
আমার গল্পের জগৎ
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এই সময়ের ১০ জন কথাসাহিত্যিকের গল্পভাবনা। কেন তাঁরা গল্প লেখেন, গল্প লিখে আসলে কী হয়, গল্প কেমন হওয়া উচিত, বাংলা গল্প কতদূর অগ্রসর হল, গল্প নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি, এমন নানা বিষয় নিয়ে ব্যাক্ত করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা। গল্পভাবনার সঙ্গে রয়েছে একটি করে গল্প।
পড়ুন তাপস বড়ুয়ার গল্পভাবনা ও গল্প।
কোনটা গল্প আর কোনটা নয়—এ নিয়ে একবার ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম দু’তিন বছর আগে। ইংল্যান্ডের চেস্টার শহরের প্রধান লাইব্রেরিটি তখন বড় পরিসরে নতুন করে শুরু হচ্ছে। রোমান আমলের বিশাল এক ভবনে অনেকগুলো পাঠকক্ষ ছাড়াও সেখানে একাধিক নাট্যশালা, সিনেমা হল, রেস্টুরেন্ট, বার, মিউজিক স্টুডিও আরো অনেক কিছু রয়েছে এক ছাদের নিচে। আর পুরো ভবনজুড়ে বই। সিঁড়ির গোড়ায়, হাঁটার পথের ধারে, বার কাউন্টারের পাশে, বা সিনেমা হলের দরজার পাশে সব জায়গাতেই বই। পাঠকক্ষগুলোতে তো আছেই। এই নতুন কমপ্লেক্সটির নাম দেয়া হয়েছে “চেস্টার স্টোরী হাউস”। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লাইব্রেরি বা কালচারাল কমপ্লেক্স না বলে এটাকে স্টোরী হাউস নাম দেয়া হয়েছে কেনো? তার উত্তর ছিলো, বই হোক, নাটক হোক অথবা সিনেমা বা গান, সবকিছুই আসলে গল্প বলে। উত্তরটা আমাকে চমৎকৃত করেছিল।
তবু ছোটগল্প তো একটি বিশেষ ধারা। সেটা নিয়েই আজকের লেখা। এখানে আমি শুধু আমার ভাবনাগুলো বলব, গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা বলব, গল্প লেখার অভিজ্ঞতা বলব। আমার গল্পের জগৎ বলতে আমার পড়া গল্পের জগৎ আর আমার লেখা গল্পের জগৎ দু’টোই।
ছোটগল্পের সাথে প্রথম পরিচয়
ছোটবেলায় স্কুলের বাংলা বই আর সহপাঠ চয়নিকার মাধ্যমে আমার সাথে ছোটগল্প নামের যাদুময় জগতের প্রথম পরিচয়। যে দু’একটি গল্প প্রথম আমার মনে দাগ কেটেছিল তার মধ্যে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ইঁদু মিয়ার মোরগ’ আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ’ঝড়ের পরে’র কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। বিশেষত ছন্দ মিলিয়ে লেখা ’সবাই অবাক সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কী/ ভয় কাতুরে মাহবুব আজ এমন সাহসী’ (ঝড়ের পরে) প্রায় মুখস্তই ছিল। চেষ্টা করে দেখলাম, শুরু থেকে বেশ কিছুটা এখনো মনে আছে খুব ছোটবেলায় পড়া সেই গল্প।
ঝড়ের মুখে পড়ে ভীতু, সব অবিচার মেনে নেয়া মাহবুব কিভাবে সাহসী প্রতিবাদী মানুষ হয়ে ওঠে এটা আমাকে সারাজীবনের জন্য একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। সেই থেকে মানুষের ঘুরে দাড়াবার শক্তিতে আমার বিশ্বাস জন্মানোর শুরু হয়তো। তাই তো বড় হওয়ার পথে গোগ্রাসে গিলতে থাকি রাশিয়ান সাহিত্যের বাংলা অনুবাদসমূহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জগদীশ গুপ্তের গল্প, হাসান আজিজুল হকের গল্প; বেশ পরে পড়ি মহাশ্বেতা দেবী, নবারুণ ভট্টাচার্যদের গল্প।
আমাদের যখন প্রবলভাবে প্রভাবিত হওয়ার বয়স, তারুণ্য বা প্রথম যৌবনে, তখন খুলনার দক্ষিণে আমাদের সেই রুপকথার গ্রামে সমসাময়িক কোনো লেখকের লেখা পৌঁছেনি। আমি বলছি আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধর কথা। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায়ই পাশাপাশি তিনটা গ্রামের তৎকালীন তরুণরা মিলে একটা লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। সেই লাইব্রেরির জন্য বই সংগ্রহ করা হয় গ্রামে গ্রামে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে। গ্রামবাসীদের এই উপহার নিয়েই গড়ে ওঠে সংগ্রহশালা ’নবজাগরণ গ্রন্থাগার’ যেটা আমার সামনে ক্লাসিক বাংলা সাহিত্যের বিশাল দরজাটি খুলে দেয়।
আমাদের ওখানে গ্রামে রবীন্দ্রজয়ন্তী এবং নজরুল জয়ন্তী পালন করার একটা রেওয়াজ তখন ছিল। বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে খুব রবীন্দ্র নজরুল পড়তাম। আবৃত্তি, রবীন্দ্র বা নজরুলের উপর কোনো বিষয়ে উপস্থিত বক্তৃতা বা কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। নজরুলের সব গল্প, রবীন্দ্রনাথের গল্পেগুচ্ছের বড় একটি অংশ তখনই পড়ে ফেলি।
তরুণ বয়সে রাশিয়ান সাহিত্যের অনুবাদ পড়তে শুরু করেছিলাম, শুধু রাশিয়ান সাহিত্য নয়; বামপন্থি রাজনৈতিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলায় লেখা অনেক সাহিত্যকর্ম তখন পড়েছিলাম। বিশেষত পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তর দশকের প্রচুর লেখককে আমরা দেখি বামপন্থি চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক গল্প লিখতে। সেইসব গল্পে শ্রেণী সংগ্রামের কথা থাকত, বিশ্বব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা থাকত, একটা স্বপ্নের কথা থাকত। সেটা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ দুই জায়গাতেই। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের এবং ভারতের নকশালবাড়ী আন্দোলনের প্রভাব সেখানে ছিল। সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে সাহিত্য—এটা আমাকে আলোড়িত করে স্কুলে-কলেজে পড়ার বয়সে।
