
আমাদের কবিতায় আমাদের ভাষা সংগ্রামের ছবি
বঙ্গভূমি বা বাংলা-ভূখন্ডের মানুষের প্রধান ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলা। তবে বঙ্গ ভূখন্ডেও অন্যান্য ছোটখাটো উপজাতি এবং আদিবাসী আছেন যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা ছিল এবং আছে। ঋগ্বেদের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থটি খ্রীস্টপূর্ব তিন হাজার বছর পূর্বে রচিত। ঐ গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ নামের দেশের কথা উল্লেখ আছে। মহাভারত এবং রামায়ণেও বাংলার কথা আছে। মোগল আমলের ইতিহাস রচয়িতাদের গ্রন্থে ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গাল’, ‘বাংলা’ প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক ড. নীহারঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার সীমা নির্দেশ করেছেন এভাবে :
‘উত্তরের হিমালয় এবং হিমালয় হইতে নেপাল, সিকিম ও ভোটান রাজ্য; উত্তর পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা; উত্তর পশ্চিম দিকে দ্বারভঙ্গ পর্যন্ত ভাগরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি; পূর্বদিকে গারো-খাসিয়া-জয়ন্তিয়া-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাহিয়া দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত। পশ্চিমে রাজমহল সাঁওতাল পরগণা-ছোট নাগপুর-মানভূম-ধলুভূম-কেওশুর-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই প্রত্যেকটি সীমাবিবৃত ভূমিখন্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার গৌড়-পুন্ড্র-বরেন্দ্রীয়-রাঢ়া-সুহ্ম-তাম্রলিপি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ।’
মুসলমানদের আগমনের পূর্বপর্যন্ত বঙ্গভাষাভাষী ভূগোল বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত ছিল। আর আজকের বাঙালি জাতি নৃতাত্ত্বিকভাবে নানা উৎসের মানুষের সংমিশ্রণ। বাঙালি নৃতাত্ত্বিকভাবে তাই শংকর জাতি। অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান, আর্য-প্রভৃতি নান জাতের মানুষ মিশে আজকের বাঙালি জাতি। “বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বাংলা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে বলে প্রাক-আর্য যুগের অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠরি ভাষার সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট নয়। তবে সেসব ভাষার শব্দসম্ভার রয়েছে বাংলা ভাষায়। অনার্যদের তাড়িয়ে আর্যরা এদেশে বসবাস শুরু করলে তাদের আর্যভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। বাঙালি জাতি যেমন সঙ্কর জনসমষ্টি, বাংলা ভাষাও তেমনি সঙ্কর ভাষা। বর্তমান বাংলা ভাষা প্রচলনের আগে গৌড় ও পুন্ড্রের লোকেরা অসুর ভাষাভাষী ছিল বলে অষ্টম শাতাব্দীতে রচিত ‘আর্যমঞ্জুশ্রী-মূলকল্প’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। এই অসুর ভাষাভাষী লোকেরা ছিল সমগ্র প্রাচীন বঙ্গের লোক। অসুর ভাষাই অস্ট্রিক বুলি। (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস/ মাহবুবুল আলম)।
বর্তমান বাংলা ভাষার উৎপত্তি খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বলে অভিমত দান করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আর বাংলা ভাষা প্রথম থেকেই শাসকদের রোষানলে ও ঘৃণার দৃষ্টিতে পড়েছিল। সংস্কৃত ভাষী-আর্য-ব্রাহ্মণরা বাংলা ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পাঠের এবং অনুবাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল। এই বলে যে যারা স্থানীয় (অর্থাৎ বাংলা) ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পাঠ বা অনুবাদ করবে, তারা রৌরব নামক নরকে যাবে। মুসলমানরা এসে সেই নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে ফেলে। বাংলা ভাষায় রামায়ণ মহাভারত অনূদিত হয়। ‘মুসলমান শাসকেরা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। তাঁদের উৎসাহ দানের ফলেই বাংলা ভাষা যথার্থ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। নইলে ব্রাহ্মণবাদীরা ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানব: শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ॥’-বলে ধর্মীয় বিষয় দেশীয় তথা বাংলা ভাষায় প্রচারের যে, নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছিল তাতে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাহীন ছিল।’ (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস/ মাহবুবুল আলম)
এটি লক্ষ করেই ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বিখ্যাত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।’ কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এক শ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষ বাংলা ভাষাকে বিধর্মীদের ভাষা জ্ঞান করতেন এবং বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মীয় পুস্তকাদি অনুবাদ করা যাবে না, বাংলা ভাষায় খুতবা পাঠ করা যাবে না, এইসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিলেন। সতের শতকের কবি আবদুল হাকিম এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেছিলেন আক্রমণাত্মক ভাষায় :
যেই দেশে যেই বাক্য করে নরগণ
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন॥
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিংবা হিন্দুয়ানী
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যথ ইতি বাণী॥
. . .. . . . . . . . . . . . . .. .. . . .
