
আমার কবিতা : কাছের কেন্দ্র-দূরের পরিধি
আমি একজন সাধারণ মানুষ; সাধারণ পরিবারে জন্ম লাভ করে সাধারণ পরিবেশে সাধারণের একজন হয়ে বেড়ে উঠেছি। পদ্মা-মহানন্দা-পাগলা-পাঙ্গাশমারী-বিধৌত চাঁপাইনবাবগঞ্জের পলিসমৃদ্ধ চরাঞ্চলে আমার জন্ম। যতদুর মনে পড়ে শিশুকাল হতেই আমি বৃষ্টি ও নদীর অক্লান্ত ভক্ত। বৃষ্টি হলে আমাকে ঘরে বেঁধে রাখবে এমন সাধ্য কারুরই ছিল না। বাস্তবিকই বৃষ্টির নূপুর বেজে ওঠার সাথে সাথে আমার হৃদয়মন ময়ূরের মতো নেচে উঠতো। আর বৃষ্টিমুখর নদীতে দলবলে সাঁতার কাটায় যে আনন্দলাভ ঘটতো, পরবতীতে মহার্ঘ্য আর কোন কিছুতেই তা জোটেনি। যে কোনো অর্থেই আমি জলের সন্তান- কোনো জনমে জলদাস ছিলাম কি না জানি না। নদী আমার জন্মদাত্রী থেকে খেলার সাথি হয়ে প্রথম যৌবনে প্রেমিকার স্থান দখল করে। ভরাবর্ষায় আমি তরঙ্গায়িত পাঙ্গাশমারীর বুকে গাঙচিলের মতো ঝাঁপ দিতাম আর স্রোত ও ঢেউয়ের দোলায় ভেসে যেতাম দায়হীন আনন্দে-অবারিত অগন্তব্যে। বহুবার নাকানিচুবানি খেয়েছি, তবে কখনো সে আমাকে মাঝগাঙে ডুবিয়ে মারেনি। আমার শৈশব, আমার কৈশোরের মধুর দিনগুলো, আমার যৌবনের বড় অংশ কেটেছে নদীবিধৌত প্রকৃতির উদার অবাধ প্রাঙ্গণে। পরবর্তীতে আমাদের ভিটামাটি জমিজমা সব গেছে সেই নদীর পেটে। পদ্মানদীর গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমার জন্মগ্রাম টিকলীচরসহ ঐ এলাকার ৪/৫টি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম-মাঠ-ঘাট-হাট-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমাদের এলাকার মানুষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যে যেখানে পেরেছেন, চলে গেছেন। কেউ নতুন চরে, কেউ শহরে, কেউ রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে, কেউবা আরো দূরের কোনো জেলায়। আমার এবং তাদের সবার বুকে নিত্য শেকড়বিচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা। ভিটেমাটিহারা দীর্ঘশ্বাস মাঝে মাঝে আমাকেও ভীষণভাবে স্পর্শ করে। ফারাক্কাবাঁধের অভিশাপে সে নদী এখন ধূ ধূ বালুচর। কিন্তু আমার জাগরণে এবং স্বপ্নে এখনো সেই গ্রাম, সেই মাঠ, সেই নদী, সেই কৈশোর, সেই স্কুল প্রবলভাবে অস্তিত্বশীল। চাকরিসূত্রে তো শহরেই কাটছে আমার দিন ও রাত। কিন্তু আমি মনের দিক হতে একেবারেই প্রকৃতিলগ্ন। ঘুড়িবালক যেমন তার ভোঁ-কাটা ঘুড়ির কথা ভুলতে পারে না, আমিও পারি না আমার হারিয়ে-যাওয়া জন্মগ্রামের কথা ভুলে যেতে। সেসব স্মৃতি ছায়ার মতো আমার চিন্ময় অস্তিত্বের অন্তরঙ্গ সঙ্গী। আমার ভেতরে স্মৃতি ও বাস্তবতার নিত্য টানাপোড়েন। নদী আমার ব্যক্তিগত জীবনে, আমার স্বপ্নের উঠোনে এবং আমার কাব্যভাবনায় প্রায় স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে আছে। নদী নিয়ে আমি প্রায় স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্ন দেখি। আর কবিতা তো এক ধরনের স্বপ্ন-সৃষ্টিই।