ইনটারমিডিয়েটে পড়ার সময় কলেজের একজন বাংলা শিক্ষক পুরো সময় ধরে দু’টি কবিতা আর দু’টি গল্প পড়িয়েছিলেন। বাংলার অন্য শিক্ষক পড়িয়েছিলেন সিলেবাসের অন্য সবকিছু। প্রথমে উল্লেখ করা সেই শিক্ষক অনেক দিন ধরে যে দু’টি গল্প পড়িয়েছিলেন তার একটি রবীন্দ্রনাথের ’হৈমন্তী’ আরেকটি শরৎচন্দ্রের ’বিলাসী’। গল্প যদি কিছুটা হলেও বুঝে থাকি, সেটার শুরু ওখান থেকেই।
কাকে বলি ছোটগল্প
ছোটগল্পকে সঙ্গায়িত করতে গিয়ে প্রায়ই আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করে থাকি ’ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা/ছোটো ছোটো দুঃখকথা/নিতান্ত সহজ সরল, /সহস্র বিস্মৃতিরাশি/প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/তারি দু-চারটি অশ্রু জল।/নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা, /নাহি তত্ত্ব/নাহি উপদেশ।/অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ (বর্ষাযাপন / সোনার তরী)।
হ্যাঁ, ছোটগল্প ছোট। কলেবরে ছোট, কাহিনীর ব্যাপ্তিতে ছোট। কিন্তু গভীরতায় ছোট নয়। আমার কাছে মনে হয় সুক্ষ্ম এবং সুনির্দষ্ট লক্ষ্যভেদী গদ্য-কাহিনী হচ্ছে ছোটগল্প।
আমি ছোটগল্পকে ’ইউনিপোলার’ একটা কাহিনী হিসেবে দেখতে চাই। কারণ, আমি মনে করি যে ছোটগল্পের কাহিনী একটা ঘটনা বা একটা আবেগকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। কতকটা নাগরদোলায় দোল খাওয়ার মতো। ঘুরছি কিন্তু সরছি না; একটা কিছুকে কেন্দ্র করেই সমস্ত চলাচল। সাংবাদিকতায় ফিচার লেখার ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়, একটি মাত্র কেন্দ্রীয় আবেগ (সেন্ট্রাল ইমোশন) থাকবে, সেটাকে ঘিরেই পুরো লেখাটি তৈরি হবে। ইংরেজিতে বলা হয় ’সুইঙ্গিং এরাউন্ড দ্য মে পোল’। অন্যসব ঘটনা, অন্যসব আবেগ ওই আবেগটিকে তুলে ধরার কাজে লেখককে সহায়তা করবে।
আমি যখন গল্প লিখি এই বিষয়টি সবসময় মনে রাখার চেষ্টা করি, নাগরদোলায় দোল খাওয়ার মতো একটা অনুভূতি যেন থাকে। অর্থাৎ সবকিছুর কেন্দ্রে যে আবেগ, যে ঘটনা বা যে বিষয়টি আছে তার ভিত্তিতেই, তার চারিপাশে সবকিছু যেন আন্দোলিত হয়। সবকিছু ঘুরেফিরে ওটাকেই প্রমিনেন্ট করছে; অন্য সবকিছু অপেক্ষাকৃত নিষ্প্রভ হয়ে থাকছে ওটাকে উজ্জলতর দেখানোর জন্য। একটি অনুভূতিকে বা আবেগকে, একটি ঘটনাকে, উজ্জ্বলতর করে তোলার জন্য অন্য ঘটনাগুলোকে, আবেগগুলোকে আপেক্ষিক অনুজ্জ্বল করে উপস্থাপন করার যে মুন্সিয়ানা সেটাকেই আমি মনে করি ছোটগল্প লেখকের সবচেয়ে বড় মুন্সিয়ানা। অবশ্যই সেটি ঘটনা, চরিত্র ও প্রেক্ষাপট এসবের আন্তঃসংযুক্ততাকে অক্ষুন্ন রেখেই।
উপন্যাসের সাথে গল্পের পার্থক্য বোধহয় এখানেই। উপন্যাস বড় পরিসরের ব্যাপার। পাশ্চাত্যে তো নভেল লেন্থ ফিকশন বলতে অন্তত সত্তর হাজারের মতো শব্দের ফিকশনকে বোঝানো হয়। এর চেয়ে ছোট লেখাকে, যেগুলো আমাদের উপন্যাসের বাজারে বেশি দেখা যায়, সেগুলোকে নভেলেট ইত্যাদি বলা হয়। উপন্যাসে অনেকগুলো ঘটনা, অনেকগুলো আবেগ, এমনকি অনেকগুলো চরিত্রও প্রধান হয়ে উঠতে পারে। ছোটগল্পে সাধারণত তেমনটা ঘটে না।
গোগ্রাসে গল্প পড়া
২০১০-এ আমি যে চাকরিটিতে যোগ দিই আমার বাসা থেকে সেখানে যেতে চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগতো শাটল বাসে। ব্যাগে তো বই থাকতোই; পড়তাম। কয়েকদিনের মধ্যেই মনে হলো এই সময়ের মধ্যে পড়ে শেষ করা যায় এমন কিছু একটা হলে ভালো হয়। না হলে অফিসে বসে বই খুলতে ইচ্ছে করে অসমাপ্ত কাহিনীটি পড়ে শেষ করার জন্য।
একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ’চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা’ সিরিজের প্রায় সবগুলো” শ্রেষ্ঠগল্প” সংকলন এবং সাথে ’চিরায়ত গ্রন্থমালা’ সিরিজের কিছু বিদেশী ছোটগল্পের সংকলন কিনে নিয়ে আসলাম। সেই থেকে গোগ্রাসে ছোটগল্প পড়ার শুরু। হাতের কাছে (বাজারে বা লাইব্রেরীতে) ছোটগল্পের বই পেলেই উল্টেপাল্টে দেখেছি। ভালো লেগে গেলেই সংগ্রহ করেছি, পড়েছি।
সেই চাকরীটা সাড়ে পাঁচবছর করেছিলাম। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে আর বিকেলে ফেরার পথে পঁয়তাল্লিশ মিনিট করে ছোটগল্প পড়েছি। এর ব্যতিক্রম খুব কমই হয়েছে।
এর আগে বা পরেও অন্য পাঠকদের মতো আমি উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধের সাথে ছোটগল্পও পড়েছি, পড়ছি। কিন্তু এই সাড়ে পাঁচ বছর আমার ‘ছোটগল্প পড়ার মৌসুম’ ছিল।
ছোটগল্প লেখার চেষ্টা
সেই অফিসেই আমাদের একজন সহকর্মী ছিলেন। সরকারী কর্মকর্তা। ‘লিয়েন’ নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। মাগুরার নবগঙ্গাপাড়ের মানুষ। তার বাড়ির কাছে এক বৃদ্ধ নবগঙ্গা নদীতে স্নান করতে নেমে দশ কেজির বেশি ওজনের একটি চিতল মাছ ধরে ফেলেন পরনের লুঙ্গিতে পেঁচিয়ে। ২০১৪ সালের কথা। খবরটা পত্রিকায় দেখে ওনার সাথে মজা করছিলাম যে পরনের লুঙ্গি দিয়ে মাছ ধরলে তখন পরা ছিলো কী!
এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে এই বিষযটি নিয়ে গল্পলেখার চিন্তা মাথায় আসে। তার কয়েক বছর আগে ভারতের ক্যানিং-এ গিয়েছিলাম। এ দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে যাওয়া অনেক মানুষ ওসব দিকে থাকেন। তাদের কেউ, ধরুন বাড়ি ছিল নবগঙ্গার তীরে, খবরটা দেখলে তার কেমন অনুভূতি হবে—সেটাই লেখার পরিকল্পনা করি। ধরে নিই, আমার গল্পের প্রধান চরিত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় রিফিউজি হিসেবে ভারতে যান এবং সেখানেই থেকে যান। সুতরাং আমার দরকার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ওই গ্রাম, ওই এলাকা কেমন ছিল তার একটা ধারনা। সাথে এলাকাটির বর্তমান ছবি। আমাদের সেই সহকর্মীর সাথে বারবার কথা বলে, গুগল ম্যাপ দেখে তার ছোটবেলার গ্রাম আর এখনকার গ্রামের একটা ধারণা নেয়ার চেষ্টা করি। তখন খবর পাই, ’গাঁয়ের নাম পরমেশ্বরপুর, গাঙের নাম নবগঙ্গা’ নামে একটা বই আছে কলকাতায়। বিশাল সাইজের সেই বই কলকাতা থেকে এনে দেন এক বন্ধু যার নিজের বাড়ীও ওই এলাকায়।
আমি চেয়েছিলাম কাল্পনিক কাহিনী, কাল্পনিক চরিত্র, কিন্তু বাস্তব পটভূমি। আরকে নারায়ননের প্রায় সব লেখাই তার কল্পিত এক জনপদের প্রেক্ষাপটে, সেকথা জানতাম। তবু সাহস করিনি পটভূমিটাও কাল্পনিক করতে এই ভয়ে যে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে সেটা না অনেক দূরে চলে যায়।
তারপর এক রাতে সাহস করে বসে যাই লিখতে। কল্পনা-বাস্তবতা মিলিয়ে সিজোফ্রেনিক এক বাস্তবতার ছবি আঁকি। আমার সেই প্রধান চরিত্র একবার বাস্তবে ফিরে আসেন আর একবার সিজোফ্রেনিক এক জগতে ঢুকে যান। নিজের অতীতে, বর্তমানে আর এই দুইকে অতিক্রম করে এক কল্পনার জগতে বিচরণ করতে থাকেন শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং-এ যাওয়ার পথে ট্রেণে বসে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার শব্দের সেই গল্পের নাম দিই ’নবগঙ্গার চিতল’।
তারপর সাহস নিয়ে আরো কিছু গল্প লিখি। কিছু গল্প প্রকাশিতও হয়। মানুষের জীবনে ঘটা ঘটনার চেয়ে মানুষের মনে সেইসব ঘটনার প্রভাব আমার গল্পের মূল বিষয়। একজন মানুষের জীবনে যে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের বাইরেও আরো ‘কাল’ থাকে, আরো আরো অসংখ্য জগতে, অসংখ্য জীবনে সে যে একই সাথে বাঁচে, আমার অনেক গল্পে সেটাকে উপজীব্য করেছি বারবার। এজন্যে আমার কিছু গল্পের মূল চরিত্র সিজোয়েড পারসোনালিটির। তারা সামাজিক জীবন এড়িয়ে চলতে চায়। ভিতরে প্রচন্ড আবেগ; কিন্তু তারা সেটা ততটা প্রকাশ করে না; অথবা সেটা কিভাবে প্রকাশ করা যায় সেই কৌশল রপ্ত করতে পারেনি। কেউবা আবার বাস্তব জীবনের পাশাপাশি কল্পিত একটা জীবনেও বাস করে মনে মনে। ঠিক সিজোফ্রেনিক নয়; কিন্তু কতকটা ওই ধাঁচের মানসিক গড়ন।
এই হচ্ছে আমার দ্বিতীয় পর্বের গল্পলেখা শুরুর কথা। দ্বিতীয় পর্ব বলছি কারণ ছাত্রজীবনে বেশ কিছু গল্প বিভিন্ন সময়ে লিখেছিলাম স্কুল কলেজের গল্পলেখার প্রতিযোগিতার জন্য বা বার্ষিক প্রকাশণার জন্য। সেসব এখন আর কাছে নেই।
আকাশ ভরা সূর্য তারা
বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ সব ছোটগল্প লেখা হয়েছে। লেখকদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যাদের কাউকে বাদ দিয়ে কারো নাম করা কঠিন। আমার পছন্দের তালিকায় হাসান আজিজুল হক, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুবোধ ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু (পরশুরাম), আবুল মনসুর আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এবং আরো অনেকে রয়েছেন।
উপন্যাস লেখক পরিচিতির আড়ালে ছোটগল্প লেখক হুমায়ুন আহমেদ প্রায় চাপা পড়ে গেছেন। কিন্তু তার ছোটগল্পের সম্ভার অসাধারণ। তার অধিকাংশ উপন্যাস যথেষ্ট গভীর নয় বলে তার ছোটগল্পকে যে পাঠক দূরে সরিয়ে রাখছেন, তিনি চমৎকার কিছু গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন।
সৈয়দ শামসুল হকের গল্প আমার খুব পছন্দ। অসাধারণ তার গল্প – বিষয়বস্তু নির্বাচন, কাহিনীর বিন্যাস, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন সবকিছু মিলে। ধরুন, মঈনুল আহসান সাবের এর ’বৃত্ত’ বা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ’রস’ গল্পের কথা। এমন গল্প পড়ার পরে কখনো ভোলা যায়? প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ’ফুলের মূল্য’ বা ’বাসব বাবুর মুড’ সেই কবে পড়েছি, এখনো মনে গেঁথে আছে। আবুল মনসুর আহমেদের রিলিফ ওয়ার্কের সেই হামিদ তাকে ভুলি কী করে। আর ’আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর বৃদ্ধের শেষ কথাগুলো; কিংবা দেশ নিজের পয়ে দাঁড়ানোর সময় পা-টা গরীবের বুকের উপর রাখছে কিনা অন্য একটি গল্পে হাসান আজিজুল হকের সেই প্রশ্ন।
নাসরিন জাহান, শাহাদুজ্জামান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, স্বকৃত নোমান, অদিতি ফাল্গুনী, রাশিদা সুলতানা, ইমরান খান, ইমতিয়ার শামীম, মারুফ ইসলাম, নাজনীন সাথী সহ অনেকের লেখাই আগ্রহের সাথে পড়ি।
ঋত্বিক ঘটকের ও জীবনানন্দ দাশের গল্পও খুব পছন্দ আমার। গল্পের সংখ্যা অল্প হলেও এরা দু’জনই চেতনার অন্য একটা স্তরে, একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যান পাঠককে। একটা বয়সে কাজী নজরুল ইসলামের সেই প্রচন্ডরকম আবেগমথিত ছোটগল্পগুলো প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। পরে একটা সময়ে এসে শওকত আলীকে ভালো লেগেছে, সেলিনা হোসেনকে ভালো লেগেছে; ভালো লেগেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শীর্ষন্দু মুখোপাধ্যায়দের গল্প, প্রচেত গুপ্ত বা স্বর্ণময় চক্রবর্তীর গল্প।
খুব পরিচিত নন এরকম কিছু গল্পকারের কিছু লেখা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি পড়েছি। তাদের বইগুলো হয়তো বাজারে খুব বিক্রি হতো না বলে নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বা পল্টনের ফুটপাতে বিক্রি হতো খুবই কম দামে। অসাধারণ কিছু গল্প আমি সেখানে পেয়েছি। একটা বইতে সবগুলো গল্প ছিলো নদীভাঙা মানুষের জীবনযুদ্ধ নিয়ে। লেখক বা বইয়ের নাম এখন আর মনে নেই।
বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) আর জহির রায়হানের কাছে পাঠ নিয়েছি ছোট ছোট গল্পে কখনো কন্ট্রাস্ট, কখনো ব্যালান্স, কখনো শেষ মুহুর্তের টুইস্ট সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরার। আমার প্রথম বই ’চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ’-এ এরকম বাইশটা গল্প রয়েছে। গল্পগুলোর কলেবর প্রায় একই রকম। বারোশো শব্দের এদিক ওদিক। বনফুলের গল্পগুলোর গড়ন আমাকে প্রচন্ড আকর্ষণ করে। অল্প কথা, ছোট্ট ঘটনা; কিন্তু বিশাল মেসেজ। খুব ছোট পরিসরে, খুব স্ট্রাইকিং, একেবারেই মনে দাগ কেটে যায়, চিন্তায় ধাক্কা মারে সেরকম লেখা আমি বনফুলের কাছে গেলেই পাই। জহির রায়হানের কিছু গল্পেও তেমনটা দেখি।
খুব সম্ভবত স্যামুয়েল কোলরিজ-এর ’দি এনসিয়েন্ট মেরিনার’ আর সমারসেট মম-এর ’গিফট অফ দ্য মেজাই’ আমার খুব মনযোগ দিয়ে পড়া প্রথম ইংরেজী ভাষার গল্প। ইন্টারমিডিয়েটে পাঠ্য ছিলো।
এর আগে থেকেই কিছু রাশিয়ান ও অন্য ভাষার লেখার অনুবাদ পড়েছি। এককভাবে বোধহয় আন্তন চেখভের গল্পই সবচেয়ে বেশি পড়েছি বিদেশী লেখকদের মধ্যে। টলস্তয়, গোর্কী, দস্তয়ভস্কির-গল্প অবশ্যই সাথে ছিল। গ্রগতি-র আর রাদূগা-র অনুবাদকদেরই কৃতিত্ব অনুবাদ পড়ায় আগ্রহ ধরে রাখার জন্য।
এছাড়া এ্যালান পো, জ্যাক লন্ডন, ও’ হেনরী, মার্ক টোয়েন, সমারসেট মম – এর গল্প পড়েছি, পড়ি। আর বিদেশী সাহিত্যিকরা বড় কোনো পুরষ্কার পেলে তখন তাদের লেখা বাংলায় অনুদিত হয়; সেগুলো পড়ি। এই ধারার প্রথম যে সংকলনটি পড়েছিলাম সেটার নাম ছিলো ’ন্যাডিন গর্ডিমারের গল্প’।
জর্জ স্যান্ডার্স এই সময়ের ইংরেজী ভাষার ছোটগল্প লেখকদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। এছাড়া আগ্রহ নিয়ে পড়ি ঝুম্পা লাহিড়ি, রবার্ট ওলেন বাটলার, সারা হল, জন ম্যাকগ্রেগরসহ অনেকের গল্প।
কাফকা ও আমি
শেষ একটা তথ্য না দিলে আমার (পড়ার এবং লেখার) গল্পের জগতের বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ফ্রানৎস কাফকা-র লেখা আমার খুব পছন্দ। কেনো জানি মনে হয়, তাঁর ’বিফোর দ্য ল’ গল্পটি যদি না পড়তাম, তাহলে হয়তো গল্প লিখতে এতটা আগ্রহী হতাম না।
গল্প : হয়তো সে তুমি শোন নাই
হয়তো সে তুমি শোন নাই
সহজে বিদায় দিলে তাই
জনমের মত হায় হয়ে গেল হারা…
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১.
