
আমরা যখন পর্বতারোহী
“উত্তন পেগে মেঘে মেঘে/মেঘুলো দেবাত তলে
ম পরানন যেদ মাগে/তারা লগে লগে।”
চাকমা ভাষার এই জনপ্রিয় গানের অর্থ “উড়ছে পাখি মেঘে মেঘে। মেঘলা আকাশের নীচে। আমার প্রাণ যেতে চায় তাদের সাথে সাথে।” আমরা এবার মেঘেদের সাথে বান্দরবান থেকে যাত্রা করেছি আরো উঁচুতে বাংলাদেশের তখনকার সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং-এর পথে। প্রথমে চাঁদের গাড়িতে যেতে হবে রুমা বাজার। এখানে রাত্রিযাপন শেষে বগা লেকের উদ্দেশে যাত্রা। বগা লেক আমাদের ‘বেসক্যাম্প’। ছয় বন্ধু এসেছিলাম সাংগ্রাই উৎসবে। চার বন্ধু ঢাকা ফিরে গেছে। যোগ দিয়েছে আরো চার বন্ধু। সুতরাং আমরা ৬ জনই থাকছি কেওক্রাডং অভিযাত্রী হয়ে।
চাঁদের গাড়ি নামক জিপখানি চলতে শুরু করেছে রুমার উদ্দেশে। একেবারে গাদাগাদি করে বসার ব্যবস্থা। ব্যাগপ্যাকগুলো ছাদে রাখা হয়েছে। আমরা বসেছি ভেতরে। আমরা একজন আরেকজনের একেবারে কাছে থেকে মুখ দেখা ছাড়া বাইরে দৃষ্টি দেওয়ার উপায় নেই। পথিমধ্যে বিরতি চিম্বুকের কাছে ওয়াই জংশনে। বান্দরবান থেকে সোজা রাস্তা এখানে এসে দুইদিকে একটি রুমা ও আরেকটি থানচির দিকে চলে গেছে। তাই এর নাম ওয়াই জংশন। জীবনে অবশ্য আমরা এমন বহু ‘ওয়াই জংশন’ পাড়ি দিই। কতবার যে আমাদের একটি রাস্তা দুটি হয়ে যায়! আমরা গাড়ি থেকে নেমে আসি। এখানে সেনাবাহিনীর চৌকিতে চেকিং হবে। এই ফাঁকে আমরা আয়েশ করে চা-পর্ব সেরে নিই। কিছুক্ষণ পর গাড়ি আবারো চলতে শুরু করলো রুমা সড়কে। সড়ক এবার ক্রমশ উপরের দিকে উঠে যাবে। দীর্ঘ সময় ক্রমোন্নতির পর অবনতি। আবারো উন্নতি আবারও অবনতি। এ যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন সূচক ও বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের চাকারই নিরন্তর উঠা-নামা।

গাড়ির ভেতর থেকে প্রকৃতির তেমন কিছুই দেখতে পাইনি। প্রায় ৪০ কি.মি. পথ ২ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে গাড়িটি পৌঁছে গেলো সদরঘাট নামক স্থানে। একেবারে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাতেও দেখছি ‘সদরঘাট’ আছে! এটি রুমা বাজারের পূর্বপ্রান্তে সাঙ্গু নদীর তীর। নদীর ঢাল ধরে নেমে আসি। নিচে নৌকা বাঁধা ছিলো। একটি নৌকায় আমরা ছয়জন ছাড়াও আরো চারজন যাত্রী উঠে বসি। জনপ্রতি ভাড়া ৫০ টাকা। পাহাড়ি নদী সাঙ্গু বা শঙ্খ নদীর এখানকার সৌন্দর্য আমাদের কাছে একেবারে নতুন। দুই দিকে উঁচু-নিচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সাঙ্গু। নদীতে এখন কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমর অবধি জল। অন্যান্য নদী থেকে সাঙ্গু নদীর বাঁকটাও একটু বেশিই। বাংলাদেশের সকল নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হলেও একমাত্র সাঙ্গু বা শঙ্খ নদী বাংলাদশের অভ্যন্তরে দক্ষিণে মায়ানমার সীমান্তের আরাকান পর্বতে উৎপত্তি হয়ে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। নৌকায় আমাদের ভ্রমণসঙ্গী কৃষি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা, একজন ছাত্র, একজন ব্যবসায়ী। সবাই বাঙালি। পাহাড়ি যাত্রী একজনই, কলেজপড়ুয়া একটি চাকমা মেয়ে। যদিও এই এলাকায় অধিকাংশ স্থায়ী বসতি মারমাদের। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গড়ে উঠেছে মারমা বসতি। দূরে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের গায়ে অনেকটা ঘনবসতি। কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা জানালেন, ঐ তো রুমা বাজার। এই ভদ্রলোক আমাদের থাকার ও খাবার কয়েকটি হোটেলের নাম বলে দিলেন।
রুমার সন্ধ্যা, রুমার রাত
দুপুরের খাবারের সময় অতিক্রম করে গেছে অনেক পূর্বে। সবাই ভীষণ ক্ষুধার্ত। নৌকা ঘাট থেকে আমরা সোজা চলে যাই রুমা বাজারে রেস্তোরাঁর খোঁজে। রেস্তোরাঁয় বসেই দ্রুত খাবার দেওয়ার জন্য সবার তাড়া। দলনেতা প্রিন্স ভাই ও বন্ধু বাকি রন্ধনশালায় গিয়ে খোঁজ-খবর নিতে থাকে। এক বন্ধু অনাবশ্যক চিৎকার করে বলে ‘সার্ভিস ভালো না এই হোটেলে’। হঠাৎ দেখি বাকি ও প্রিন্স ভাই উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা বলছেন। আমাদের বন্ধু সাবেক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী তার দীর্ঘ দশ বছরের অভিজ্ঞতার সার-সংকলন বর্ণনা করছে। প্রিন্স ভাই বলছেন খাবার সম্পর্কে তাকে জ্ঞান না দিতে। বিষয়টা কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, বন্ধুটি নিজ দায়িত্বে যখন হাঁড়ির খোঁজ নিতে গিয়েছিলো, তখন প্রিন্স ভাই এভাবে হাঁড়ির খবর নিতে বারণ করেন। বন্ধু বাকি কোনভাবেই প্রিন্স ভাইকে বোঝাতে পারছে না সে কারো হাঁড়ির খবর নয়, খাবারের মেন্যুর খবর নিতে