
আমাদের গন্তব্য
সহজ সরল উপস্থাপনা কিন্তু কাব্যিকতায় ভরপুর। মনের সমস্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ সাবলিলভাবে অনর্গল লিখে গেছেন হানিফ রাশেদীন তার ‘শেকলের নূপুর’ কবিতাগ্রন্থে। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন কারণ মানুষ প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টি। প্রকৃতির মাঝেই লুকিয়ে আছে মানুষের হাঁসি-কান্না। হাজার বছর ধরে প্রকৃতি মানুষের আঘাত সয়ে যায় নিরবে। তবুও মানুষকেই ভালোবাসে। নির্মমতার বেদনা ভুলিয়ে দেয় ভালোবাসা। পুরো কবিতাগ্রন্থ জুড়ে এই ভালোবাসারই জয়গান গেয়েছেন কবি।
মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে প্রতিবাদে। প্রতিবাদের ভাষা কর্কশ, কখনো জ্বালাময়ী। ‘শেকলের নূপুর’-এ আমরা এক ভিন্ন প্রতিবাদের ভাষা দেখতে পাই। যা মানুষকে জ্বালানোর চেয়ে জাগিয়ে দেয়। কবি লিখছেন: ‘প্রত্যেকের চোখের নক্ষত্র জ্বলে উঠেছে/ বিমর্ষ সন্ধ্যার আকাশে সূর্যমুখী ফুল/ …প্রতি পদক্ষেপে মৃত্যুর পরোয়ানা’। অন্য জায়গায় কবি তার দেশাত্মবোধ নিয়ে লিখছেন। দেশের চারদিকে শত্রুর আনাগোনা। যে কোনো সময় শকুনেরা হানা দিবে। পদে পদে শৃঙ্খলিত। এই শত্রুর প্রতি সজাগ থাকতে আহ্বান জানাচ্ছেন এক ভিন্ন সুরে। ’…পুষ্পোদ্যানে ফাঁদ পেতে আছে শেয়াল/ আকাশে কাকের বিদঘুটে চিৎকার.. ‘।
দিগন্তজুড়ে অন্ধকার। সবাই বলছে আলোর দেখা নেই। অন্ধকার কাটার সম্ভবনা ক্ষীণ। কবিরা তো অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলে না। আলোর সন্ধান করে। খুঁজে ফিরে সোনালী প্রভাত। অসময়ই শেষ কথা নয় সুসময় অতি নিকটে, যা তেড়ে আসছে অগ্নি মশাল হাতে। সুসময় যারা টেনে নিয়ে আসে তাদের জীবন বিপন্ন। পদে পদে তাদের দুস্থ্যতা। যাদেরকে সুসময়ে পৌঁছে দিতে চায় তারাই ভর্ৎসনা করে। তাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতাও করতে কুন্ঠা বোধ করে না। কবি লিখছেন- ‘…মানুষের পায়ের ছাপ মনে করে/ পাখিদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে/ মনুষ্য সমাজ বলছে-/ পাখিদের গান তারা ভালোবাসে’।
আমাদের যে দিন যাচ্ছে তাই শেষ কথা নয়। সামনে উজ্জল দিনের আলো। মেঘ কেটে আলো ফুটানো সময়ের সাহসী কাজ। অন্ধকারের পড়ে থাকাতে সার্থকতা নেই। আলো ফুটিয়ে তুলতে লড়াই জারি রাখাতেই জীবনে স্বার্থকতা। কিন্তু একা একা তো আলো ফোটানো যায় না। একত্রিত হতে হয়। একত্রিত হলে একটা বিরাট শক্তি কাজ করে। যা ছিন্নভিন্ন করে শঠতা। দূর করে গ্লানি। ফুটিয়ে তোলে অপূর্ব সৌন্দর্য। হাজার বছর সৌন্দর্যহীন বাঁচার চেয়ে কয়েক মুহুর্ত সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করে বাঁচা ঢের উত্তম। তাই তো কবি লিখছেন- ‘…নিভিয়ে দেওয়া ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে উঠছে বসন্তের মিছিলে/ …এবার সুন্দরের সান্নিধ্যে ফুটে উঠবে হৃদয়বাসনার ব্যঞ্জনা/ আমরা তো চিরকাল ফুল ফোটানোর দলে’।
’শেকলের নূপুর’ কবিতাগ্রন্থের নামকরনেই এক অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে। অবশ্য সবগুলো কবিতা গদ্য ছন্দে লেখা হলেও এক অসাধারণ নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তার প্রতিটি কবিতায়। যা পাঠক হৃদয়কে আলোকিত ও আনন্দিত করে। কবির এই লেখার প্রয়াস অব্যহত থাকুক এটাই প্রত্যাশা। তবুও কবির ভাষায় সমাপ্ত করছি-
কারা যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে তোমার আমার প্রণয়ের চিত্র
চতুর্দিক হতে ধেয়ে আসছে কালকেউটের ছোবল
নির্জন পরিবেশের অজুহাতে গড়ে উঠছে দুর্বোধ্য দেয়াল
বসন্তের ফুল আহরণ করা তো প্রত্যেকের সমান অধিকার।