ও ব্যাটা, টান দেবা নাহি? কি দ্যাহ কও দি ওদিকি চা’য়ে?
সম্বিত ফেরে হরির। হরিপদর। মাছের ডিপোর দরজায় বসে সালাম শেখ ডাকছে তাকে। বেলা প্রায় এগারোটা। ডিপো বন্ধ করবে সে। সকাল থেকে যত মাছ কেনা হয়েছে সব নিয়ে সে যাবে খুলনার আড়তে। তার আগে একটা বিড়ি দুজনে ভাগ করে খাবে। এটা মোটামুটি দৈনন্দিন নিয়মের মতো হয়ে গেছে।
গোপাল বিড়ির প্যাকেট বের করে শেষ বিড়িটা ধরায় সে। দু’টান দিতে দিতে হরিও এসে যায়—‘দ্যাও’। হরির হাতে বিড়ি দিয়ে ডিপোর ঝাঁপ নামায় সে। তারপর ভ্যানে তোলে মাছের ঝুড়ি। ভ্যানওয়ালা ভ্যান ঠেলে এগিয়ে নেয়। ওরা হাঁটে পেছন পেছন। এভাবে হেঁটে অসম বয়সী দুই বন্ধু যাবে বামুনডাঙ্গার স্লুইজ গেইট পর্যন্ত। প্রতিদিনই তাই যায়। তারপর হরিপদ ছোট রাস্তা ধরে নেমে যাবে তার বাড়ির দিকে। সালাম ভ্যানে উঠে রওয়ানা হবে শহরের উদ্দেশ্যে।
সালামের ডিপো ওয়াপদা রাস্তার পাশে। নদীর পাড় ধরে বড় রাস্তা চলে গেছে উত্তর-দক্ষিণে। গ্রামগুলো একটু ভিতরে। বড় রাস্তা থেকে ছোট ছোট রাস্তা নেমে গেছে এক একটা গ্রামকে সাথে বড় রাস্তার সাথে যুক্ত করতে। যে রাস্তাটি চকডিহি গ্রামের দিকে চলে গেছে বড় রাস্তার সাথে তার সংযোগস্থলে একটা বটগাছ। বটগাছের গোড়ায়, সালামের ডিপোর মুখোমুখি, একটা দোকান। চকডিহির অধীরের। রাস্তার ধারে, উত্তরে বা দক্ষিণে, অনেক দূর পর্যন্ত আর কোন ঘরবাড়ি নেই। দূর থেকে দেখলে একটা মন কেমন করা ভাব জাগে।
‘যাই তা’লি’—বলে হরিপদ বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। যাবে ঘোনাপাড়া। আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরে। এটুকু দূরত্বকে কিছু মনে করে না এখানকার মানুষ। এমনিই হাঁটে। এখান থেকে গিয়ে মাধেনি অর্থাৎ সকালের খাবার খাবে কাচি দুপুরে। মানে সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে। তারপর যাবে সঞ্জিতদের বাড়ি। কাল সকালে গলদা ধরা হবে কিনা তা জানতে হবে। কারো পুকুর অথবা ঘের থেকে হরিপদ নিজ উদ্যোগে মাছ ধরে আনে। মাছ ধরার জন্য কোন টাকা সে পায় না। সেই মাছগুলো কিনতে পারে এটাই লাভ। দু’পাশে ধানক্ষেত রেখে হরিপদ হাঁটতে থাকে।
২.
বরইতলার বড় বিলের শেষ মাথায় খালপাড়ে ছোট্ট এক টুকরো জমি। বিলাস পৈত্রিক উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছিলো। এ জমির প্রতি তার ভীষণ ভালোবাসা। এখন বয়স হয়েছে। নিজে মাঠে কাজ করতে পারেন না। ছেলেকে তাড়া দেন, ‘জমির মালঞ্চ বাছতি যাতি কলাম, গেলি নে তো?’ হরিপদ বলে, ‘যাবানি’। ‘যাবানি যাবানি তো করতিছিস কয় দিন ধরে।’ হরিপদ আর কিছু বলে না। বেরিয়ে যায় সঞ্জিতদের পুকুরের উদ্দেশে। এই গোনে মাছ ধরতেই হবে। গোন মানে আমাবস্যা বা পূর্ণিমার ঠিক আগের কয়েকটা দিন। এরপর চিংড়ি খোলস ছাড়বে। নরম চিংড়ি বাজারে চলবে না। পরবর্তী গোনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সঞ্জিতদের বাড়িতে এসে মেজাজটা বিগড়ে যায় হরিপদর। ‘কী কচ্চ কী? ফশুদিন কথা কয়ে গেলাম আর তুমি মাছ দিয়ে দিলে পঞ্চারে।’ সঞ্জিত বলে, ‘তুমি তো নেচ্চ সবসময়। ও ধল্লো খুব করে তা এবার ও নিক। সামনের গোনে দেবানি তোমারে।’
সঞ্জিত কথা বাড়ায় না। জানে এবার মাছ আর সে কিনতে পারছে না। কথা বাড়ালে বরং স্থায়ীভাবে ব্যবসা হারানোর ভয় আছে। পঞ্চা বা পঞ্চানন ব্যাপারি রেট বেশি দিয়েছে অথবা অ্যাডভ্যান্স বেশি দিয়েছে, তাই মাছ পেয়েছে। সঞ্জিত যতই বলুক এর পিছনে আর কোন কারণ নেই, ‘পঞ্চা ধল্লো তাই’।
তার মানে এ গোনে অন্য পুকুর বা ঘের খুঁজে বের করতে হবে মাছ কেনার জন্য। অন্যমনষ্ক হাঁটতে থাকে হরিপদ।
বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে গেছে সরু নালার মতো একটা খাল। সেখানে বাধা আছে ছোট্ট ডিঙি নৌকা। বারান্দার চৌকির নিচে থেকে বৈঠা টেনে বের করে সে। নৌকা খুলে বাইতে থাকে খাল ধরে। পাড়াটা রেখে একটু এগোনোর পরে খালটা ঢুকে যায় ধানক্ষেতের পেটের মধ্যে। মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত। তার মধ্য দিয়ে জালের মত বিছিয়ে আছে খালগুলো। রাস্তাঘাট হওয়ার আগে এগুলোই ছিল বর্ষার দিনে এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামে যাতায়াতের পথ। এখন রাস্তাঘাট হয়েছে। যাতায়াতের জন্য খালের ব্যবহার কম। কিন্তু কৃষির প্রয়োজনে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনে খালই ভরসা। এই খাল দিয়েই ধানের চারা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় আষাঢ়-শ্রাবণে; আবার নৌকা ভরে পাকা ধান নিয়ে আসা হয় অগ্রহায়ণ-পৌষে। নৌকায় বসে দু’পাশের ধানক্ষেত ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। খালের দুপাশ থেকে কলমি আর মালঞ্চ এসে খালটাকে ঢেকে ফেলতে চাচ্ছে। দুপাশ থেকে কলমির কচি ডগা এসে খালের মাঝ বরাবর ভেসে আছে জলের ওপর। এই কলমির স্বাদ একবার যে পেয়েছে, তার জিভে জল আসবেই। অন্যদিন হলে হরিপদ কলমি তুলতো। খলসে মাছ দিয়ে কলমির ভাজা আর তরকারির মাঝামাঝি একটা কিছু মা রান্না করে। হরিপদর খুব