গিয়েছিল। প্রিন্স ভাই আবার নিয়মের বাইরে যেতে রাজি নন। তার কথা হল খাবারের মেন্যুর খবর নিতে কিচেনে কেন যেতে হবে? যেহেতু তিনি দলনেতা, ঝামেলাগুলো তিনিই সামলাবেন! আমাদের এই অবস্থা দেখে হোটেলের ম্যানেজার, কর্মচারী সবাই রীতিমত দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দেয়। তাদের রেস্তোঁরায় তখন ভাত ছিল না। তাই পাশের রেস্তোঁরা থেকে গরম গরম ভাত এনে টেবিলে হাজির করে। গোলমাল সৃষ্টিকারী বন্ধুটি মিটি মিটি হেসে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে। ম্যানেজারকেও দেখি মিটিমিটি হাসছে। আমিও মৃদু হেসে জবাব দিই। ম্যানেজার বুঝতে পেরেছে আসলে লোকগুলো একেবারে খারাপ নয়। ক্ষিদে একটু বেশি পেয়ে গেছে এই যা।
আমরা যে আবাসিক হোটেলে উঠেছি সেটির মালিক কাম ম্যানেজারের ভাবভঙ্গি একটু বেশিই আয়েশি। সাতকানিয়ার লোক। কোন কিছু চাইলে বা বললে উত্তর পাওয়া যায় বড্ড দেরিতে। সার্ভিসের এই অবস্থা দেখে এক বন্ধু তো বলেই ফেললো ‘উনাকে একটু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কয়েকমাস প্রশিক্ষণ দিলে বোধহয় কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে!’ আমাদের হোটেলের কক্ষগুলোও বেশ! একেবারে আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ডের বোর্ডিংয়ের মত। কী আর করা এই পাহাড়ি জনপদে কীইবা আশা করা যায়? রুমা থেকে পরদিন সকালে আমরা দীর্ঘ পথ ট্রেকিং করে যাব বগা লেকে। খানিকটা আয়েশি বন্ধু বাবু এই দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে মৃদু আপত্তি করে। ফলে আমরা জিপের খোঁজ করি। কিন্তু রুমা থেকে কোনো নিয়মিত প্যাসেঞ্জার জিপ বগা লেকে যায় না। বিকেলে আমরা আমাদের ছোট নদী সাঙ্গুর শীতল জলে হাপুড়হুপুড় ডুব পাড়তে পাড়তে শরীর জুড়িয়ে নিই।
সন্ধ্যার পর রুমা বাজারের সাঙ্গু নদীর ঘাটে আমরা আবার মিলিত হই। শুরু হয় গান-বাজনা। অন্ধকারের মধ্যে যে গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়েছে তা’ মনে হয় এলাকাবাসী অনেকদিন মনে রাখবে। গিটারসহ টিটুর গানের সাথে আমাদের কারো নৃত্য পরিবেশনা বাদ যায়নি। অনুসঙ্গ হিসাবে আমাদের কাছে যতোগুলো টর্চ লাইট ছিল তা দিয়ে আলোর নাচানাচি। বন্ধু বাবু আলোর নাচন সৃষ্টিতে বেশ ওস্তাদ মনে হলো। সেইসাথে নধরকান্তি প্রিন্স ভাই ও বাবু’র বিস্ময়কর নৃত্য! শুনেছি ভূতেরাও নৃত্য করে। আমাদের এই তাল-লয়হীন নৃত্যের সাথে ভূতের নৃত্যের কোনো সাদৃশ্য আছে কিনা জানিনা। তবে আমাদের নৃত্যের সাথে টিটু গিটারে একের পর এক গান গেয়ে চলেছে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে’, ‘করিমনা কাম ছাড়ে না মদনে’, ‘মন আমার দেহঘড়ি, সন্ধান করি, কোন মিস্তিরি বানাইয়াছে’ এমনই অজস্র জনপ্রিয় গান। নাগিন বাঁশির সুরে যেমন সর্প চলে আসে, রাখালের মিষ্টি ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’র সুরে গ্রামের তরুণী নিজেকে হারিয়ে ফেলে, ঢোলকের বারিতে শহর-গ্রামের সব বয়সের মানুষকে আলোড়িত করে তোলে, আমাদের গান ও অদ্ভূতুড়ে নৃত্যে আকৃষ্ট হয়ে ঠিকই গান গাইতে গাইতে চলে আসে তখনকার দারুণ জনপ্রিয় শিল্পী ‘আসিফ’! রুমা বাজারে আমাদের গানের শব্দ যতোটুকু গিয়েছে, পাহাড়ের উঁচু বসতি থেকে আমাদের মারমা ও বাঙালি ভাই-বোনেরা যারা দেখেছেন তারা অবাক না হয়ে পারেননি। এমনকি সেনা সদস্যরাও ক্যাম্প থেকে আমাদের এই ভূতুড়ে নৃত্য-গীত সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন।

আমরা আসিফকে দেখে চমকে উঠেছিলাম! পরে দেখি না, এতো গায়ক আসিফের কণ্ঠ হুবহু নকল করা নকল ‘আসিফ’। আসিফ-এর সাথে আসে তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ। নকল আসিফ আবার টিটুকে ওস্তাদ মান্য করে বলে— ‘জয় গুরু’। আসিফকে একটি গান গাওয়ার কথা বললে, সে আসল আসিফের জনপ্রিয় একটি গান গেয়ে শোনায়। এক পর্যায়ে টিটুকে উদ্দেশ্য করে বলে— গুরু, এটা বেয়াদবি হচ্ছে, আমি আপনার সামনাসামনি বসে গান করছি। আপনাকে ওস্তাদ মেনেছি, তাই আমি অন্ধকারে গিয়ে গান গাইবো, আপনি বাজাবেন। গুরু সম্মতি দিলেন। কিন্তু আমাদের রুমার জনপ্রিয় শিল্পী আসিফ অন্ধকারে গিয়ে গাঁজায় দম নিয়ে এলেন। এবার এসে সরাসরি গুরু ও আমাদের গঞ্জিকা সেবনের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা বলি— ভাই, এই সাধনায় আমরা অভ্যস্ত নই। সবাই দীর্ঘক্ষণ গানেই মজে থাকি। সবকিছুর শেষ আছে। এক সময় আমাদের থামতে হয়। তখন আরেক নৃত্য শুরু হয়েছে উদরে। তাই আসিফ গংসহ সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রেস্তোরাঁর পথ ধরি।
