ভাঙ্গলো কে? নতুন আয়নার কী হবে? আয়নামহলের আয়না বিষয়ে অনেক প্রশ্ন কিন্তু কোনো উত্তর নেই। সবার নৈঃশব্দ্যতার মধ্যে কংকা আবার বলে, আব্বা আপনে বাড়িটা বান্দান।
বাড়ি বান্দান মানে?
ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে দেখেছি, ভূত প্রেত কিংবা খারাপ বাতাস থেকে বাড়ি আর বাড়ির জানমাল রক্ষা করার জন্য ওঝা ডাকতো। সেই ওঝায় বাড়ির চারপাশে মন্ত্র পড়ে তাবিজ মাটির খুঁড়ে মাটির নিচে রেখে দিতো। আর চারদিকে লাল নিশান উড়িয়ে দিতো।
তাতে কী হতো? শম্পা সুনয়নার মা সুলেখা আখতার জানতে চায়।
বাড়ির মধ্যে দেও দানো দৈত্য ভূত প্রবেশ করতে পারতো না। সবাই নিরাপদ থাকতো। কংকা অনুরোধ করে শ্বশুরকে, আব্বা একজন ওঝা আনান।
সঙ্গে সঙ্গে খল খল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে শম্পা সুনয়না। আসগর আলীর রুমে সমবেত সবাই চমকে ওঠে। এতোক্ষণ খেয়াল করেনি শম্পা সুনয়নাকে। ওকে কেউ ডাকেনি। কিন্তু নিজেই কখন এসে বসেছে খাটের এক কোনে হাত পা ছড়িয়ে। ওর মুখে রক্তলাল লিপিস্টিক!
এ্যাই তুই এইখানে কেন? চিৎকার করে রাহাত আলী। ওকে এখান থেকে সরিয়ে নাও। রাহাত আলীর কথা শেষ হওয়ার আগেই শম্পা সুনয়না উড়ন্ত হাঁসের ডানায় ভর করে রুম থেকে বের হয়ে যায় এবং রাহাত আলী মুখ খোলে, আব্বা কংকা যা বলেছে সেটাই করুন। আমারও মনে হচ্ছে বাড়িতে ভূত প্রেত বা পেত্নী একটা না একটা কিছু আছে!
ঠিকাছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আসগর আলী ছোটপুত্রবধূ কংকাকে বললেন, তোমাদের গ্রাম থেকে সেই ওঝা আনার ব্যবস্থা করো।
তিনদিনের মাথায় ওঝা নরেন্দ্র ঠাকুর হাজির। তিনি সেলাই ছাড়া কাপড় পরেন। মাথা ন্যড়া। সারা শরীর উদোম। কপালে চন্দনের টিপ। গোটা বাড়ি তিনবার চক্কর দিয়ে বাসার সামনে আসন গেড়ে বসলেন দুপুরের সময়ে, কারো সঙ্গে কোনো কথা না, শব্দ না, খাওয়া না, গোসল না, দুপুর পার হয়ে বিকেল, বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত, রাত পার হয়ে গভীর এবং সকাল, সকাল শেষ দুপুরে নরেন্দ্র ঠাকুর ধ্যান ভেঙ্গে বললেন, আমার ক্ষমতার মধ্যে সব ভুত আর পেত্নী আইসা গেছে। এখন আমি বাড়ির চারকোনায় চারটে গজাললোহা পুতবো মন্ত্র পড়ে…
আর কিছু না? আসগর আলীর গলায় হাহাকার। আহা, আয়নামহলের আয়না ভেঙ্গে যাচ্ছে। কতোদিন হলো বদনখানি দেখা হয় না। নাপিতের দোকানে গিয়ে বদন দেখতে হয়। বড় হ্যাপা গো জীবনে।
আর কিছু না, নরেন্দ্র ঠাকুর খিনখিনে গলায় উত্তর দেন।
কংকা নরম গলায় বলে, কাকা লাল নিশান…
নরেন্দ্র ঠাকুর মৃদু হাসেন, নারে মা। আমার গননায় আমি যা পাইলাম, সেটাই তো করবো, নাকি? গননার বাইরে কেনোকিছু করার ক্ষমতা আমার নাই।
বাড়ির চারকোনায় চারটে গজাললোহা মন্ত্র পড়ে পুঁতে দিয়ে চলে গেলেন নরেন্দ্র ঠাকুর। আয়নামহলের সবার মধ্যে স্বস্তি ও সাহস ফিরে এলো। পরের দিন হরিপদ বাড়িতে নতুন বিদেশী আয়না এনে সকলের বাথরুমে লাগিয়ে দেয়। যার যার রুমে ড্রেসিং টেবিল ছিল নতুন করে এলো। আয়নামহল নতুন আয়নায় আলোড়িত। রাতে সবাই নিশ্চিতমনে ঘুমুতে যায়। কিন্তু সকালে উঠে দেখতে পায় আয়নামহলের সকল আয়না টুকরো টুকরো…। আবার বিষাদগ্রস্থ সবাই। তাহলে কী আয়নামহলের কেউ আর আয়নায় মুখ দেখতে পাবে না? আয়নামহলে নতুন আয়না আনে, লাগায়, সকালে টুকরো টুকরো দেখতে পায়।
ছ
এক রাতে নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে রাহাত আলী ডান হাতের উল্টোপিঠ দেখছে আর কাঁদছে। আহারে সুন্দর হাতটা, হাতের চামড়া থেতলে হাড় মাংস বের হয়ে গেছে। নাড়াচাড়া করলে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। হাতের যন্ত্রনায় নিঃশব্দে কাঁদে। আয়নামহলের কেউ কান্নার শব্দ শুনলে কারণ জানতে চাইবে, কারণ জানাতে গেলে হাত দেখাতে হবে, হাত দেখাতে গেলে…।
দরজায় একটা শব্দ হলে ঘুরে তাকায় রাহাত আলী। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে শস্পা সুনয়না। মুখে লাল লিপিস্টিক। চোখে কামনার শিখা। ওকে দেখেই চিৎকার দিতে যায় রাহাত আলী কিন্তু শম্পা সুনয়না দরজা বন্ধ করে রাহাত আলীর দিকে আসতে আসতে শরীরের সকল কাপড় এক এক করে খুলতে থাকে। রাহাত আলী দৌড়ে দেয়াল ভেঙ্গে পালিয়ে যেতে চায় কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে রুমটার সব দেয়ালই আয়নায় রূপান্তরিত হয়ে লাল লিপিস্টিকের ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। শম্পা সুনয়না এগিয়ে আসছে, রাহাত আলী হাঁপাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে লাল লিপিস্টিকে মোড়ানো আয়নায় প্রতিবিম্বিত রাস্তার উপর দিয়ে কিন্তু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে শস্পা সুনয়না। দুজনে গড়িয়ে পড়ে লিপিস্টিক চর্চিত টুকরো টুকরো ভাঙ্গা আয়নামাখা রাস্তার উপর।
জ
পরের দিন থেকে আয়নামহলের আর কোনো আয়না ভাঙ্গেনি।