পছন্দ। আজ আর কলমি তোলার কথা মনে হয় না হরিপদর। অলস হাতে বৈঠা বাইতে বাইতে এগোতে থাকে। খালের মোহনায় এসে সে নৌকাটাকে বাঁদিকের খালে ঢুকিয়ে দেয়। বুড়োটা বলছে এত করে—আজ ধানক্ষেতের কলমি-মালঞ্চ সরাবে। বরইতলার জমিতে ধানের চারা লাগানো আর পাকা ধান তোলার মাঝখানে কোন পরিচর্যা লাগে না। প্রকৃতি এখানে অকৃপন, উদার। অধিকাংশ কৃষক এই সময়ে একবারও জমির দিকে যায় না। জমির মালিকদের জন্য এটা ভালো হলেও গরিব শ্রমজীবীদের জন্য এ বড় কষ্টের কারণ। ধান লাগানোর পর থেকে ধান তোলার মাঝখানের ক’মাস গরিব মানুষের কোনো কাজ থাকে না। অলস সময় কাটে কষ্টে। মহাজনের কাছে ব্যাজে ধান আনতে হয়। অশ্বিন কার্ত্তিকে একমণ ধান নিলে অগ্রহায়ণ-পৌষে দেড় মণ দিতে হয়। সেই ধান পাওয়াও সহজ নয়। বিশেষত যাদের জমি নেই অর্থাৎ মৌসুমে যাদের ঘরে ধান উঠবে না, তাদেরকে ব্যাজেও কেউ ধার দেয় না। খেয়ে না খেয়ে থাকে তারা। বড় কষ্টের এই অলস সময় কাটে ঘিরেস্তদের অর্থাৎ সম্পন্ন গৃহস্থদের বাড়ি কীর্ত্তন গান, মনসার ভাষান এসব শুনে।
দু’খানা কাঁচি বা হেসো, ছোট্ট একা ঝুড়ি, মাছ রাখার খালুই, খেওলা জাল, এসব সবসময়ই থাকে এদের নৌকায়। গামছা পরে কাঁচি নিয়ে নেমে পড়ে সে। খালপাড়ের জমি নিয়ে যে কী ঝামেলা! কলমি-মালঞ্চ ছুপে খরেছে খালের পাড় ধরে দু’তিন লাইন ধান গাছ। প্রায় দু’ঘণ্টার পরিশ্রমে সে মোটামুটি খালপাড়ের অর্ধেকটা জায়গার কলমি-মালঞ্চ সরাতে পারে। এইসব কাটা কলমি থেকেই আবার নতুন ডগা বেরোবে। আবার ছুপে ধরবে ধানের চারা। মাসখানেক পরে আবার আসতে হবে। হঠাৎ দেখে একটা জায়গায় জলটা লাল। রক্ত গুলে আছে জলে। নিজের দুই হাত তুলে চোখের সামনে ধরে সে। না কাটেনি। কাটলে অবশ্য ব্যথাও পেত। এদিক-ওদিক তাকায় সে। কলমি কাটার সময় কলমিতে জড়ানো একটা বোড়া সাপ কেটে গেছে। কাটা সাপের মাথার অংশটা পাক খেয়ে খেয়ে সামনে এগোচ্ছে। আর লাল রঙ ছড়াচ্ছে জলে। গাটা ঘিন ঘিন করে ওঠে। থু করে থুথু ফেলে সে। নৌকায় উঠে পড়ে। আজ আর কাজ করবে না। একটু দূরে এসে খালেই ডুব দিয়ে স্নান সারে সে। তারপর এগোয় সামনে।
খালের মোহনায় এসে সে আর ডানে ঢোকে না। সোজা বেয়ে যায়। বাড়ি যাবে না; যাবে বামুনডাঙ্গা স্লুইজগেইটের কাছে। নৌকা রেখে বটতলায় অধীরের দোকানে আড্ডা দেবে। শহুরে ডিপার্টমেন্টাল শপের ক্ষুদ্র সংস্করণ অধীরের এই দোকান। আছে সবকিছুই। সস্তা দামের চুড়ি আলতা থেকে শুরু করে, তেল-মশলা, বিড়ি-সিগারেট, চালডাল সবই। রাস্তার ঢালে বাঁশের মাচা করে তার উপরে অধীরের এই দোকান। বাঁশের খুঁটি, কাঠের পাটাতন, কাঠের বেড়া, টিনের চাল। সামনে বাঁশের বেঞ্চি।
হরিপদর নৌকা বামুনডিহি যাওয়ার পথে খালের বামে চকডিহি গ্রাম। সেই গ্রামে অধীরের বাড়ি। অধীর তার বন্ধু কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু তারা গ্রাম সম্পর্কে পরিচিত। তুই-তোকারি সম্পর্ক। অধীরদের বাড়ির পিছন দিয়ে খাল। খালে একটা ঘাট আছে। ঘাট মানে দুটো খেজুর গাছ পাশাপাশি ফেলা। এখান থেকে জল তোলা হয়। হাত-পা ধোয়া হয়। একপাশে বাঁধা থাকে ছোট্ট ডিঙ্গি। বৈঠা বাইতে বাইতে হরিপদ বাম দিকে চেয়ে থাকে। ঘাটে কেউ আসে না।
৩.
দু’মাস ধরে অধীর দোকানে মাল তুলছে না। মাল তোলা বলতে সেরকম কিছু নয়। সপ্তাহের প্রয়োজন হিসাব করে সুখদাড়া বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে আনে হাটবারে। সপ্তাহের মাঝে কিছু লাগলে নদীর ওপার যায় সেখানকার হাটের দিনে। এসব কাজ অধীর নিয়মিতই করেছে এত বছর। বর্ষার সিজনে যখন রাস্তায় কাদা হয় তখনও সে কাদার মধ্যে বস্তা মাথায় নিয়ে দোকানকে চালু রেখেছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে তাকে আর তেমন সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। যে জিনিস ফুরিয়ে যাচ্ছে, সেটা আর আসছে না। দোকান প্রায় খালি। অধীরের ভাবান্তর নেই। শোনা যাচ্ছে অধীর ইন্ডিয়ায় চলে যাবে।
অধীর কেন ইন্ডিয়ায় যাবে তা শ্যামলীও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সাত বছর ধরে একসাথে আছে তারা। কখনো খুব ভালোবাসাবাসিও হয়নি; আবার কখনো খুব মনোমালিন্যও হয়নি। অধীর কেমন যেন নিস্তেজ মানুষ। মনেও; শরীরেও। সে ভালোও নয়; খারাপও নয়। তার জীবনের মতো তার মনেও কোন বড় ঢেউ ওঠে না। প্রতিটা দিন সেই একই রকম।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম শ্যামলীকে সে টানতো। কোন কোন দিন দোকান থেকে ফিরে সন্ধ্যারাতেই দরজা বন্ধ করে দিত। বাপ-মা মরা অধীরের বাড়িতে আর কেউ ছিলো না বলে রক্ষে। তারপর শরীরের আকর্ষণ বোধহয় কমতে থাকল। তিন-চার বছরে যখন ছেলেমেয়ে হল না, অধীর যেন দিন দিন কুঁকড়ে যেতে লাগল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাওয়ায় বসে জাল বোনে অথবা উঠোনের মাটি কোপায়, এটা-সেটা লাগায়। তারপর দোকানে যায়, দুপুরে খেতে আসে, ভাতঘুম দেয়, আবার দোকানে যায়। রাতে ফিরে খায়-দায় ঘুমায়। শ্যামলী টানলে সে পাশ ফিরে শোয়; ওসব ভাল লাগে না তার। আস্তে আস্তে শোয়ার জায়গাও একসময় আলাদা হয়ে গেল। শ্যামলী ঘুমায় ঘরে; আর অধীর বারান্দায়। দোকানেও সে চুপচাপই থাকে। মাঝে মাঝে বিড়ি টানে আর বিকেলের দিকে সঙ্গী পেলে তাস খেলে। শ্যামলী অনেক ভেবেছে অধীর কি তাকে ভালোবাসে না? এতে কি শ্যামলীর কোন দোষ আছে? ভেবে পায় না। খালের ঘাটে টোপ দিয়ে পুঁটি মাছ ধরে। ধানের কুড়া, ভাত আর লেবুপাতা মেখে গোল করে একটা ছোট জাল দিয়ে জড়ানো হয়। সেটাকে একটা সুতা দিয়ে একটা কঞ্চিতে ঝুলানো হয়। এই টোপ জলে দিলে পুঁটিমাছেরা টোপ খেতে আসে ঝাঁক ধরে। এর পাশে বড়শি ফেলে পুটিমাছ ধরে সে। সন্ধ্যায় এই পুঁটিমাছ সে রাঁধবে। যে খাবে সে ভালো-মন্দ কোন মন্তব্য করবে না।