প্রচলিত অর্থে ভালো ছাত্র ছিলাম; তবে সিলেবাসবদ্ধ পড়াশুনায় আটকে থাকতে চায়নি আমার বেহিসেবী মন। পুঁথি, কিশোর কবিতা, ছড়া ও রূপকথার বই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনেছে; আর এ সবই ছিল আমার পিতার প্রায় প্রতিদিনের পাঠ্য। আমার পিতা সাহিত্যরসিক মানুষ। জালালউদ্দীন রুমী, শেখ সা’দী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম প্রমুখ ইরানী কবির কাব্যপাঠ ছিল আমার পিতার বড় নেশা। চারণ কবিদের মতো যেকোনো বিষয়ে মুখেমুখে ছড়া বা পদ রচনা করতে পারতেন তিনি। এজন্য তিনি আমাদের গ্রামে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রসবোধও ছিল গভীর। আমি নিজেও তাঁর ভক্ত ছিলাম। আব্বার সে সকল কবিতা তখন সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। হয়তোবা সেসব কবিতা এখন বাতাসের আকাইর্ভে জমা হয়ে আছে। পিতার সহজাত কাব্যপ্রেম আমার রক্তে সঞ্চারিত- এটা স্পষ্ট হয়ে যায় আমার সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে। আমি ছন্দবদ্ধ কবিতা (আসলে পদ্য) লিখতে শুরু করি এবং লেখায় হাত দিলেই- কিছু একটা হয়ে ওঠে। কিন্তু সেসব কোনদিনও প্রকাশের আলোতে আসেনি- কারণ তখন শহরের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। আমি ছোট থেকেই কাব্যপিপাসু। বাংলা কবিতা তো বটেই, বিশ্বকবিতার যখন যা হাতে পেয়েছি, তা-ই গোগ্রাসে পড়ে নিয়েছি। সে অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে ষোলআনা। আমার কাব্যরুচি নির্মাণে এসবের একটা প্রভাব তো আছেই।
চাকরিজীবনে আমার অনেকটা ঘন ঘন কর্মস্থল বদল হওয়ার কারণে এক ধরনের কষ্ট জুটলেও প্রায় সমগ্র দেশকে পরিপূর্ণ নিবিড়তায় দেখার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে চাকরির অভিজ্ঞতা আমাকে এ দেশের সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। ভৃমিহীন দিনমজুর থেকে জোতদার ভূস্বামী, সাধারণ সরল ভোটার থেকে এমপি-মন্ত্রী, অখ্যাতজন থেকে অভিজাত, কট্টর মৌলবাদী হতে তুখোড় বামপন্থী- সব ধরনের সকল স্তরের মানুষকে কাছে থেকে নিবিড়ভাবে দেখার সৌভাগ্য (অনেক ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যও) হয়েছে আমার। বিশ্বায়নের পক্ষের তথাকথিত অনেক দাতা সংস্থা ও দেশ, এনজিও, বিশ্বব্যাংক, আইএফএফ এবং বিভিন্ন বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থার কার্যক্রম আমি আমার গভীর পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি নিয়ে দেখেছি। অনেক তুখোড় পন্ডিত, বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল পত্রিকা সম্পাদক- এইসব সংস্থা/দেশের হয়ে কাজ করে চলেছেন। আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির ভেতর-বাহির গভীরভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি অপরিহার্য বাধ্যবাধকতায়। আর আমার নিত্যদিনের অভ্যাস ব্যাপক পঠনপাঠন। আক্ষরিক অর্থেও ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর-সবার আমি ছাত্র’। আমার ভাবনা ও একইসাথে সৃষ্টির ওপর পড়েছে এসব প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়াজনিত ছাপ। এভাবে প্রেমের কবিতায় ঢুকে পড়েছে রাজনৈতিক চিত্রকল্প, একান্ত অনুভূতি রঞ্জিত হয়ে উঠেছে আমলাতান্ত্রিক পারিভাষিক জগতের উপমার রঙে। বর্তমান বিশ্বে যা কিছু উদার মানবিকতার বিরুদ্ধে, সেসবের বিরুদ্ধে আমার কবিতার প্রতীকী অবস্থান।