সে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়াএ।
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যাএ॥
মাতাপিতা সহ ক্রমে বঙ্গেতে বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
আমরা দেখতে পাই বাংলা ভাষা প্রথম থেকেই কখনো রাজরোষানলে, কখনবো ধর্মীয় বিধিনিষেধের কবলে পতিত হয়েছে। আবার একই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে বাংলা ভাষার কবিগণ তখন থেকেই সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখেছেন এবং এমনকি ধর্মীয় পুস্তকাদি সংস্কৃত-আরবি-ফারসি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। উনিশ শো সাতচল্লিশ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সকল প্রত্যাশার বিপরীতে এক বছর যেতে না যেতেই বাংলা ভাষার ওপর প্রবল ধাক্কা আসে নবসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে। সেই সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানী অর্থাৎ বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে শাসক-কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেন। আর যুক্তিসঙ্গত কারণেই এবং প্রত্যাশিতভাবেই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের ঝড় তোলে মাতৃভাষাপ্রেমিক বাঙালি জাতি। উনিশ শো বাহান্নো সালে রাষ্ট্রভাষার বাংলা করার দাবিতে সোচ্চার মিছিলে পাকিস্তানী প্রশাসন গুলি চালালে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরও অনেকেই। প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় মিছিল, শহরে শহরে প্রতিবাদ সভা। আর কলমসৈনিক কবিরা রচতে থাকেন প্রতিবাদের গান, প্রতিরোধের কবিতা। প্রথম কবিতাটি রচনা করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। কবিতার নাম ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। এই কবিতায় তিনি ভাষার জন্য ভালোবাসা ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির দিকগুলো তুলে ধরেন। এই কবিতার মধ্যে ভবিষ্যতে ‘স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার’ শোনার প্রত্যয়ও ব্যক্ত হয়েছে। কবিতাটির অংশবিশেষ পাঠ করা যাক :
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেইদিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার
ভেসে আসবে
সেইদিন আমাদের দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
[কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি /মাহবুব উল আলম চৌধুরী]
ভাষা শহীদদের স্মরণে ঢাকা, রাজশাহী এবং দেশের অন্যান্য স্থানে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। কিন্তু পাকিস্তানী প্রশাসন সেই শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। পাকিস্তানী শাসকেরা ভেবেছিল শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে এবং গুলি চালিয়ে বাঙালির ভাষা আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু ক্ষমতান্ধ বলে তারা বুঝতে পারেনি ভাষার জন্য বাঙালির সংগ্রাম বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত এবং তার জন্মের বন্ধনে জড়িয়ে বাংলা ভাষা। বাঙালি কবি বহু আগেই মাতৃভাষার বন্দনাগান রচেছেন, ‘মোদের গরব, মোদের আশা / আ মরি বাংলা ভাষ!’ (অতুলপ্রসাদ সেন)। তো বাঙালি জাতি তার আশার উৎস, তার গৌরবের মিনারকে ধ্বংস হতে দেবে কেন? ইঁটের মিনার রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করে ভেঙ্গে ফেলা যায় কিন্তু যে-মিনার রচিত প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে, তাকে ভেঙ্গে ফেলবে এমন শক্তি বিশ্বে নেই। তাই তো প্রথম নির্মিত শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি কবি অত্যাচারী অবিচারকারী মূঢ় রাষ্ট্রযন্ত্রকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন হৃদয়ে রচিত অবিনাশী ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ এর কাহিনী।
ইঁটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।
পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম।
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর।
[স্মৃতিস্তম্ভ / আলাউদ্দিন আল আজাদ]
ভাষা আন্দোলন দমাতে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকার কয়েকটি তাজা প্রাণ কেড়ে নিতে সমর্থ হয়। কিন্তু আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়। ভাষার মর্যাদার দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিস্তৃত হয়ে পড়ে দেশময়। দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নেমে আসে পথে। ঢাকার রাজপথের রক্ত বিস্ফোরিত বারুদের মতো আন্দোলনের আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আর বাংলার কবিরা সেই বার্তা প্রচার করতে থাকেন আগুনের হরফে লেখা কবিতায়।
যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
আবুল বরকত, সালাম, রফিউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ন নাম! একসার জ্বলন্ত নাম!