সবাইকে যেনো গানে পেয়ে বসেছে। রাতে হোটেলের রুমে বসেও গান। এবার অবশ্য তাল-লয়হীন নৃত্য ও চড়া স্বরের গান নয়। এবার শুরু হলো সৃষ্টিশীল কিছু করার প্রচেষ্টা। প্রিন্স ভাই কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন। লিখে ফেললেন বান্দরবান ও আমাদের ভ্রমণ নিয়ে একটি চমৎকার গান। শিরোনাম দিলেন স্বপ্নে বান্দরবান। টিটু গিটারে টুং টাং করতে করতে দারুণ একটি সুর তোলে ফেলে। আমরা সকলে গেয়ে উঠি-
বান্দরবান,
স্বপ্নের বান্দরবান।
পাহাড়ে ঘেরা সবুজের মেলা
মনে দেয় যে দোলা।
চিম্বুকে চড়ে
নীলগিরি ঘুরে
সাংগ্রাই উৎসবে
চলে জলকেলি
সাঙ্গু নদীতে।
চাঁদের গাড়িতে
পাহাড়ি পথে
ঝর্ণার গানে গানে
রুমা হয়ে বগাতে
আকাশের মেলাতে।
দার্জিলিং পাড়াতে
পায়ে পায়ে উঁচুতে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা
স্বপ্নের কেওক্রাডং-এ
সাধের ইচ্ছাতে।
ড্রাগন লেকের সন্ধানে
গভীর রাত পর্যন্ত জেগে, গান ও আড্ডায় মেতে তবে ঘুমুতে যাই। অনেক ভোরে উঠে জিপ পেলে ভাল, না পেলে রুমা থেকে হেঁটে বগা লেকেরে উদ্দেশে রওয়ানা হতে হবে। ভোর সকালে হোটেলের মালিকের ডাকে ঘুম ভাঙে। এবার ভদ্রলোক বেশ করিৎকর্মার পরিচয় দেন নিজে এত সকালে ঘুম থেকে জেগে। একটি জিপ যাচ্ছে বগা লেকে। আমরা যেতে চাইলে যেতে পারি। দেরি না করে আমরা ঝটপট তৈরি হয়ে নিই। প্রথমে সেনাক্যাম্পে ভ্রমণকারী ছয়জনের নামের তালিকা ও আমাদের গাইডকে চেহারা দেখিয়ে আসতে হল। আমরা যাকে গাইড হিসেবে নিয়েছি দেখে মনে হয় আলাভোলা একটি কিশোর ছেলে। নাম রেফাত। বাড়ি যথারীতি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা ছেলেটিকে গাইড হিসেবে মানতে আমাদের যেন একটু কষ্ট হচ্ছিল। ও কী পারবে? খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সে-ই এখানকার ভালো গাইড। সেনাক্যাম্পের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর আমরা জিপের উদ্দেশে পা বাড়াই। আমাদের গাইড ‘আসছি’ বলে আরেকটু এগিয়ে যায়। ওই পথেই ওর বাড়ি। আমরা জিপের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পরে একটু দূর থেকে হেঁটে আসা একটি ছেলেকে দেখে আমরা তো অবাক! ওই তো আমাদের গাইড রেফাত! মাথায় ক্যাপ, গায়ে টি-শার্ট ও স্পোর্টস ট্রাউজার এবং কাঁধে ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এসে ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন’ বলে আমাদের তাড়া দেয়। তার ডিউটি শুরু হয়ে গেছে। আমাদের গাইডের চেহারাই পাল্টে গেছে। শুধু পাল্টায়নি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার টান। আহা, মায়ের ভাষা কী আর এতো সহজে পাল্টানো যায়?
চাঁদের গাড়ি ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। রুমা বাজার থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে জিপটি সাঙ্গু নদীর পার ধরে এগিয়ে যায়। রুমা থেকে বগা লেক, কেওক্রাডং এমনকি তাজিনডং পর্যন্ত এখন চাঁদের গাড়ি বা জিপে যাওয়া যায়। পূরোটাই কাঁচা ও প্রচণ্ড চড়াই-উৎরাই রাস্তা। পাহাড়ের বন্য সৌন্দর্য ক্রমাগত বাড়ছে। বহু দূর যাওয়ার পর দেখা মেলে একটি পাহাড়ি গ্রামের। জিপের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সৌন্দর্য উপভোগ করা এত সহজ ছিল না। পাহাড়ে জিপের নাম ‘চাঁদের গাড়ি’ কীভাবে হল তা এখানে না এলে কোনদিনই জানতাম না! এই পথে ট্রেকিং করাই সবচাইতে উত্তম। হেঁটে গেলে যেমন দেখা যায় অনেক বেশী, শরীরের ধকলও হয় কম। আমারা ৬ জন ছাড়াও যাদের সাথে আমরা ভ্রমণসঙ্গী হয়েছি তারা মূলত আনসার বাহিনীর জন্য বাজার-সদাই নিয়ে যাওয়া দু’জন ব্যক্তি। অপরযাত্রী একটি কিশোর বম ছেলে। আমরা বসেছি জিপের পেছনে, মালামালের সাথে। এক সময় রাস্তাটি মারাত্মক খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। জিপের গোঙ্গানির সাথে আমাদের দু’য়েকজনের গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেলাম! জিপের একজন যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা হচ্ছে ‘জুয়েল বমের রাস্তা’! জুয়েল নামে একজন বম কাঠ ব্যবসায়ী সে। সে-ই এই পাহাড়ি রাস্তা নির্মাণ করেছে কেওক্রাডং পর্যন্ত। জুয়েল বম তার রাস্তায় যেসকল জিপ যায় তার থেকে টোল আদায় করে। জীপ প্রতি ৫০০ টাকা।
একসময় চাঁদের গাড়ির দুঃসহ যাত্রার অবসান হয়। আমরা বগা লেকে পৌঁছে যাই। রাস্তা থেকেই মুগ্ধ হয়ে যাই চারিদিকে পাহাড়ঘেরা লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। নিমিষেই দূর হয়ে যায় সকল ক্লান্তি। ছিয়াম বমের অতিথিশালাতেই আমাদের মাথা গোঁজার ঠাই হয়। ছিয়াম বমের এখানে থাকা ও খাওয়া দুটোরই ব্যবস্থা আছে। ঘরগুলোও আমাদের পছন্দ হয়েছে। ছিয়ামদি নিজ হাতে সব গুছিয়ে রেখেছেন। যেন আমরা আসব তিনি আগে থেকেই জানতেন। টিনশেড ও বেড়ার তৈরি ঘরের ভেতরে শোয়ার খাট ছাড়া আসবাবের তেমন বালাই নেই। তারপরও কোথায় যেনো সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। বগা লেকের পাড় ঘেঁষে বেশ উঁচু পাহাড় চূড়ায় গিয়ে সেনাক্যাম্পে রিপোর্ট করি সবাই। বেলা তখন ১১টা। আজ তো আর কেওক্রাডং যাওয়া হচ্ছে না। রেফাত বলে, আজ তাহলে রোমাঞ্চকর বান্দরগুহায় যাওয়া যাক। আমরা বেশী দেরি না করে চা-টা খেয়ে রওয়ানা হয়ে যাই বান্দরগুহার উদ্দেশে।
