
আমি মৃণালিনী নই : নারীর অন্তর্লীন অন্তর্দহন
হরিশংকর জলদাসের (জ. ১৯৫৫) উপন্যাস `আমি মৃণালিনী নই’ (২০১৪)। এই উপন্যাস পড়া, ভাবা, হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠকের বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পপ্রেমিদের কাছে যে উচ্চতায় সমাসীন তা পরিমাপ করতে যাওয়া বাতুলতামাত্র। কেননা ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা কিংবা মুগ্ধতা এগুলো কোনো যুক্তির ধার ধারে না। পুরো সৃষ্টিকূলই মোহাবিষ্ট। মায়ার কোমল আচ্ছাদনে ঢাকা। আর অমৃতের সন্তানের কী-ই বা এমন ক্ষমতা এর মধ্য থেকে নিজেকে বের করে আনবে? একজীবনে আসলে বেশি কিছুর প্রয়োজনও পড়ে না। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ মানব নামক সত্তাটির সবকিছুতে জড়িয়ে আছেন। তাঁর সৌন্দর্যচেতনা, জীবনবোধ, শিল্পবোধ এসব নিয়ে আমার মতো অর্বাচীনের কথা বলা সাজে না। দুঃসাহস দেখাতেও চাই না। আসলে লম্বা ভূমিকার কারণ আজকের আলোচ্য উপন্যাসটি। এটি পড়তে গিয়ে আমাকে বারবার থেমে যেতে হয়েছে, বিষাদ আমাকে ছেয়ে ফেলেছ। `আমি মৃণালিনী নই’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের আটপৌরে জীবনের কথামালা। যার উপস্থাপনকারী তাঁর স্ত্রী যশোরের ফুলতলি গ্রামের বেণীমাধব রায়ের কন্যা ভবতারিণী। ঠাকুর বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর ভবতারিণীকে তার পুরোনো জীবনের সাথে সাথে নিজের নামটারও ইতি টানতে হয়। রবিবাবু (এই নামে এখানে স্ত্রী স্বামীকে সম্বোধন করে) স্ত্রীর নাম বদলে মৃণালিনী রাখেন। বিয়ের কুড়ি দিনের মাথায় রবিবাবু স্ত্রীকে বলেন :
‘তোমার নাম ভব, মানে ভবতারিণী, তাই না?’
. . .
‘আজ থেকে তুমি ভবতারিণী নও। তুমি আমার মৃণালিনী। আজকের পর এ বাড়ি থেকে তোমার ভবতারিণী নাম ঘুচে গেল। সবার কাছে তুমি মৃণালিনী নামে পরিচয় দিবে।’
এভাবেই বিয়ের পর মেয়েদের পদবী, গোত্র, ঠিকানা, অভ্যাস পাল্টে যায়, বদলে যায়। জলের মতো হতে হয় তাকে। যে পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। নিজেকে এভাবে ভাঙতে পারলেই না সে ভালো মেয়ে হবে। যা-ই হোক, ৯ বছর ৯ মাস বয়সে বিয়ে হয়ে আসা মৃণালিনীর শুরু হয় শহরের অভিজাত, বনেদি, উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সাথে মানানসই হওয়ার লড়াই।
বড় মানুষদের বড় আর বিশাল জীবন, তার জটিল সমীকরণ, আলো-অন্ধকারে ঘেরা বর্ণিল ব্যাপার কখনো মৃণালিনীকে বিস্মিত করেছে, কখনো হাসিয়েছে, কখনো সুখসাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার স্বপ্নের কাছে। রবীন্দ্রনাথের মতো সুদর্শন, গুণবান, কর্তব্যপরায়ন, হৃদয়বান মানুষকে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সহজ-সরল শ্যামল মেয়েটি স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতীই ভেবেছে। এটা হলো মেয়েটির আবেগের কথা। কিন্তু সংসার তার কঠিন জাঁতাকলে পিষ্ট করে মেয়েটিকে ক্রমান্বয়ে এই বোধে ক্ষতবিক্ষত করে যে, সে তার স্বামীর মানসসঙ্গিনী কোনোদিন হতে পারেনি। নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী, আনা তড়খড়, লুসি স্কট, ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা এরা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে শিল্পী রবীন্দ্রনাথের মানসলোকে আবার কখনো বা সীমার লঙ্ঘনও ঘটেছে পরস্পরের সম্মতিতে। একজন দর্শকের ভূমিকায় থাকতে হয়েছে মৃণালিনীকে।