[হাসান হাফিজুর রহমান]
বাঙালি কবি সেই কবে গেয়েছেন ‘প্রথম জেগে ধরার বুকে / মধুর মা বোল ফুটলো মুখে’! আর জন্মের পর থেকে মা’র কাছে, দাদা-দাদির কাছে, নানা-নানির কাছে, কাজলাদিদির কাছে বসে-শুয়ে শুনে আসা কত রূপকথা, কত গল্প, কত কিসসা-কাহিনি! ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়া। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা। মায়ের ডাকে আবার ঘুম থেকে জেগে ওঠা। এইসবই কিন্তু ঘটে মাতৃভাষায়, বাঙালির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায়। এই জাগরণের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা, গল্প শোনার ভাষা, আদরের ভাষা, আবদারের ভাষা যদি কেউ কেড়ে নিতে চায়, সেটা কি মেনে নেওয়া যায়? না। সবার মুখপাত্র হয়ে সে কথা বলতে হয় কবিকে। বাঙালি কবি সেই কাজটি সময়মতোই করেছিলেন।
খোকা তুই কবে আসবি!
কবে ছুটি?’
চিঠিটা তার পকেটে ছিল,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
‘মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাই তো আমার দেরী হচ্ছে।
তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ী ফিরবো।’
[মাগো, ওরা বলে/ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ]
কি হয়েছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির দিন? কি হয়েছিল সেই ৮ই ফাল্গুনের দুপুরবেলা? ঢাকা শহরের অল্পকিছু লোক সেই ভয়াবহ ঘটনা দেখেছিলেন। কিন্তু সারাদেশের মানুষ তো তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাননি। তাছাড়া পরবর্তী প্রজন্মও জানে না আসলে কতটা ভয়ংকর ছিল সেদিনের ঘটনা। সমগ্র জাতিকে, নতুন প্রজন্মকে তার অতীত সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা এবং তার মাধ্যমে তার বর্তমান পথচলার দিশা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্বটা যুগে যুগে এ দেশের কবিরা পালন করে এসেছেন। পরাধীন বৃটিশ-ভারতে তৎকালিন ভারতবাসীকে তাদের অতীত গৌরবের কাহিনী শুনিয়েছিলেন, তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাদের সামনে স্বাধীনতার দাবির কথা প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন একজন বাঙালি কবি- কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের কথাও সবার কাছে জীবন্ত ভাষায় উপস্থাপন করেছেন আমাদের কবিগণ।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুরবেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? বরকতের রক্ত?
হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে, এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!