পাহাড়ি পথে ট্রেকিংয়ের সুবিধার্থে বন-বাদাড় থেকে একেকজন বাঁশের লাঠি সংগ্রহ করে নিয়েছি। কেওক্রাডং-এ যাওয়ার পথেই পড়ে বান্দরগুহা। পাহাড়টি বেশ উঁচু। উঁচু থেকে বগা লেক ও তার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠ বাড়িগুলোর সৌন্দর্য অপরূপ লাগে। সবকিছু ছবির মত সুন্দর। বগা লেকের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠা গ্রামটির নাম বগাকাইন। এখান থেকে দেখা যায় আরেকটি পাহাড়ি গ্রাম সাইকত পাড়া। সাইকত পাড়া থেকে এসেই বগা লেকে বসতি স্থাপন করেছেন এখানকার স্থানীয় বম জনগোষ্ঠী। বগা লেকের তিনদিকে পাহাড়। বম জনগোষ্ঠী ছাড়াও এই পাহাড়গুলোতে বসবাস করে মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ।

আমরা সারি বেঁধে পাহাড়ে উঠছি। বগাকাইন গ্রামটি লেকের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা একটি অনিন্দ্য সুন্দর ছোট্ট গ্রাম। তবে আমাদের বেশীক্ষণ চিত্রকর্মের নন্দনে মুগ্ধ হলে চলছে না। ক্রমাগত পাহাড় চড়া, ক্লান্ত হয়ে একটু থামা এভাবেই এগিয়ে চলেছি। অবশেষে আমরা বান্দরগুহার মুখে এসে পৌঁছে গেলাম। গুহায় নামাটাও এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। বাঁশের মই আছে নিচে নামার জন্য। ‘অজানা আশংকা’য় অতি সাবধানী দু’জন বাদে আমরা একে একে চারজন নেমে আসলাম। গুহার ভেতরে এমনই অন্ধকার যে টর্চের আলোকেই গ্রাস করে নিচ্ছে। কিছুই দেখা যায় না। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু কিছু জায়গা এমনই সরু যে আমাদের ক্রলিং করে যেতে হচ্ছিলো। ক্রলিং করে কিছুদূর গিয়ে একটু বড় জায়গায় এসে থামি। এবার আরো ভেতরে যাওয়ার প্রস্তুতি। এখানে আমাদের গাইড টর্চ জ্বেলে যা দেখায়, এরপর আর ভেতরে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ মনে করিনি আমরা কেউ! তাকিয়ে দেখি বিশাল আকৃতির একটি বিষাক্ত পাহাড়ি বিছা গুহার উপরের পাথরে স্থির হয়ে বসে আছে। যেন আদিমকাল থেকেই সে ওখানেই আছে। তার রাজত্বে এই মনুষ্য উৎপাতে সে কী জবাব দিবে তাই যেন ভাবছিল! এখানেই শেষ নয়। অসংখ্য চামচিকার স্থির বসে থাকা ও একটি বাদুড়ের বিশ্রীভাবে ঝুলে থাকার দৃশ্যও খুব আনন্দদায়ক ছিল না আমাদের কারো জন্য। সামনে আরো কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে? আমরা দ্রুত ‘রিট্রিট’ করি। একে একে সবাই বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে আসি। সবার শেষে দলনেতা প্রিন্স ভাই মোটা শরীর নিয়ে আমাজান জঙ্গলের পাইথনের মত শরীর দোলাতে দোলাতে উপরে উঠে আসেন। মোটা দেহের অসুবিধাটা পুরোপুরি টের পেলেন তিনি। আমাদের বান্দরগুহা দেখার শখ এখানেই শেষ হয়ে যায়! একই পথ ধরে বগা লেকে যখন নেমে আসি তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আহার গ্রহণের পূর্বে আমরা শরীরের ক্লান্তি জুড়াতে বগা লেকের শান্ত শীতল জলে সন্তরণ করে আসি। পাহাড়ে ক্ষুধার আন্দোলনটা যেন একটু বেশিই হয়! ছিয়ামদির খাবার ঘরে বসে গোগ্রাসে মোটা লাল চালের ভাত, মিষ্টি কুমড়োর সব্জি ও ছোটো মাছ দিয়ে এক স্বর্গীয় খাবারের স্বাদ আস্বাদন করি। সেদিন আমরা সকলেই বিস্মিত হয়ে সমস্বরে বলে উঠি— আমরা এতো খেতে পারি?
ক্লান্ত শরীর নিয়ে আজ সন্ধ্যায় বগা লেকের পাড়ে বসে থাকাটাই পৃথিবীর সুন্দরতম একটি কাজ বলে মনে হয়। সন্ধ্যার পর মজে থাকি লারাম বম, ছিয়ামদির ভাই এবং বন্ধু টিটুর গানে। রাতের খাবার শেষে আমরা আবার আড্ডায় মেতে উঠি। ভ্রমণ মানে তো আড্ডা, রোমাঞ্চ, বন্ধুত্ব, খুনসুটি, নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, নানা বিষয়ে বিতর্ক, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া এমনই কতো অনুসঙ্গ। আমাদের এর কোনটাই বাদ পড়ে না। মাঝে মাঝে বেশিই হয়ে যায়। তবু ভ্রমণ বড় স্বাস্থ্যকর— মানসিক ও শারীরিক উভয় বিচারে। এই কারণেই তো আগের কালের ডাক্তারবাবুগণ বায়ু পরিবর্তনের জন্য রোগীদের ভ্রমণের পরামর্শ দিতেন। এই কালের ব্যস্ত ডাক্তারবাবুগণ অবশ্য আর এই পরামর্শ দেননা। অবশ্য তাদের দোষ দিয়েই বা কী হবে। তারা আজকাল এত ব্যস্ত যে নিজেরাই বায়ু পরিবর্তনের সময় পান কীনা সন্দেহ! কেউ নিজে যা করেন না, তা অন্যকে কি উপদেশ দিতে পারেন?