আরেকটি বিষয় আমার জীবন ও কবিতার ক্ষেত্রে সত্য হয়ে আছে তা হলো আমার বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ, দেশবিদেশের ইতিহাস-ভূগোল-নৃতত্ত্ব পাঠ এবং আমার ভাবনায় ও কবিতায়-সেসবের ছাপ। আমি প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ দেখেছি। আমি সোনা মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, মহাস্থানগড়, বেহুলার ভিটা, রামসাগর, নীলসাগর, মহীপালের দিঘি, দিবর দিঘি, কুসুম্বা মসজিদ, ভিমের পান্টি, কান্তজীর মন্দির, উয়ারী-বটেশ্বর, ময়নামতি-শালবনবিহার, শাহজালালের মাজার, জীবনানন্দ দাশের জন্মভিটা, পতিসর-শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিস্থান, সোনারগাঁও, বিভিন্ন জমিদারবাড়ি/রাজবাড়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং খালবিলনদীসমুদ্র দেখেছি। তার সাথে দেখেছি ভারত, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কের বহু ঐতিহাসিক শহর ও স্থান। এবং জানার চেষ্টা করেছি এসব স্থানের মানুষের অতীত-বর্তমান। আমার কাব্যভাবনার ওপর এসব দর্শন ও পঠনের প্রভাব পড়েছে গভীরভাবে এবং তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচকতায়। আমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত নিয়ে দীর্ঘকবিতা লিখেছি: আমি সোনা মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, মহাস্থানগড়, বেহুলার ভিটা, মহিপালের দিঘি, দিবর দিঘি, কুসুম্বা মসজিদ, উয়ারীবটেশ্বর, ময়নামতি-শালবনবিহার প্রভৃতিকে প্রচ্ছদ করে লিখেছি দীর্ঘতর কবিতা; আমি তুরস্কে বসে একাধিক কবিতা লিখোছ; লিখেছি থাইল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় বসেও। অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় সিডনির ব্লু মাউন্টেন দেখতে যাই। সেখানে একজন আদিবাসী (Aboriginal)-কে দেখি। তিনি ব্লু মাউন্টেনে বাঁশি বাজিয়ে খাবারের অর্থ উপার্জন করতেন (হয়তো এখনও করে যাচ্ছেন)। এরাই অস্ট্রেলিয়ায় অরিজিনাল মানুষ, ঠিক আমেরিকায় যেমন রেড ইন্ডিয়ানগণ। এরা এখন নিজবাসভুমে পরাজিত এবং অস্তিত্বহীন হওয়ার পথে। বাংলাদেশের আদি মানুষদের একটি ধারা নৃতাত্ত্বিকভাবে অস্ট্রালয়েড। ব্লু মাউন্টেনে সেই অ্যাবরজিন্যালকে (অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী) দেখে সাথে সাথে বিষয়টি আমার মনে পড়েছিল। তার গায়ের রঙ এবং মুখাবয়ব কালো বাঙালিদের মতোই। আমি আমার ভারত, মালেশিয়া, ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও প্রচ্ছদে দেশপ্রেমের দীর্ঘ কবিতা লিখেছি। আমার কবিতায় জাতীয় ভূগোলের পাশাপাশি অথবা সংমিশ্রিত হয়ে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ভূগোল, মিথ ও ইতিহাস। বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক উৎস সন্ধানের পাশাপাশি আমি তার আন্তর্জাতিক যোগসূত্রটিও খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। বিস্তৃত ভূগোলে শেকড়ের সন্ধান আমার অন্যতম প্রধান কাব্য-অন্বেষা।
আমি ঘুরি পথে ও প্রান্তরে;
সিডনির ব্লু মাউন্টেনে
কৃষ্ণকায় আদিবাসি সাইমনকে দেখে
মনে হয়েছিল-
পুরোনো পুঁথির মতো গায়ে তার পরিচিত ঘ্রাণ;
যেন সে আমারই সেই আদিবংশধর-
শিমুলের ফুল গুজে চেয়ে থাকতো শবরীর চুলের খোঁপায়;
তুফানের ঢেউ লেগে নৃতাত্ত্বিক তরীখানা
পর্বতের কোল ছেড়ে
ভিড়েছিল একদিন করতোয়া তীরবর্তী বৃক্ষের পাড়ায়!