শ্যামলী ভেবে পায় না কেন অধীর দেশত্যাগ করতে চায়। অধীরের ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে সে প্রশ্ন করে, ‘তা আমাগে ইন্ডিয়ায় যাতি হবে কেন? কোন সুখটা আচে স্যানে?’ অধীর কোন কথা বলে না। ‘আমি কলাম যাব না; তোমার যাতি হলি যাও।’ একটু থেমে থেকে আবার বলে, ‘মামারা দ্যাকপেনে? কেউ দ্যাহে না। ইন্ডিয়ার মানুষ কি’রম শোনো না? নিজির ভাইরিই দ্যাহে না আর ভাগনে?’ অধীর কোনো কথা বলে না। মুখ বুজে খাওয়া শেষ করে। উঠোনে নেমে হাত ধুতে ধুতে বলে, ‘তুমি কেন যাবা না আমি জানিনে ভাবোচো? আমি সব জানি।’ কথায় একটা ঝাঁজ, যা অধীরের সহজাত নয়।
কী জানে অধীর? কেন সে যেতে চায় না? নিজেও তো জানে না সে। কিন্তু অধীর কী বোঝাতে চেয়েছে শ্যামলী তা জানে। কিন্তু সেটাই কি তার যেতে না চাওয়ার একমাত্র কারণ? অধীর এভাবে কেন আজ বলছে? এতদিন তো কোন অধিকার বোধের সংশ্লেষ ছিল না তার কোন কথায়? বরং শ্যামলী চেয়েছিল হিংসা করে হলেও অধীর যেন তাকে ভালোবাসে। হারানোর ভয়ে যেন সে আঁকড়ে ধরে শ্যামলীকে। কিন্তু তা সে করেনি। এমন তার ভাব যেন শ্যামলীর অস্তিত্বের কোন গুরুত্ব নেই তার কাছে। সে যদি অন্যেরও হয় তাতে কিছু যায় আসে না।
৪.
বামুনডাঙ্গা স্লুইজগেটের কাছে গিয়ে নৌকা ভিড়ায় হরিপদ। দড়ির মাথার খুঁটিও গাড়ে মাটিতে। কি মনে করে আবার খুঁটি তোলে। নৌকা ভাসায়। এবার নৌকা বাইতে থাকে ডান পারে চোখ রেখে। ঘাটের পারে মাছের খালুই দেখা যাচ্ছে। পাশে একটা উঁচু পিঁড়ি। নিশ্চয়ই শ্যামলী রেখে গেছে। এখনই আসবে বড়শি আর টোপ নিয়ে। হরিপদ নৌকা ভিড়ায়।
‘ও বাব্বা, এ খেডা!’ আনন্দিত সম্ভাষণ। হরিপদর মুখটা হাসিতে ভরে ওঠে। সকাল থেকে মাছ নিয়ে সঞ্জিতের তঞ্চকতা, বাবার অনাবশ্যক কথা, কাঁচির পোঁচে সাপ কাটা সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় তার জন্মই হয়েছিলো এই ‘ও বাব্বা, এ খেডা’ কথাগুলো শোনার জন্য। তাকিয়ে থাকে সে শ্যামলীর দিকে। শ্যামলা পাতলা চেহারা, চোখা নাক মুখ, বড় বড় সুন্দর চোখ। শ্যামলীকে সে ছোট অবস্থায়ও দেখেছে। কিন্তু বিয়ের পর হঠাৎ যেন সুন্দর হয়ে যায় সে। তখন শ্যামলীর বয়স কত? পনেরো-ষোলোর বেশি নয়।
অধীরের মা তখন মৃত্যু শয্যায়। মরার আগে পূত্রবধূ দেখে যেতে চান। গ্রামের অন্য পাড়ার মেয়ে শ্যামলীর সাথে বিয়ে হয়ে যায় অধীরের। ধরা বিয়ে। মানে আগে থেকে আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ এসব কিছুই হয় না। কথাবার্তা পাকা হওয়ার পরের দিন লগ্ন ছিল, বিয়ে হয়ে যায়। ওপাড়ার অধীরদা সেদিন থেকে শ্যামলীর স্বামী। কেউ তার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। বাবা আর ভাইয়েরা খুশি বিনা যৌতুকে ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ায়। ভালো ছেলে মানে যার কোন বদনাম নেই। না নারীঘটিত বদনাম, না বেয়াদবির বদনাম, না চুরি-চামারি। ভালো-র এই তকমা যার আছে, তার মধ্যে ভালোবাসা থাকতেই হবে তেমন কোন শর্ত নেই। শ্যামলীর পাওয়া এই ভালো মানুষটির মধ্যে ভালোবাসা প্রকাশিত নয়; এমন কি জৈবিক চাহিদাও উচ্চকিত নয়। তাহলে সংসার! তার বাঁধন শক্ত হবে কি করে। সন্তান হতে পারত সেই বন্ধনের সুতো। বিধাতা সেখানেও পরিহাস করে শ্যামলীর সাথে। বাঁধনটা আলগাই থেকে যায়। সম্পর্ক! নিত্য দিনের বাহ্যিক প্রয়োজনেই তার প্রকাশ মাত্র। একজন রান্না করে অন্যের জন্যে, বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করে। অন্যজন ওর অসুখে ডাক্তারবাড়ি যায়, ঔষধ আনে; শাড়ি ছিঁড়ে গেলে শাড়ি কিনে আনে। এর মধ্যে কি ভালোবাসা নেই? আছে হয়তো। কিন্তু কর্তব্য পালন আর ভালোবেসে করার পার্থক্যটা ঠিকই বোঝে মন। ফাঁকা জায়গাটা শূন্যই থেকে যায়।
‘তা কনতে উদয় হলে, কিষ্টঠাউর’ পরিহাসের প্রশ্ন শ্যামলীর। ‘যাতিলাম এই দিক দিয়ে, দ্যাকলাম ফিড়ে থুয়ে গেছো, খারই থুয়ে গেছো। ভাবলাম বশি বাতি আসবা…’
‘ও, তাই? আমি ভাবলাম আমার সাতে দেহা করতি ইচ্ছে হলো?… পেয়ারা খাবা।’
পেয়ারা খাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল না। তবু বসার উপলক্ষ্য তৈরি করতে বলে, ‘আনো, খাই’। উঠোনের পেয়ারা গাছ থেকে আঁচল ভরে পেয়ারা পেড়ে আনে শ্যামলী। পরনের কাপড়ে মুছে একটা এগিয়ে দেয় হরিপদর দিকে। ছোট ছোট পেয়ারা। কিন্তু খুব মিষ্টি।
‘কন্তে আসলে কলে না তো? বামনডাঙা গিইলে?’