রাতে ছিয়ামদি’র উঠানে বসে স্থানীয় এক বয়োবৃদ্ধ মানুষের সাথে গল্প জমে উঠে। তিনি বগা লেক সৃষ্টির পৌরাণিক গল্প শোনান। অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায ড্রাগনকে ‘বগা’ বলা হয়। ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদি পশু উৎসর্গ করত। এখানে একটি চোঙা আকারের পাহাড় ছিল। হঠাৎ করে পাহাড়ি গ্রামগুলো থেকে গবাদি পশু এবং ছোট ছোট শিশুরা ঐ চোঙ্গা পাহাড়ে হারিয়ে যেতে লাগল। কয়েকজন সাহসী যুবক এর রহস্য উদঘাটনে নেমে পড়ে। তারা ঐ চোঙ্গা পাহাড়ে গিয়ে দেখতে পায় একটি ভয়াল দর্শন ড্রাগনকে। সাহসী যুবকগুলো তখন ঐ ড্রাগনকে হত্যা করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গুহা থেকে আগুন বেরিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী সব গ্রাম ও পাহাড় পুড়িয়ে ফেলে। সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। আর ঐ ভূমিকম্প থেকেই বগা লেকের সৃষ্টি।
বগাকাইন হ্রদ বা বগা লেক সৃষ্টি নিয়ে বম, মারমা, ম্রো, খুমি ও ত্রিপুরাদের পৌরাণিক কাহিনি আছে। এবার ম্রোদের বিশ্বাসের গল্প। বগা লেকের পাশে ছিল একটি সমৃদ্ধ ম্রো গ্রাম। গ্রামের পাশে একটি সুড়ঙ্গে বড় আকারের একটি সাপ বাস করত। একদিন ওই সাপটিকে একজন গ্রামবাসী ধরে খেয়ে ফেলে। ওই সাপ খাওয়ায় নাগরাজ রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন। ফলে গ্রামের সকল মানুষসহ গ্রামটি মাটির নিচে দেবে যায় এবং লেকের সৃষ্টি হয়। এখনো অনেক বম ও ম্রো’দের বিশ্বাস, হ্রদের গভীরে থাকা নাগরাজ লেজ নাড়লে হ্রদের পানি ঘোলাটে হয়ে ওঠে!
রাত হয়ে যাওয়ায় আমাদের গল্পের আসর শেষ হয়। আমি বগা লেকের পাড়ে পড়ে থাকা বেশ বড় আকৃতির একটি পাথরে গিয়ে বসি। আমার সামনে রহস্যময় বগা লেক। দূরে পাহাড়ে সন্ধ্যা বাতি জ্বলে উঠেছে। গল্পের রেশ এখনো যায়নি। সাত সকালে শুরু করতে হবে কেওক্রাডং অভিযান। কুটিরে ফিরে আসি। বগা লেকের পৌরাণিক কাহিনীর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।
কেওক্রাডং-এর পথে
ভোর সকালে উঠেই যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়। পাহাড়ি পেঁপে ও বিস্কুট দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে শুরু হয় আমাদের কেওক্রাডং যাত্রা। সবার হাতে বাঁশের লাঠি। কারো হাতে পানির বোতল, কারো হাতে শুকনো খাবার, কেউ কেউ বহন করছে ক্যামেরা। কিলোমিটার খানেক যাওয়ার পর বাম দিকে উঠে গেছে বান্দরগুহার পথ। আজ সোজা উঠছি কেওক্রাডংয়ের পথে। পথিমধ্যে একদল সেনাসদস্যকে পাই। তারা সম্ভবত কাঠ কাটার জন্য জমায়েত হয়েছে। সেনাসদস্যরা আমাদের গাইডকে ডাকে। আমরা সামনে এগিয়ে যাই। গাইড ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করি— কী বললো ওরা? সে জানায়, তারা জুয়েল বমের দুর্গম পথ দিয়ে যেতে বলেছে! ইস্, জওয়ান ভাইয়েরা, আমাদের সাথে এ কী নির্মম রসিকতা! আমাদের কী আর আপনাদের মত লেফট-রাইট করা শরীর?
বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে একটা ঘন জঙ্গলের মতো জায়গায় থামি। একটি ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণাধারায় শরীর জুড়িয়ে নিই সকলে। আবারো পথ চলা। কখনো গাছ-গাছালি ঘেরা বন, কখনো ন্যাড়া পাহাড়, কখনো বাঁশঝাড়। শুধু নেই কোনো প্রাণির হঠাৎ আনাগোনা। নেই পাখির ওড়াউড়ি। বগা লেক থেকে ১৮ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি দার্জিলিং পাড়াতে। দার্জিলিং পাড়া থেকে মাত্র ৪ কি.মি. দূরে কেওক্রাডং চূড়া। বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে আরেকটি ঝর্ণা দেখতে পাই। জলখাবার বিরতি। সমতলের বাসিন্দা সবারই পারফরমেন্স বেশ! এবার গাইড আমাদের পাহাড়ি ছোট রাস্তা ছেড়ে বড়ো রাস্তায় নিয়ে আসে। এটা সেই আলোচিত জুয়েল বমের রাস্তা। বেশ খাড়াভাবে উঠে গেছে ওপরের দিকে। এই পথে দেখা হয় একদল পাহাড়ি নারী-পুরুষের সাথে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তারা নামছে রুমার পথে। পাহাড়ি এক তরুণ নিজে থেকে এসে হাসিমুখে আমাদের সবার সাথে করমর্দন করে। আহা, এইভাবে যদি সকল পাহাড়ি-বাঙালি করমর্দন করেই জীবনযাপন করত!
উপরে উঠছি তো উঠছি। শরীরে খানিকটা ক্লান্তি ভর করেছে। দূরে ছোট্ট ছিমছাম পাহাড়ি গ্রাম দার্জিলিং পাড়া দেখতে পাই। অল্প কয়েকটি ঘর রয়েছে এখানে। বম অধ্যুষিত গ্রাম। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। এখানে দেখলাম আদার চাষ হয় বেশ। আমরা একটি দোকানে বসে চা খাই। দার্জিলিং পাড়া থেকে তাকিয়ে দেখি কেওক্রাডং চূড়াকে। আমরা আবারো হাঁটা শুরু করি। এখন আবার প্রকৃতি যেনো তার রূপ পাল্টে ফেলেছে। বেশ কিছু বড় বড় গাছপালা দেখা যায়। ন্যাড়া পাহাড়ও আছে। পাহাড়ে বৃক্ষনিধনের জন্য দায়ী বৈধ-অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের লোকজনও গাছ কাটছে। পাহাড়িদের জুমচাষের কারণেও ন্যাড়া হচ্ছে পাহাড়। কেওক্রাডংয়ের পথে মাইলের পর মাইল পাহাড় দেখেছি একদম বৃক্ষশূন্য। গাছপালা না থাকায় বন্যপ্রাণী, পাখি ইত্যাদি বিরল হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ে। অথচ মাটি ও প্রকৃতির জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর তামাক চাষ ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চলে। গাছপালার স্বল্পতা ছাড়াও বন্যপ্রাণী না থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে শিকার। বম জনগোষ্ঠী বন্যপ্রাণী শিকারে ভীষণ পটু। একটি কথা প্রচলিত আছে, কোনো পাখি যদি কোন বমকে দেখে তাহলে সে তো পালিয়ে যাবেই, আশে পাশে যতো পাখি আছে তাদেরও সতর্ক করে দিয়ে যাবে—সাবধান, সামনে একজন বম আছে!