(পিছিয়ে যাওয়া মানুষ / স্বপ্নের হালখাতা)
প্রকৃতপক্ষে কবিমাত্রই প্রেমের কবিতার কবি। ক্রিকেটারদের প্রধান পরীক্ষা যেমন টেস্ট খেলায়, কবিদেরও মূল পরীক্ষা প্রেমের কবিতা রচনায়। রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্বপ্রেমিক; নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি, সাম্যবাদী কবি প্রভৃতি নানা অভিধায় অভিষিক্ত করা হলেও তিনি ছিলেন মূলত এবং প্রধানত প্রেমের কবি; জীবনানন্দ দাশকে হতাশার বা নির্জনতার কবি বলার পেছনে যতই যুক্তি থাক, তিনি প্রধানত প্রেমের কবি; আল মাহমুদকে বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী যে যাই বলুক, তাঁর কাব্যনদীর মূলধারাই প্রেম; আর মহাদেব সাহা তো অক্লান্তভাবে প্রেমের অফুরন্ত কাব্যসম্ভার উপহার দিয়ে চলেছেন। আমার নিজের ক্ষুদ্র কাব্যসাধনার পেছনেও প্রেমানভূতি সবচেয়ে প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল বলে মাঝে মাঝে আমার মনে হয়। এখানে একটা কথা বলে রাখা যায়: আমার প্রেমের কবিতাগুলো প্রচলিত প্রেমের কবিতার চেয়ে কিছুটা আলাদা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একগানে বলেছেন যে তিনি যখন গানের ভিতর দিয়ে জগতকে দেখেন তখনই সে জগতকে সঠিকভাবে জানতে এবং চিনতে পারেন। আমি প্রেমের ভিতর দিয়ে জীবন ও জগতকে দেখার করে আসছি; তবে রোমান্টিকতার চোখ ও মন নিয়ে নয়। একবিংশ শতাব্দির উঠোনে দাঁড়িয়ে অতোটা রোমান্টিক হওয়ার সুযোগ নেই, যুক্তি তো নেই-ই। আমার প্রেমের কবিতা বিষয়ে গবেষক-প্রাবন্ধিক সরকার আবদুল মান্নান যথার্থতই বলেছেন: ‘প্রেমের কবিতার একটি প্রথাগত রূপৈশ্বর্য ও বিষয় বৈভবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। বিচিত্র অনুষঙ্গে মানব-মানবীর লীলালাস্যই সেখানে মুখ্য। আমিনুল ইসলাম মোহন প্রেমের এই প্রথাগত আখ্যান রচনা করেন না। সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র ক্ষতকে তিনি তুলে ধরেন জীবন-প্রেমিকের বিস্ময়কর অন্তর্লোক থেকে। ফলে নারী নয়, পুরুষ নয়, আটপৌরে প্রতিদিন নয়-বরং এসবকিছু নিয়েই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রেমের কবিতার প্রবল জীবন-তৃষ্ণা। প্রচন্ড এক সংবেদনার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণময় হয়ে ওঠে। এই সংবেদনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের সীমা অতিক্রম করে যায় অবলীলায় এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকজ্ঞান ও লোকজীবন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতায় ধরা দেয় কবির প্রেমভাবনার অবয়বে। ফলে পালটে যায় পরিচিত ডিকশন, প্রবল প্রতাপান্বিত ফর্ম। আর সেই বিচূর্ণ কবিভাষার সমাধিস্থলে গজিয়ে ওঠে আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতার নতুন এক ভাষিক জগৎ, স্বতন্ত্র এক গঠনসৌষ্ঠব। জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্তর্গত শক্তি। ফলে সমকালের বিচিত্র দুর্দৈবের মধ্যেও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অবিনাশী জীবনের গান। বোধের এই সততা ও দায়বদ্ধতায় আমিনুল ইসলামের প্রেমসমগ্র হয়ে ওঠে জীবনসমগ্র -আর্তনাদের মধ্যে আনন্দিত উত্থান।’