প্রভাতফেরির মিছিল যাবে ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে নাকি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায় ঝাঁপ দিলো যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন পরলো তারই ভগ্নি।
প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।
[একুশের কবিতা / আল মাহমুদ]
প্রভাতফেরির প্রধান অনুষঙ্গ প্রভাতফেরির গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙান একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি!’ আসলে এটি একটি কবিতা। পরে বাণীতে সুর দিয়ে গানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই কবিতায় বাঙালি জাতির ওপর চালানো তৎকালীন পাকিস্তানী সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের স্টীমরোলারে কথা এবং সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান রচিত হয়েছে অগ্নিগর্ভ ভাষায়। তাই তো এই গান শুনলে এখনো আমাদের শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
[আবদুল গাফফার চৌধুরী]
একসময় পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তারপরও আমাদের বাংলাভাষাকে আরবি হরফে লেখার হীন প্রচেষ্টার কথাও ভেবেছিল রাষ্ট্র। এক শ্রেণির লেখক বাংলাভাষার নামে আরবি-ফার্সির জগাখিঁচুড়ি ভাষায় সাহিত্য রচনার প্রয়াস পেয়েছিল। অসম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা থেকে হিন্দুগন্ধী শব্দ বাদ দিয়ে তদস্থলে ইসলামগন্ধী শব্দ প্রতিস্থাপনের হীন চেষ্টাও করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদ করেছিলেন বাঙালি কবি। এবং সেই প্রতিবাদ বৃথা যায়নি।
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহিয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংসতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি।
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
[বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা / শামসুর রাহমান]
পাকিস্তান আমলে শুধু বাঙালির ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়েই ষড়যন্ত্র হয়নি, চাকরি-বাকরি সকল ক্ষেত্রে বাঙালির কপালে বৈষম্য ও বঞ্চনা জুটেছে। রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি-বেসরকারি বড় বড় পদগুলোতে অবাঙালিরা জেঁকে বসেছিল। বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ-নিপীড়ন ছিল বহুমুখি। পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি বাইশ পরিবারের হাতে জিম্মি ছিল রাষ্ট্রের সম্পদ। বাঙালিরা এসব দেখে দেখে একসময় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। আর ভাষা আন্দোলনের সাফল্য তাদের প্রেরণার উৎস হয়ে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি জোগায়। আমাদের কবিতায় সেই ছবি ফুটে উঠেছিল সুন্দরভাবেই।
আমি আর আমার মতোই বহুলোক
রাত্রি-দিন ভূলণ্ঠিত ঘাতকের আস্তনায়,
কেউ মরা, আধমরা কেউ,
কেউ বা ভীষণ জেদী, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া
চতুর্দিকে মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ।
বুঝি তাই উনিশশো একাত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্লাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা;
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
[ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ / শামসুর রাহমান]
আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের মধ্যেই উপ্ত ছিল পরবর্তী সকল আন্দোলন-সংগ্রামের উর্বর বীজ। আমাদের ছয় দফার আন্দোলন, এগারো দফার আন্দোলন, আমাদের উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন এবং সবশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধ এই সবকিছুর মূল হিসেবে কাজ করেছে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় সাফল্য। ভাষা আন্দোলনে সফল না হলে আমাদের পরবর্তী এসব আন্দোলনের প্রেরণা আসতো না। বাঙালি কবি সঠিকভাবেই ভাষা আন্দোলনের বীজরূপী ভূমিকাকে শনাক্ত এবং উপস্থাপন করেছেন কবিতায়।
একুশে আমার রক্তে বাজায় অস্থিরতার সুর
বিপ্লব জানি মহামহীরুহ, একুশ তো অঙ্কুর।
[একুশে: আমার চেতনা / বুলবুল খান মাহবুব]
একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই যে স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল এবং সেই বীজই যে একদিন অঙ্কুরিত হয়ে স্বাধীনতার বটবৃক্ষে পরিণত হবে সেকথা বাংলার কবি আগেভাগেই টের পেয়েছিলেন, সেই স্বপ্নের কথা জাতিকে পূর্বাহ্নেই শুনিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যেতে রাজনীতিবিদদের পাশপাশি কবি-লেখক-কণ্ঠশিল্পীদের ভূমিকা ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং পরস্পরের পরিপূরক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল আন্দোলনের সূতিকাগার আর কবিদের কবিতা ছিল সেসব আন্দোলনের মূলমন্ত্র। কবিরা অনেকখানি ভবিষ্যতদ্রষ্টা। বাংলা ভূখন্ড যে একদিন বাঙালি জাতির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এই স্বপ্ন দেখেছিলেন কবিরা এবং সেই স্বপ্নের কথা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কবিতার চরণে চরণে।
বাংলার মাটি যখন খরার দাপটে চৌচির ফেটে
মহীরুহের সম্ভাবনায় অঙ্কুর করে আর্তনাদ
একুশে তখন প্রবল বর্ষণের আশ্বাসে শ্রাবণের মেঘ
মৃতপ্রায় অঙ্কুরের প্রজ্জ্বলিত সূর্যমুখী চোখে
যে চোখে বাংলার কোটি মানুষ
স্বপ্ন আঁকে নতুন পৃথিবীতে সূর্যোদয়
এবং একুশে তারই গান গেয়ে সূর্যকে আহ্বান
জানায় বাংলায়।
[একুশে : একটি আশ্বাস / বাবুল আখতার]
এটা আজ সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত সত্য যে একুশের পথ বেয়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। মাতৃভাষার আন্দোলন এবং তার সাফল্য বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বায়ত্বশাসন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনে। তাই আমাদের স্বাধীনতার পতাকায় অর্থাৎ জাতীয় পতাকায় যে লালসবুজ রং তাতে মিশে আছে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা এবং বাহান্নোর ভাষা সংগ্রামীদের রক্ত ও আত্মত্যাগ। স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বে রচিত কবিতায় তাই ভাষা শহীদদের অবদানের কথা এসেছে সকৃতজ্ঞ উচ্চারণে।
ফাল্গুনের রক্তঝাউ পরে আছে বসন্তের জামা
আমি তার এক হাতা পরে অন্য অংশ দিয়েছি ভাইকে
ভাই বোনকে দিয়েছে তার সবগুলো সবুজ বোতাম
আর সুতো
আমরা সবাই মিলে ভাগ করে পেয়ে গেছি একটি পতাকা।
[একুশে ফেব্রুয়ারি/ কামাল চৌধুরী]
স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে কখনোই বাংলার কবি ভুলে যাননি একুশের কথা। ভালোমন্দ সকল প্রকার মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে এসেছে বাঙালির সকল সাফল্য। প্রেম অথবা ঘৃণা, রাগ অথবা খুশি, অনুরাগ অথবা ক্ষোভ, সমর্থন অথবা দ্বিমত, সহমত অথবা প্রতিবাদ, অনুরক্ত সম্বোধন অথবা গালি দান, সবকিছুরই প্রকাশের ভাষা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু একুশের সংগ্রামে আমরা হেরে গেলে লুট হয়ে যেত আমাদের প্রাণপ্রিয় মুখের ভাষা বাংলা। আমাদের ওপর চেপে বসতো বিদেশি ভাষা উর্দু কিংবা ইংরেজি। সেকথা স্মরণ করতে ভুল হয় না বাঙালি কবির।
অর্থাৎ যখনই চীৎকার করি
দেখি, আমারই কণ্ঠ থেকে
অনবরত
ঝরে পড়ছে অ, আ, ক, খ
[একুশের স্বীকারোক্তি / শহীদ কাদরী]
আমরা আলোচনার শুরুতেই দেখেছি সংস্কৃতভাষী হিন্দু পন্ডিতগণ বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখার জন্য রৌরব নরকের ভয় দেখিয়েছিলেন এবং একশ্রেণির মুসলিম পুরোহিতগণও বাংলা ভাষায় পুস্তক রচনাকে পাপের কাজ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি কবি সেদিন সেসব নিষেধাজ্ঞা মানেননি, পরেও মানেননি, এবং আজো মানেন না। মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা অথবা বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করার দায়ে যদি সত্যি সত্যি রৌরব নরকে যেতে হয় কিংবা শাস্তিমূলকভাবে পুনর্জন্মলাভ করতে হয়, তাতেও আপত্তি নেই বাঙালি কবির। তিনি নম্রনদীস্রোতবিধৌত এই বাংলাকেই জেনেছেন তার অর্থাৎ বাঙালির জনমের জনমের মাতৃভূমি- যেখানে একই মাতৃগর্ভ থেকে পুনঃরক্তে আবির্ভূত হয়ে তার বারবার ফিরে আসা। তিনি আর্য ধর্মের ধিক্কারকে শিরোধার্য করে ঘোষণা করেছেন বাংলাভাষাই তার মুখের উচ্চারণ। আর এজন্য যদি তাকে পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ বার বার জন্ম লাভ করতে হয়- জন্মলাভ করবেন এই মাটিতেই; যদি রৌরব নরকেও যেতে হয়- যাবেন। তিনি আর্য পুরোহিতদের ধর্মীয় সাবধানবাণী উপেক্ষা করে বাংলাভাষাতেই তার উচ্চারণ অকুণ্ঠ রাখতে অসম সাহসিকতায় শপথদীপ্ত হয়েছেন। তার সে শপথে- সে উচ্চারণে ইতিহাসগর্ভ বিষণ্নতায় মিশে আছে একুশের চেতনা।
কী প্রপঞ্চে ফিরে আসি, কী পাতকে
বারম্বার আমি
ভাষায়, মায়ের পেটে
পরিচিত, পরাজিত দেশে?