আমরা পাহাড় যাত্রার শুরুতে যেভাবে গান গাইতে গাইতে, কথা বলতে বলতে পাহাড়ে উঠছিলাম, শেষে কথার মাত্রা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকলো। সমতলের মানুষের পাহাড় চড়ার কত আর শক্তি থাকে? অবশেষে আমরা কেওক্রাডং চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। টিটু ও গাইড রেফাত অনেকটা আগে চলে গেছে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের কারণে ওদের দেখাও যাচ্ছে না। পথ আছে আরো কিলোমিটার খানেক। সামনে দুটো পথ দেখা যাচ্ছে— একটা সোজা চলে গেছে, আরেকটা ডানদিকে একটা ন্যাড়া ও পোড়া পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। এখন আমরা কোন পথে যাবো? গাইডকে ডেকেও কোনো সাড়া পেলাম না। আমরা পাঁচজন ন্যাড়া পাহাড় ধরে ডানদিকের পথে এগুতো থাকলাম। অনেকটা পথ অগ্রসর হওয়ার পর সামনে বিশাল এক বাঁশঝাড় এসে আমাদের পথ আগলে দাঁড়ায়। দূর থেকে দেখতে পাই আমাদের গাইড কেওক্রাডং চূড়ায় উঠে জাতীয় পতাকা নাড়ছে। চিৎকার দিয়ে সে আমাদের এই বাঁশঝোপের পথে যেতে মানা করছে। তার মানে আমরা ভুল পথে এসে পড়েছি। কষ্টটা বাড়ল আরকি। মাছুম ও প্রিন্স ভাই গাইডকে ভীষণ বকাঝকা শুরু করে এক বহু দূর থেকেই। অবশ্য সবাই রেফাতের চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ টিটুর ওপর। কারণ ও কেওক্রাডং চূড়ায় আমাদের দলের ‘প্রথম অভিযাত্রী’র খেতাব অর্জন করবে বলে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে সে! ইয়ার্কি আরকি!
অবশেষে মূল পথ ধরে আমরা কেওক্রাডং চূড়ায় আরোহণ করি। সর্বশেষ ধাপে সিমেন্ট দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করা আছে। সিঁড়ি বেয়ে একে একে সবাই চূড়ায় উঠে আসি। টিটু ও গাইডের ওপর এক পশলা বাক্যবাণ বৃষ্টি হয়ে গেল। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও তা ছিল একেবারে ক্ষণিকের, কারণ চূড়ায় উঠে বাইরের ঝলসানো রোদের মতো সকলের মন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে। তীব্র রোদেও কোথা থেকে যেন শীতল হাওয়ার পরশ এসে জুড়িয়ে দেয়। একটু আগে প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভের বিষয়গুলো ভুলে গিয়ে আমরা মেতে উঠি পাহাড় চূড়া বিজয়ের আনন্দে। ক্যামেরায় নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলা হয়। জাতীয় পতাকা সামনে নিয়ে ছবি তোলা হয়। আমরা যেন ক্রেওক্রাডং নয়, মাউন্ট এভারেস্ট বিজয় করে ফেলেছি!
কেওক্রাডং চূড়ায় দুটো কংক্রিটের স্তম্ভ আছে যেখানে এর উচ্চতা লেখা আছে ৩২৭৩ ফুট। তাহলে এটাই কী সঠিক? এই উচ্চতা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি এখনো রয়ে গেছে। বিভ্রান্তি রয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া নিয়ে। কেওক্রাডং না তাজিনডং উঁচু পর্বত? নতুন আরো বিতর্ক যুক্ত হচ্ছে সিপ্পি না মিরিঞ্জা? এখন কেউ কেউ বলছেন কেওক্রাডং প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় তো নয় বাংলাদেশের সপ্তম উঁচু পর্বত চূড়া! আমরা অবশ্য তর্কপ্রিয় জাতি। সামান্য এই পাহাড় চূড়া নিয়েও বিতর্ক! কে আগে এভারেস্ট উঠেছে তাই নিয়েও বিতর্ক! কে উঠেছে, কে উঠেনি তাই নিয়েও বিতর্ক! বিতর্ক আমাদের পিছু ছাড়ে না। আরো কত বিষয় নিয়ে যে বিতর্ক আছে! বিতর্ক চলতে থাকুক। আমরা ফিরে আসি আমাদের অভিযানে।
কেওক্রাডং চূড়ায় রয়েছে এক টুকরো সমতল ভূমি। এখান থেকে দেখা যায় বিশাল পাহাড় শ্রেণী। দূরে পাহাড়ি গ্রাম, সেনাক্যাম্প ইত্যাদি। আরো দূরে ধোঁয়াশার মধ্যে মধ্য থেকে অনুমান করে নেয়া যায় বাংলাদেশে-মায়ানমারের সীমান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তাজিনডং সহ আরো কয়েকটি পর্বত চূড়া। বম ভাষায় তাজিনডং অর্থ সবুজে ঘেরা পাহাড়। আর কেওক্রাডং অর্থ হচ্ছে পাথুরে ঘেরা পাহাড়।
তীব্র আনন্দ সবসময়ই ক্ষণস্থায়ী। আমাদের মাথায় চিন্তা, দিনে দিনে বগা লেকে ফিরতে হবে। আমরা নামতে শুরু করি। ফিরতি পথে দার্জিলিং পাড়া, দুটো ছোটো ছোটো ঝিরি বা ঝর্ণা, ভয়ংকর সুন্দর কয়েকটি খাদের কিনার এবং আরো কয়েকটি নয়নাভিরাম পাহাড়ি চিত্রকর্মের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্য থেমেছিলাম। একটি ঝিরিতে স্নান করা ছাড়া আমাদের পথ ছিলো বিরামহীন। অবশেষে বিকেল চারটা নাগাদ বগাকাইন-এ পৌঁছে গেলাম। শেষ হল আমাদের কেওক্রাডং অভিযানপর্ব।
বগালেকে দ্বিতীয় রাত
পৌঁছেই সোজা সিয়ামদি’র খাবার ঘরে। খাবার তৈরীই ছিল। ছিয়ামদি’র মা খাবার পরিবেশন করলেন। ডাল, ডিম, সব্জি ও মোটাচালের ভাত যে এতো সুস্বাদু হতে পারে তা জানতে আপনাদের একবারের হলেও কেওক্রাডং থেকে নেমে এসে দুপুরের খাবার খেতে হবে। গোগ্রাসে সবাই গিলতে থাকি আমরা। ক্ষিদে পেলেই নাকি খাবারের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। ছিয়ামদি খুব ভালো বাংলা বলতে পারে। কিন্তু তার মা বাংলা বলতে পারেননা, বোঝেনও কম। আমাদের গাইড রেফাত তখন দোভাষীর কাজ করে। পেশাগত প্রয়োজনে সে প্রয়োজনীয় কিছু বম ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছে।
বিকেলে যথারীতি বগা লেকের কিনারে বড়ো বড়ো পাথরে বসে থাকি। সন্ধ্যা নেমে আসে। বম পাড়াগুলোতে আলো জ্বলে উঠে। ছিয়াম বম ও লারাম বম-এর ডেরায় আলো জ্বলে উঠে। গিটার হাতে টিটু গান শুরু করে। গানের আসর বসে ছিয়ামদির আস্তানায়। টিটু ছাড়াও ছিয়ামদির ভাইও গান গেয়ে শোনায়। লারামের গাওয়া বম ভাষায় একটি গান অসাধারণ লাগে। গানের কথায় সেই চিরায়ত প্রেম ও প্রেমাষ্পদকে না পাওয়ার বেদনা ঝরে পড়ে। গানের সুর যেন এই পাহাড়ি পরিবেশের জন্যই সৃষ্টি। কী এক রহস্যময় কারণে আমার কাছে পাহাড়ের সব গানের সুরগুলো একই রকম মনে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিজোরাম, অরুণাচল, মেঘালয় কিংবা হিমালয়ে যেখানে যাই! পাহাড় শ্রেণীর কোল ঘেঁষে বসবাসরত মানুষগুলোর মধ্যে অভিন্ন সাংস্কৃতিক বন্ধনই বুঝি সঙ্গীতের এমন অভিন্ন সুর সৃষ্টি করে?