আরেকটি বিষয় এই যে- আমার ব্যর্থতাবোধ প্রচুর। কিন্তু কিসের ব্যর্থতা আমার-কেনই বা এই ব্যর্থতা- অনেক ক্ষেত্রেই তা আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। আমি কি রোমান্টিক? আমার ভেতরে কি আত্মবিশ্বাসের অভাব? ব্যক্তিগত জগতে অথবা পেশাগত পরিমণ্ডলে আমি কি কক্ষচ্যুত? দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে মানুষের অবিবেচনা, অবিচার, বিভেদ ও নিষ্ঠুরতা দেখে কি ক্লান্ত আমার ভেতরের আমি? আমার কবিতা কখনো কখনো সেই মানসিক সংকটের সন্তান হয়ে জন্মলাভ করেছে- বেদনামলিন প্রাণে বেড়ে উঠতে চেয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কবিতা লিখি, কারণ, অনেকক্ষেত্রেই আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।
কবিতার ক্ষেত্রে আমি কোনো একপেশে রাজনীতি, দর্শন বা ইজম দ্বারা তাড়িত হতে চাইনি। আমি বিষয়বিহীন বক্তব্যরিক্ত কবিতা লিখতেও চাইনি। কিন্তু বিষয় তো আসলে পুরোনো। সেই পুরাতন পৃথিবীতেই তো আমাদের বসবাস। আমি আমার ভাবনা ও স্বপ্নকে নিজস্ব ঢঙে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি আমার কবিতায়। শব্দের ব্যবহার, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ, বাক্যগঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমার কবিতায় এক ধরনের অভিনবত্ব বা নতুনত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। শব্দ ব্যবহারেরর ক্ষেত্রে আমার কোনো মানসিক সংকীর্ণতা নেই। ইংরেজি, আরবি, ফার্সী, হিন্দি, উর্দু, লোকায়ত, প্রশাসনিক পরিভাষা- যে কোনো শব্দ যুৎসই মনে হলে তা নিদ্বির্ধায় ব্যবহার করেছি। নতুন ব্যঞ্জনায় পুরোনো শব্দকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি; কবিতায় এতদিন যাবৎ ব্যবহৃত হয়নি-এমন সব শব্দ এবং প্রশাসনিক পরিভাষার জগতের অর্থগর্ভ প্রত্যয়কে যুৎসই দ্যোতনায় ব্যবহার করতে চেয়েছি। আবার আমি কোনো দশকওয়ারী কাব্যতত্ত্বে বিশ্বাসী নই বলে কোনো দশকের প্রকরণের হুবহু অনুসৃতি নেই আমার কবিতায়। তাছাড়া, শুধু ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলোনোর মতো কবিতা লেখা কখনো আমার লক্ষ্য ছিল না।
লেখালেখি করে যে আনন্দ পাই, তা মহামূল্যবান। জীবন এখন নানাবিধ জটিলতায় আকীর্ণ। যখন অন্যের লেখা পড়ি- আনন্দ পাই; যখন নিজে কিছু লিখতে পারি- তখন আনন্দ পাই আরো বেশি। অতএব লিখে যাচ্ছি। যতদিন বাঁচি লিখে যাবো।