বাক্যের বিকার থেকে তুলে নিয়ে ভাষার সৌরভ
যদি দোষী হয়ে থাকি, সেই অপরাধে
আমার উৎপন্ন হউক পুনর্বার তীর্যক যোনিতে।
[জাতিস্মর/সোনালি কবিন]
একথা ভোলার নয় যে আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পৃতিষ্ঠিত করার সংগ্রামকে সে সময় অনেক রাষ্ট্রই ততোটা ভালো চোখে দেখেনি অথবা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু যেদিন বাঙালি জাতি সত্যি সত্যি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করলো, সেদিন বিশ্ববাসী স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলো যে একুশের ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সারাবিশ্বে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা যে শুধু ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে একটি ভূখন্ডের মানুষ এবং তাদের সেই আত্মত্যাগ কালক্রমে স্বাধীনতার ফসল হয়ে ফলে উঠেছে দৃষ্টান্তহীন গৌরবে। জাতিসংঘের অধিবেশনে যেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় ভাষণ দিলেন, সেদিন বিশ্বসভা চমকিত বিস্ময়ে স্মরণ করলো বাঙালির ভাষা আন্দোলনের কথা এবং তার সাফল্যকে শ্রদ্ধা জানালো। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। বাঙালির মাতৃভাষাপ্রেম এবং ভাষাকে সমহিমায় প্রতষ্ঠিার জন্য পূর্বনজিরহীন আত্মত্যাগকে প্রাতিষ্ঠিানিক বিশ্বস্বীকৃতি দিতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সর্বসম্মত স্বীকৃতি দেয়া হলো। এক্ষেত্রে এমনকি পাকিস্তানও কোনো আপত্তি জানালো না। বাংলা ভাষা, বাঙালি এবং বাংলাদেশ উন্নীত হলো অনন্য মর্যাদার সোনালি শিখরে। বাঙালি কবি মুগ্ধ শব্দমালায় লিখে রাখলেন সে কথাও।
মাগো, আজ তুমি সকল মাতার মাতা,
তোমার সোনার অঙ্গ জড়িয়ে আজ
বিশ্বরঙের ঘাসপেড়ে শাড়ি,
তোমার মুখের কথা শুনতে দেবে না বলে মা
যারা একদিন চেপে ধরেছিলো মুখ,
মাগো, মা-ডাকে বরণ করে নিতে, দ্যাখো-
তারাও আজ পথের দু’ধারে নতশিরে দাঁড়িয়ে।
যাও মা- জগতের সালাম নিয়ে এসো-
ভুলো না যেন মা-
তোমার সন্তানেরা আর শুধুই বাঙালি নয়,
মানুষও আজ- হাজার সৃষ্টির মিছিলে।
[তোমার ছেলেরা মা গো / আমিনুল ইসলাম]
একুশের আন্দোলনের প্রথম লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় উন্নীত করা। সেটি অল্পদিনের মধ্যেই অর্জিত হয়েছিল। পরবর্তীতে স্বাধীনতার অর্জনের পর একুশের লক্ষ্য সম্প্রসারিত হয়। সেটি হচ্ছে অফিস-আদালত থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মাতৃভাষার প্রচলন। এবং বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া, তার প্রসারণ ঘটানো। সেজন্য বাংলা ভাষায় আইন-কানুন বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং পুস্তকাদি রচনা এবং অন্য ভাষায় রচিত আইন-কানুন, বিধি-বিধান এবং পুস্তকাদি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা। স্বাধীনতার পর কবিদের কলমে এই প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি এবং প্রতিজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। আর পাশাপাশি এটাও সত্য যে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হয়েছে। অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। অধিকন্তু এখন মসজিদে-মন্দিরে-গীর্জায় বাংলা ভাষায় খুতবা দেয়া হয়, প্রার্থনা পরিচালনা করা হয়। এখন কোনো ধর্মও আর বাংলা ভাষার শত্রু নয়। বাংলাদেশের কবির কলমে একুশের আন্দোলনের সেই সামগ্রিক সাফল্য ও শপথের ছবি দেখতে পাই।
আমার ভাইয়ের মৃত্যু, আমার নিজের প্রতিরোধ
আগামী প্রাণের ঠোঁট
আমরাও কথা দেব
আমরাও ভাষা হব মায়ের মুখের।
[এ আমার দেশ / আবুল হাসান]