বিয়ের পরপরই স্বামীর অঙ্কশায়িনী হতে হওয়া মেয়েটি ৯ বছরে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আসলে ঠাকুরবাড়ির নিয়ম ছিল নতুন বউ সাবালক হয়ে উঠবে এবং ঠাকুরবাড়ির রীতিরেওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে স্বামীর ঘরে অর্থাৎ দাম্পত্যজীবনে পা রাখবে। কেন যেন রবীন্দ্রনাথ সে নিয়ম ভঙ্গ করেন। তাই দশ বছরেই দাম্পত্যজীবন শুরু হয় মৃণালিনীর। পাঁচ সন্তানের জননী মৃণালিনী ষষ্ঠ সন্তানের মা হতে গিয়ে একদিন পা পিছলে পড়ে যায়। শুরু হয় রক্তস্রাব। এরপর মাসখানেক শয্যাশায়ী থেকে যাপিত জীবনের সমস্ত অপমান, গ্লানি, বঞ্চনা আর স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে পরপারে পাড়ি জমায় সে। মাত্র ২৯ বছরের জীবনে ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা রূপ ধারণ করে আগলে রাখে স্বামী রবিবাবু, পাঁচ সন্তান, ঠাকুর বাড়ির মর্যাদাকে। তাঁর জীবনের একটুখানি দক্ষিণের হাওয়া এনে দিয়েছিল ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ। বয়সে বছর তিনেকের বড়। তাঁর স্বামী অবশ্য তেরো বছরের বড় ছিল। বলেন্দ্রনাথ যক্ষ্মা হয়ে মারা যায় মাত্র আটাশ বছর বয়সে। অকালপ্রয়াত বলুর ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্ম বিদ্যালয় স্থাপন করা। তো রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে স্কুল ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থকষ্টে পড়েন তখন মৃণালিনী তাঁর সমস্ত গহনা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে ধনে নিঃশেষ হয়। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল না বরং আত্মতৃপ্তি ছিল। কেননা মৃত বলুর ইচ্ছেপূরণ হচ্ছে এটা ভেবে।
রবীন্দ্রনাথের সংসারজীবনকে সহজ, সরল, স্বাচ্ছন্দ্যময় করার প্রত্যয়ে আমৃত্যু অবিচল থেকেছে মৃণালিনী। স্বপ্নের কারিগর, মোহন কণ্ঠের অধিকারী, জননন্দিত সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের মনের এক টুকরো কোণে নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। তাই মৃণালিনী ঠাকুর শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসে সে মৃণালিনী নয়, ভবতারিণী । এই প্রতিবাদ বড় কষ্টের…! মৃণালিনীর শেষকথা :
‘আমার প্রাণের দেবতা রবিবাবু। আমার সন্তানের জনক হিসেবে, দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক হিসেবে আমি তাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি আজীবন। সে আমার স্বামী, কিন্তু প্রেমিক স্বামী নয়। তার শরীরের কিয়দংশের ওপর আমার অধিকার ছিল, সম্পূর্ণত নয়। তার মন পড়ে ছিল অন্য নারীতে। সবকিছু বুঝেও আমি প্রতিবাদ করতাম না। মৃণালিনী হয়ে তার ঘর করে গেছি আমি; কিন্তু তার হৃদয়ে মৃণালিনী স্থান পায়নি। দ্রোণাচার্য যেমন গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কাটিয়ে নিয়েছিলেন, আমার স্বামী রবীন্দ্রনাথও আমার ভবতারিণী নাম, যেটায় আমার মৌলিক অধিকার ছিল, সেটা কেড়ে নিয়ে মৃণালিনী নামটি লেপ্টে দিয়েছিল আমার গায়ে। কিন্তু ওই নাম পাল্টানোতেই সারা, ও নামে কখনো রবিবাবু আমাকে সম্বোধন করেনি। এই বেদনা লুকোবার জায়গা নেই আমার। সারাটা জীবন রবিবাবুর মনোতুষ্টিতে কাটল আমার। আমার ভালো লাগার দিকে দৃকপাত করেনি কখনো সে। এই মুহূর্তে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে—আমি মৃণালিনী নই, আমি ভবতারিণী। রবিবাবুর স্ত্রী ছাড়াও আমার নিজস্ব একটা সত্তা ছিল, সেই সত্তার প্রতি রবিবাবু কোনো দিন সুবিচার করেনি।’