গানে গানে সন্ধ্যা রাতকে আলিঙ্গন করে। পাহাড়ে রাত নামেও বড্ড তাড়াতাড়ি। রাতের খাবার খেতে খেতে ছিয়ামদি’র সাথে অনেক কথা হয়। ছিয়ামদি গ্রাজুয়েশন করা মেয়ে। পূর্বে তার বাবা ছিলেন এই এলাকার বমদের হেডম্যান। ছিয়ামদি’র বাবার সাথেও পরিচয় হয়। অত্যন্ত সাদাসিদে মানুষ। বগা লেকে আসা নানা পর্যটকের ছবি ও তার ঢাকা ভ্রমণের কয়েকটি ছবি আমাদের দেখান। তিনি অনেক কথাই বলছিলেন কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে সব কথা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য আন্তরিকতার কারণে দেহের ভাষা ও মুখভঙ্গিতে যেন আমরা তার সব কথা বুঝতে পারছিলাম!
ছিয়ামদি ভারতের মাদ্রাজে স্কলারশীপ নিয়ে যাওয়ার জন্য তার পরিবার থেকে বেশ চাপ আছে। কিন্তু তিনি যেতে চাচ্ছেন না। বমরা মূলত ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। এখানে মিশনারিজদের বেশ কার্যক্রম আছে। ছিয়ামদি যে বৃত্তি পেয়েছেন সেটাও মূলত খ্রিস্টান মিশনারি কর্তৃক দেয়া বৃত্তি। দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হবে তাকে। সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। ভারতে গেলে প্রশিক্ষণ শেষে তাকে মিজোরামে তার ভাইয়ের ওখানে যেতে হবে। ওখানেই বিয়ে দেওয়ার চিন্তা পরিবারের। ছিয়ামদি’র ভাই মিজোরামে পুলিশে চাকরি করছেন। এতোটুকু বলে ছিয়ামদি থামলেন। আমরা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে ছিয়ামদি’র গল্প শুনছিলাম। এবার আমি ছিয়ামদি’কে বলি— তাহলে এখানে নিশ্চয় আপনার পছন্দের কেউ আছে যার কারণে কারণে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না? কোনো মুখের ভাষা ব্যবহার না করে রহস্যময় হাসি দিয়ে ছিয়ামদি উত্তর দিলেন, যার মর্মার্থ উদ্ধার করতে আমাদের তেমন বেগ পেতে হলো না।

আগামীকাল আমরা রুমার উদ্দেশ্যে ঝিরি বা ঝর্ণার পথ ধরে হেঁটে যাব, না জিপ পাওয়া যায় কিনা দেখবো? এই প্রশ্নটি যখন প্রিন্স ভাই ছিয়াম দিদিকে করেন, তিনি এককথায় বলেন— ‘অবশ্যই ঝিরি পথ ধরে হেঁটে যাবেন। ঝিরি পথে না গেলে পাহাড়ের আসল সৌন্দর্যই আপনাদের দেখা হবে না।’ টিটু জানতে চায়— ঝিরিপথে কয় ঘণ্টা লাগতে পারে? পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। সময় শুনে টিটু কিছুটা ব্যাকফুটে গেলো বলে মনে হয়। টিটু নিজের কথা না বলে আমাদের সৌম্যকান্তি আরামপ্রিয় বাবুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাবুর কথা তো পরিষ্কার— জিপ পাওয়া গেলে জিপেই যাবে। আমরা অন্য সদস্যরা এবার শক্তভাবে হেঁটেই যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিই। হেঁটে যাওয়া বা জিপে যাওয়া নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে মৃদু বাদানুবাদ শুরু হয়। কথার পিঠে কথা বেড়ে এক সময় মৃদু তর্ক খানিকটা বচসায় রূপ নেয়। দুজনের পাল্টাপাল্টি কথাবার্তা যখন উচ্চগ্রামে চলে যাচ্ছিলো, বগা লেকের রাতের নিস্তব্ধতাকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলো তখন আমরা দ্রুত আমাদের কক্ষে চলে আসি। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে। ঘরে এসেও তর্ক অব্যাহত থাকে। ঢেঁকির শব্দ ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। কথার পর কথা, যুক্তির পর পাল্টা যুক্তি দিয়ে যে বিতর্ক, সেটা হয় উপভোগ্য। চিৎকার-চেঁচামেচিতে যে কথাবার্তা, সেটা মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্রকৃতির বেশ খানিকটা ক্ষয়ক্ষতি করে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি এবং বজ্রপাতও এক সময় থামে। আমাদের দুই বন্ধুর ঝগড়াও একসময় পরিবেশকে খানিকটা ক্ষতি করে থামলো। ঝড়-বৃষ্টি তার প্রকৃতির নিয়মে থামে। কিন্তু মানুষকে তো তার নিজস্ব নিয়মে থামতে হয়। শেষ পর্যন্ত নিয়মেরই জয় হল।
পায়ে হেঁটে রুমার পথে ফিরতি যাত্রা
সূর্যোদয়ের সাথে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। সকাল বেলা শুরু হলো ঝিরিপথে রুমা যাওয়ার প্রস্তুতি। বাক্সপ্যাটরা রাতেই সবাই গুছিয়ে রেখেছিলাম। প্রাতঃরাশ সেরেই আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম রুমা বাজারের উদ্দেশে। অবশ্য ছিয়ামদি’র সাথে ছবি তুলতে আমরা ভুলিনি। এই দুর্গম পাহাড়ে এমন একজন বুদ্ধিমতি পাহাড়ি নারীর আতিথ্য আমরা পেয়েছি, যিনি ভ্রমণকারীদের আপন করে নিতে জানেন। বড়ো কথা ছিয়ামদি পর্যটন বিষয়টা তার মতো করে যথার্থই বুঝে নিয়েছেন। ছিয়ামদির কথা অনেকদিন মনে থাকবে। লারাম বম বলে— আবার আসবেন। এরপর তাজিনডং নিয়ে যাবো। পাহাড় ভ্রমণের আরেকটি দারুণ রুট হতে পারে রুমা থেকে বগা লেক, বগা থেকে কেওক্রাডং হয়ে তাজিনডং শিখরে উঠা। ফিরতি পথ হবে তাজিনডং থেকে থানচি হয়ে বান্দরবান।