কবি আবুল হাসান বলেছেন যে আমাদের স্বাধীনতার প্রতিটি গোলা ইমামের নতুন শস্যে ভরে উঠছে। সেটা সত্য। সেই গোলা হচ্ছে আমাদের সাহিত্যসংস্কৃতির ভান্ডার। নতুন শস্য হচ্ছে আমাদের কবিতা-গান-উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক-সিনেমা। আমাদের দেশের প্রতিটি অঙ্গন কাবঘরের মতো পত্রি ও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই বাংলা ভাষার একেকজন নতুন বেলাল। আমাদের ভাষার সব গোলাঘর নতুন শস্যে ভরে উঠেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে তারপর এখন আর কেন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটা করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা? কারণ আছে। পৃথিবীর অনেক জাতির মাতৃভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো আমাদের মাতৃভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিও আজ নতুন হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বায়ন আর আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসন এখন ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভুত হয়েছে। ইউরো-মার্কিন জোট তাদের ভাষা (মূলত ইংরেজি) এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। হলিউডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বলিউড আগ্রাসন। সুতরাং আমাদের আত্মতৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। প্রতিবছর একুশ এসে আমাদের চেতনায় সে সচেতনতাই নবায়ন করে দিয়ে যায়।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা বায়ান্নোর একুশে
প্রতি বছর ফিরে আসে তপ্ত আগুন পুষে,
এই একুশের শহীদ মিনার শক্তি সাহস ভরা,
জাতির বিবেক শানিয়ে আজো দূর করে দেয় জরা।
[এই একুশে / অনীক মাহমুদ]
একুশ আমাদের জড়িয়ে রেখেছে একটি অন্তহীন পবিত্র শপথে। একুশের পথ বেয়ে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। স্বাধীণতার সংগ্রামের প্রাথমিক সফল সমাপনী উনিশ শো একাত্তর সালে স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু স্বাধীনতা মানে শুধু একটি নিজস্ব জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত নয়। স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন করাই হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের চরিতার্থতা। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি আনয়ন এবং সর্বোপরি সকল মানুষের আর্থ-সামজিক মুক্তি এবং স্বনির্ভরতা অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতার চাওয়া এবং অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আর সেজন্য একুশের সেই দীপ্ত শপথ ও আত্মত্যাগের কথাকে মুহূর্ত বিস্মৃত হওয়া চলবে না। বাংলাদেশের মানুষ তা বিস্মৃত হবে না।
বাঙালির মাতৃভাষাকে নিয়ে সংগ্রাম কি থেমে গেছে? না। বাঙালি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘যতদূর বাংলা ভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ’। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম বড় ভাষা। প্রায় ২৫/২ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। পৃথিবীর ১৬৫টি দেশে বাঙালি কাজ করছে অভিবাসন সূত্রে। তাদের সাথে গেছে বাংলাভাষা। বাংলাভাষার প্রকাশ ক্ষমতা, শ্রুতিমাধুর্য এবং সাহিত্যসংস্কৃতির ভাণ্ডার বিশ্বদরবারে সামনের সারিতে আসন পাওয়ার মতো সমৃদ্ধ। কিন্তু এখন আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাভাষাকে প্রত্যাশিত মাত্রায় বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। এখনও বাঙালি অভিবাসীরা সেসেব দেশে বাংলাভাষা ব্যবহারের ন্যূনতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এমতাবস্থায় এদেশের কবি স্বপ্ন দেখেন বাংলাভাষাকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এবং সেই সংগ্রামে জয়ী হওয়ার।
বঙ্গভাষা অপেক্ষায় আছে তার কনিষ্ঠ সন্তান
আকাঙ্ক্ষা মুক্তি পেলে
একদিন সংসারেরর সব দায় তার কাঁধে দিয়ে
রবীন্দ্রনাথের মতো বের হবে বিশ্বদর্শনে।
[বঙ্গভাষা/ রেজাউদ্দিন স্টালিন]