একটু বিস্তৃত করেই উদ্ধৃতিটা তুলে ধরলাম। এই উপন্যাসের মূল কথাটা এখানে উঠে এসেছে। বিষয়টা শুধু নাম পরিবর্তনের নয় আসল কথা হচ্ছে মর্যাদাবোধের, আত্মসম্মানবোধের। ভবতারিণীর ব্যথাটা সেখানেই। সম্মান, মর্যাদা, স্বীকৃতি, ভালোবাসা এগুলো কর্তব্য শব্দটির মধ্যে হারিয়ে যায়। কর্তব্যপালন তো থাকবেই কিন্তু মর্যাদার প্রশ্ন উপেক্ষিত হবে কেন? অথচ যুগ যুগ ধরে তাই হয়ে আসছে। তা সে যদু মধু হোক আর রবীন্দ্রনাথের মতো বড় মানুষ হোক—স্বামীনামক সত্তাটা প্রায় এক। এবং একজনের স্ত্রী ছাড়াও যে নারীর আলাদা সত্তা আছে সেটা সমাজ মানতেই চায় না। ভবতারিণী বারবার সেটাই বোঝাতে চেয়েছি তার অভিমানে ভরা প্রতিবাদ দিয়ে।
যাই হোক, একদিক থেকে ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলের সচিত্র প্রতিবেদন লেখাটি। এই বাড়িটি বাঙালি সমাজের বিশেষ আগ্রহের। কেননা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার আকর ছিল এটি। বাঙালি সমাজের মননগত তথা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক যে পরিবর্তন বা আধুনিক হয়ে ওঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা ছিল ঠাকুর বাড়ির। আলো আর অন্ধকারের সেই জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ লেখাটি। অন্ধকার বলার কারণ কিছু তো অনভিপ্রেত ঘটনা ঠাকুর বাড়িতে ঘটেছিল। সংস্কারমুক্ত হওয়ার মানসে কোথাও কোথাও সংস্কার অগোচরে বা গোচরে রয়ে গিয়েছিল। সবই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। পৌত্তলিকতার বিরোধিতা, কট্টর পর্দা প্রথা, পুরুষতান্ত্রিকতা, রিরংসাবৃত্তি, আভিজাত্যের অহংবোধ, জরা, ব্যাধি, শোক, ক্ষমতার দম্ভ, স্বার্থপরতা,দারিদ্র্য—এমন সব আটপৌরে ঘটনার সাথে মহাজীবনের যোগ ঘটিয়ে উত্তম পুরুষে আখ্যান বর্ণিত হয়েছে। আত্মজীবনীটি পুত্র রথীন্দ্রনাথের কাছে দিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর পূর্বে মৃণালিনী। এমন তথ্য উপন্যাসের শেষ অংশে “রথীর কথা” শিরোনামে তুলে ধরা হয়েছে।
আখ্যানের সত্যনিষ্ঠতাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। কারণ কয়েকজায়গায় সাহিত্যকর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে ঘটনার সপক্ষে প্রমাণ হাজির করা হয়েছে। আবার অন্যদিক থেকেও উপন্যাসটি গুরুত্বের দাবি রাখে। সামাজিকভাবে নিম্ন অবস্থানের একটি মেয়ের মর্যাদাবান পরিবারে বউ হয়ে আসার পর থেকে প্রতিনিয়ত নিজেকে যোগ্য করে তোলার লড়াই হিসেবেও গল্পটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। ভবতারিণী থেকে মৃণালিনীর যে যাত্রা এটা কমবেশি প্রতিটি নারীকেই অতিক্রম করতে হয়। যাত্রার সময়ের চিত্রটা ক্ষেত্রবিশেষে পৃথক হলেও মূল কথাটা এক। পুরুষতান্ত্রিকতার নির্দয় নিষ্পেষণের শিকার নারী। যাকে সমাজ ভেবেছে অপর। কিন্তু তারও যে পৃথক সত্তা আছে তা বোঝাতেই যেন কলম ধরেন লেখক। তাই এই গল্পটি শেষতক হয়ে উঠেছে সকল নারীর আত্মমর্যাদাবোধের প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের উপাখ্যান। আবহমানকাল ধরে চলে আসা সেই আলোর নিচের অন্ধকারকে চমৎকার সুখপাঠ্য গদ্যে এঁকে রেখেছেন কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাস তাঁর `আমি মৃণালিনী নই’ উপন্যাসের শরীর জুড়ে।