হুঁ—গলা দিয়ে একটা শব্দ করে। কিন্তু কিছু বলে না হরিপদ। বলে না সকাল থেকে মনটা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে আছে; একটু শান্ত হতে এসেছে। এই যে শ্যামলীর সাথে দেখা এটাই তার শান্তির উছিলা। শ্যামলীর সাথে দেখা, তার সাথে কথা বলা, চোখে চোখে তাকানো এসব তার অস্থির অনেক মুহূর্তকে ভরিয়ে দিয়েছে অনেক অনেক দিন।
একান্তে অনেক দিন অনেক কিছু ভেবেছে সে। শ্যামলীকে কল্পনা করেছে শয্যাসঙ্গী হিসেবে। সে বিভিন্ন ভাবনা। ঠিক যায় না কীর্ত্তনদলের একজন শিল্পীর সাথে। পাশের দু’চারটা গ্রামে পরিচিত তার ইমেজের সাথে। সেই কারণে, নাকি সাহসের অভাবে, কোনদিন শ্যামলীর হাত ধরা হয়নি তার। বড় ভয় ছিল ধরতে গিয়ে যদি হারাতে হয় এই কাছে বসার সুযোগ।
হরিপদর সান্নিধ্যে শ্যামলীও খুঁজে ফেরে সেই বর্ণনাতীত ধন, যা সে তার দাম্পত্যে পায়নি। সেও পথ চেয়ে থাকে কখন দেখা হবে। কথা হবে। সে জানে হরিপদ আড় চোখে তার শরীরের বিভিন্ন অংশের দিকে তাকায়। হরিপদর মন কামনা করে তার শরীর। একথা ভেবে কতদিন তার শরীরে শিহরণ জেগেছে মাঝরাতে অধীরের পাশে শুয়ে। কিন্তু কোনদিন তার হাত ধরতে চায়নি হরিপদ, কেন? সে তো অপেক্ষা করে ছিল। আসলে কি সে অপেক্ষা করে ছিল? হাত ধরলে সে কি সাড়া দিত? সে তো অধীরকে, তার স্বামীকে, ভালোবাসে। সেখানে কোন খাদ নেই। আবার হরিপদর সান্নিধ্যও সে চায়। সে কি শুধুই পরিপূরক হিসেবে? জানে না শ্যামলী। সে জানে, সে নিজে কখনো যেচে হাত বাড়ায়নি। ঠিক করতে পারেনি কতটা সে চায়। আচ্ছা, একটা মানুষ কি একই সাথে দু’জন মানুষকে নির্ভেজাল ভালোবাসতে পারে? কোন দিকে একটুও খাদ না রেখে? অথবা এক একটা মুহূর্ত কি একই জীবনের অংশ হয়েও সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা খণ্ড? এই মুহূর্তে, সময়ের ভগ্নাংশে, সে ভালোবাসছে অধীরকে। নির্ভেজাল সেই ভালোবাসা; সেখানে কোন হরিপদ নেই। ঠিক পরের মুহূর্তে, সময়ের আরেক ভগ্নাংশে, দু’পাশে ধানক্ষেত রেখে আলের উপর দিয়ে হাঁটছে সে। পাশে হরিপদ। বাতাসে তার আঁচল উড়ছে। হরিপদর মুখের উপর পড়ছে। সে আবার টেনে নিচ্ছে বাঁকা চোখে তাকিয়ে। মন কল্পনা আঁকে। তৃতীয় মুহূর্তে, সময়ের পরবর্তী ভগ্নাংশে, তার মন ফিরে আসে বাস্তবে। ভাত উৎরিয়েছে। চুলার জ্বাল কমাতে হবে।
কিন্তু আজ, ঘরের পিছনের এই খালপাড়ে বসে, কেমন যেন সবকিছু গুলিয়ে যায় তার। পেয়ারা দিতে গিয়ে হঠাৎ হাত ধরে ফেলে হরিপদর—‘তুমি ইন্ডিয়ায় যাবা?’ হরিপদ শিহরিত। বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত হাত আজ তার হাতে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঝিনঝিনে সেই শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতিটি কোষে। সে যেন বাকহীন হয়ে যায় কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। একি সত্য।
‘যাবা তুমি?’
‘তোমরা তালি যাচ্চো?… আমারে নেবে অধীর?… তোমাগে সাথে?’ বোকার মত প্রশ্ন করে হরিপদ। তার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
‘কেউ তোমারে নেবে না। তুমি আমারে নেবা। পারবা না?’ হাত তখনো ধরা। হরিপদর মাথাটা ফাঁকা মনে হয়। নির্বাক কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত।
‘ও অধীরির বউ, গেলি ক’নে?’ ওপাড়ার খুড়িমা এসেছে। হয়তো পাওনা টাকা চাইতে। গল্প শুরু করবে। কবে তারা ইন্ডিয়ায় যাবে জানতে চাইবে। উঠে যাওয়ার সময় বলবে, অধীর খুব ভাল ছাওয়াল। তোর কপালডা বড্ড ভালো। অধীর যে পরকীয়া প্রেম করে না এটাই খুড়িমার কাছে ভাল ছাওয়াল হওয়ার একমাত্র সূচক। কারণ খুড়োর নাকি খুব চরিত্র দোষ ছিলো। যৌবনে খুড়িকে বহু যাতনা দিয়েছে সে। মধ্যবয়সে খুড়োর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই যাতনার শেষ আর বৈধব্যের জ্বালা শুরু। দাম্পত্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খুড়িমা কখনো দাম্পত্য সুখ কী তা বোঝেননি।
ছুঁড়ে ফেলার মত এক ঝটকা দিয়ে হরিপদর হাত ছেড়ে দেয় শ্যামলী। হাঁটতে শুরু করে বাড়ির ভিতরে। কোন কথা বলে না। হতভম্বের মত কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে হরিপদ নৌকা ভাসায়। বহুকাঙ্ক্ষিত একটি মুহূর্তের আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত যবনিকাপাত হয়। দিনে দিনে গড়ে ওঠা সকল সম্ভাবনা ‘জনমের মত হয়ে গেল হারা…’।
বেশ রাত হয়ে গেল। অধীর আসছে না। শ্যামলী বসে আছে ভাত বেড়ে। কেরোসিন বাঁচানোর জন্য আর পোকার উপদ্রব কমাতে হারিকেনটা একেবারে কমিয়ে রাখে সে। বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে ভাবছে, আজ যা সে বলেছে তা কি সে আসলেই বলতে চেয়েছিল? খুড়িমা এসে না পড়লে হরিপদ কি বলত? হরিপদ তাকে নিয়ে পালাতে চাইলে সে কি সত্যিই অধীরকে ছেড়ে যেত?
কথাটা অনেকদিন জমে ছিল। চক্ষুলজ্জা ছিল; প্রত্যাখানের ভয় ছিল; সামাজিক রীতিনীতি ছিল। কাল চলে যাবে। আজ আর ওসবের ভয় করলে চলে না। বলার তাই মরিয়া চেষ্টা ছিল। কিন্তু খুড়িমা সময় দিল না। সময় দিলেও কি হরিপদ বলত কিছু! কিছুটা সময় তো সে পেয়েছিল। লোকটা জানলোও না কাল চলে যাচ্ছে। আর বলা হবে না। কোনদিন না।
‘খাও নি অ্যাহনো?’ অধীরের কথা শুনে আড়মোড়া ভেঙে বসে শ্যামলী। হ্যারিকেনের আলোটা বাড়ায়। অধীর যেন টলছে, চোখ দুটো লাল। বারান্দার চৌকিতে উঠে শুয়ে পড়ে। ‘ও কি খাবা না? হাতমুখ ধোবা না?’ কোন উত্তর দেয় না অধীর। আজ এই গ্রামে তাদের শেষ কয়েকটি মুহূর্ত। একসাথে কথা তো বলতে পারত, একসাথে না কাঁদুক। মানুষটার কি মন বলে কিছু নেই আর? শ্যামলী থালার ভাত হাঁড়িতে তুলে রেখে ঘুমাতে যায় ঘরের ভিতরে। ঘুম কি আর আসবে! ওদিকে অধীর বারান্দার চৌকির উপর শুয়ে সারারাত ছটফট করে। এক-একবার উঠে বসে। আবার শোয়।
৫.
ভোররাতে বেরিয়ে পড়ে অধীর আর শ্যামলী। সাথে শুধু একটা ব্যাগ। কয়েকটা কাপড় আর কিছু চিড়েমুড়ি। কাউকে বলেনি। ভিটেবাড়ি যার কাছে বিক্রি করেছে সেও জানে না ওরা ঠিক কবে যাবে। শুধু জানে যাবে। কোন একদিন যাবে। ঘরবাড়ি দেখে কেউ বুঝবে না এখানকার অধিবাসীরা চলে গেছে চিরদিনের মত। বেলা বাড়ার পরে এক কান দু’কান করে রাষ্ট্র হবে যে অধীররা চলে গেছে। বেশ কিছু দিন পরে জমির নতুন মালিক ঘর ভাঙবে। হয়তো সবজি লাগাবে সেই জমিতে।
কত স্মৃতি এই গ্রামের সাথে মিশে আছে। সব পাওয়া, সব হারানো, সকল দুঃখ-সুখ সবকিছু এই চকডিহিতেই। এখানেই জন্ম এখানেই বিয়ে। সবকিছু। ছোটবেলায় মামাবাড়ি যাওয়া; পুজোর সময় পাশের গ্রামে যাওয়া বছরে একবার; আর মাঝে মধ্যে সুখদাড়ার হাটে যাওয়া; বামুনডাঙ্গা বা ঘোনাপাড়ায় কীর্ত্তন শুনতে যাওয়া। এর বাইরে তার জীবনের সবগুলো মুহূর্ত কেটেছে এই গ্রামেই। এটাই তার বিশ্ব। সব ছেড়ে চলেছে শ্যামলী। স্বামীর হাত ধরে। এই হাত সে ধরেছিলো সাত বছর আগে। তারপর আলগা হয়েছে কখনো; কিন্তু ধরে আছে। অধীর কখনো পূজোআচ্চা করে না। তার মতো থাকে। সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপের সামনে সে প্রণাম করে না। শুধু বড় পুজো অর্থাৎ দুর্গাপূজা অথবা সরস্বতি পূজার মতো মণ্ডপে সে প্রণাম করে। আজ বেরোনোর সময় উঠোনের বেড়ার কাছে এসে আবার ফিরে তাকায় ঘরটার দিকে। গড় হয়ে প্রণাম করে সে। হয়তো বাস্তুভিটাকে, হয়তো তুলসীতলাকে, হয়তো তার পূর্বপুরুষদের, যারা কয়েক শ’বছর আগে ফরিদপুরের দিক থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো সুন্দরবন সন্নিহিত এই নদীর তীরে। গড়ে তুলেছিলো নতুন জনবসতি। শ্যামলী অবাক হয়ে দেখে অধীর কাঁদছে। তারপর ব্যাগ তুলে নিয়ে বলে, ‘চল বউ পয়লা টাবুরে ধরতি হবে।’ আউশখালীর ঘাট থেকে তারা দিনের প্রথম টাবুরে অর্থাৎ বৈঠা বাওয়া যাত্রীবাহী নৌকায় যাবে কৈয়া বাজার। সেখানে তাদের সাথে দেখা হবে অখিলেশের। কৈয়া থেকে সাতক্ষীরার বাসে করে দালাল অখিলেশ নিয়ে যাবে তাদের। ভোমরা বর্ডার দিয়ে পার করে দেবে। ওপারে অখিলেশের লোক থাকবে। মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। সেখানে থাকে অধীরের মামারা। সেটাই গন্তব্য অধীর আর শ্যামলীর। ওখানে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
শ্যামলীর চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। কিন্তু এই প্রস্রবণের ধারা বাধ মানে না। মুখে কোন শব্দ নেই; বুকের মধ্যে অনবরত হাতুড়ি পেটার শব্দ। অধীর কেমন যেন পাগলের মত ভাবভঙ্গি করছে। কিছু বলছে না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে শুধু।
বড় রাস্তায় উঠে আর একবার পেছন ফিরে তাকায় তারা। যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে তারা। আর হয়তো আসা হবে না। খালপাড়ের রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরা হবে না দিন শেষে। এইবার শ্যামলী আর চেপে রাখতে পারে না নিজেকে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। স্বপ্নের দোকানটার জীর্ণ ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে বটগাছ তলায়। অধীর তার কোমরের তাগি থেকে দোকানের চাবিটা ছাড়িয়ে নিয়ে দোকানের দরজায় রেখে আসে। কয়েক পা এগিয়ে আসে। আবার ছুটে যায়। দোকানের দরজায় লাগানো তালাটা ধরে ঝাঁকুনি দেয়। তালাটা ঠিকমত লেগেছে কিনা দেখছে এমন মনে হয়। তারপর একটু আগে রাখা চাবিটা সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে দেয় দূরে। যেন কেউ না খুলতে পারে তার দোকান।
অগ্রহায়ণের শেষ রাতের কুয়াশায় রাস্তা একটু পিচ্ছিল। মাটির রাস্তায় বর্ষাকালে কাদা হয় খুব। বর্ষা শেষে যখন শুকায় তখন উঁচুনিচু থেকে যায়। উঁচু নিচুর উঁচুগুলো ভীষণ শক্ত আর মসৃণ। সেটা পিচ্ছিল হলে জোরে হাঁটা সহজ নয়। তবু তারা জোরে জোরে হাঁটতে চায়। প্রথম টাবুরে ধরতে হবে।
বামুনডাঙ্গা স্লুইজগেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় শ্যামলী। গেইটের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া রাস্তাটার দিকে চেয়ে থাকে। কান্নার দমক কমেছে ততক্ষণে। আঁচলটা মুঠো করে মুখ চাপা দিয়ে রেখেছে তবুও। চোখ থেকে ঝরছে জল। এই রাস্তা দিয়ে প্রথমবার সে হরিপদর সাথে হেঁটেছিলো এক মাঘ সন্ধ্যায়। বামুনডাঙ্গাতে কীর্ত্তন শুনে ফিরছিলো সে। ওই দলেরই ঢোলবাদক হরিপদ জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘এ্যাহলা যাতি পারবানে, অধীরির বউ?’ ‘না পারে আর উপায় কি?’ প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করেছিলো শ্যামলী। ‘আগোই দেবো নাহি?’ আবার পাল্টা প্রশ্ন। ‘তা দিলি তো ভাল হয়।’ সন্ধ্যার সময় নারী বা শিশুদেরকে একগ্রাম থেকে অন্যগ্রামে এরকম এগিয়ে দেয়া এ এলাকায় অস্বাভাবিক নয়। হরিপদ বটতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলো শ্যামলীকে। সেই কোল আন্ধারির মধ্যে সাথে যেতে যেতে এমন কোন কথা হয়নি দু’জনের মধ্যে যা থেকে কোন সম্পর্কের সূচনা হতে পারে। এমনকি পরে আরেক দিন দেখা হওয়ার আশা জাগতে পারে। তাছাড়া শ্যামলী বিবাহিত। দু’জনের কেউই ভাবেনি অন্য কিছু। কিন্তু তারপর থেকে বহুবার এই পথ দিয়ে হেঁটেছে শ্যামলী। সাথে আছে ঢোলবাদক হরিপদ। কখনো বা বাদক গান ধরেছে বেসুরো গলায়। সে হেসেছে। ভালোও লেগেছে। সবকিছু মনে মনে।
‘চায়ে চায়ে দেহিস কী? তোর নাগর আর আসবে না। শেষ করে দিয়ে আইছি।’
শ্যামলী ফিরে তাকায় তার স্বামীর দিকে। ‘কচ্চ কি? তুমি কি করোচো?’ একটু থামে সে। বুঝতে চায় আসলে অধীরের কথার অর্থ কী। তারপর তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। গা কাঁপতে থাকে। দু’হাতে স্বামীর কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় সে। ‘কেন করোচো? আমি তো চলে যাচ্ছি। ওই মানুষটারে তুমি কি করোচো?’
অধীর কিছুক্ষণ কথা বলে না। তারপর হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেদে ওঠে। বলে, ‘বউ, জোরে হাট। পুলিশ জানতি পারলি আমার ফাঁসি হয়ে যাবেনে… ’