বগা লেকের একমাত্র শিক্ষালয় বগা লেক প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অভিযাত্রী বেড়াতে এসে এটি প্রতিষ্ঠা করে। এর বর্তমান শিক্ষয়িত্রী ও তত্ত্বাবধানে আছেন ছিয়াম বম। তিনি বম ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ভার নিয়েছেন। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা, যারা এখন পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেছেন তাদের আর্থিক সহায়তা এখনো অব্যাহত আছে বলে বিদ্যালয়টি চলছে। যারা এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা অভিযাত্রী বা ভ্রমণকারীদের চমৎকার একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। ভ্রমণকারীরা চাইলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণের পাশাপাশি সমাজ কল্যাণমূলক কাজও করতে পারেন।
কেওক্রাডং নয়, রুমা থেকে বগালেগের ঝিরি পথের ট্রেকিং হচ্ছে সবচাইতে রোমাঞ্চকর ও বৈচিত্র্যে ভরা। আমরা বগা লেক ছাড়িয়ে খাড়া একটি পাহাড় অতিক্রম করি। পাহাড়ের অনেক নিচে পটে আকা ছবির মতো দেখা যাচ্ছিল একটি বম গ্রাম। গাইডকে অনুসরণ করে একে একে পাহাড় অতিক্রম করছিলাম। এই পাহাড়গুলো যেমন উঁচু তেমনি বিপদসঙ্কুল। এতটুকু মনোযোগের অভাবে অনেক নিচে পতন হয়ে যেতে পারে। কয়েকটি খাড়া পাহাড় অতিক্রম করে এলাম কোনো বিপদ আপদ ছাড়া। তবে দুয়েকজন এরমধ্যে পা পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছে নিজেকে। এভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর আমরা ঝিরিপথে নেমে আসি। এই ঝিরিপথ ধরেই আমরা আরো ঘণ্টাচারেক হেঁটে পৌঁছাবো রুমা বাজারে। ঝর্ণার পানির ধারা ধরে পাহাড়ি পথে আমরা যখন সারিবদ্ধভাবে সাতজন লোক হাঁটছিলাম তখন আমাদের মন প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে গান গেয়ে উঠে। কেউ গান, কেউ হাসি-ঠাট্টা, নানা গল্প করে একের পর এক ঝিরি পথ অতিক্রম করে যাচ্ছি। একবার একটি ঝর্ণার মুখে বিশ্রাম নিই অল্পক্ষণ। আবারো পথচলা। আমরা রওয়ানা দিয়েছি সকাল সাড়ে ৭টায়। যথাসময়ে পৌঁছালে আমরা দুপুর সাড়ে ১২টায় পৌঁছে যাবো রুমা বাজারে। সেখান থেকে আধা ঘণ্টার পথ ধরে ঘাটে। ঘাট থেকে এক ঘণ্টা লাগবে নৌকায়। কিন্তু দুপুর ২টায় শেষ জিপখানি ছেড়ে যাবে বান্দরবানের উদ্দেশে। ওই জিপটা আমাদের ধরতেই হবে। কারণ আজ বান্দরবান পৌঁছাতে না পারলে আমরা রাতে ঢাকার বাস ধরতে ব্যর্থ হবো। তাই সকলকে বলা হয়েছে দ্রুত পা চালাতে আর সেটা বেশ মনোযোগের সাথে পালন করছে সবাই ।
অদ্ভূত সুন্দর পাহাড়ি ঝিরিপথ ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। এই পথে গাছপালার বেশ আধিক্য দেখতে পেলাম। পাখিও দেখতে পেলাম। পাহাড়ের ওপর দুটো গয়াল দৃষ্টিগোচর হয়। পথিমধ্যে আমরা বগামুখ ছাড়াও অনেকগুলো পাহাড়ি গ্রাম অতিক্রম করে এসেছি। দু’একবার দেখা মিললো পাহাড়ি নারী-পুরুষদের সারিবদ্ধভাবে বগা লেক অভিমুখে যাত্রা। তারা হয়ত বগা লেক হয়ে দার্জিলিং পাড়া অথবা সাইকত পাড়া যাবে। কিংবা আরো দূরের কোনো উঁচু পাহাড়ি গ্রামে তাদের গন্তব্য।
ঝিরিপথে একই সাথে পাহাড়, মাইলে পর মাইল ঝর্ণাধারার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া, বম ও মারমা গ্রাম, জুমক্ষেত, পাহাড়ি নদীতে মাছধরা এমনই নানা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলেছি আমাদের গন্তব্যে। ছিয়ামদি ঠিকই বলেছে, ঝিরিপথ দিয়ে না আসলে আসল সৌন্দর্য থেকেই বঞ্চিত হতাম! পাহাড়ি প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছে দোকান, যেগুলোর অন্যতম খরিদ্দার হচ্ছে আমাদের মতো ভ্রমণকারী। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ আমরা একটি মারমা পাড়ায় থামি। এখানে একটি দোকানে এসে বিশ্রাম নিই ও চা পর্ব সেরে নিই। পনেরো কি.মি. পথের আমরা প্রায় দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ দশ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়েছি। আমাদের এবার পা চালাতে হবে আরো দ্রুত। আমাদের পথ চলাতে সবাই যে একই অবস্থান নিয়ে হাঁটছি তা নয়। কেউ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ পিছিয়ে পড়ছে।
অবশেষে পৌঁছে গেলাম রুমা বাজারের অনেকটা কাছাকাছি। পায়ের অবস্থা তখন দুর্গম অঞ্চল থেকে যুদ্ধফেরত সৈনিকের মতো। কিন্তু সর্বশেষ যে পাহাড়ে আমাদের উঠতে হবে সেটি দেখেই ক্লান্তিটা বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। অন্যকিছু ভাবারও অবকাশ নেই। ক্লান্তির চিন্তা তো মাথায় আনাই যাবে না। আমরা আমাদের ভ্রমণের সবচাইতে ‘ভয়ংকর’ পাহাড়টি ডিঙ্গিয়ে যখন একটি মারমা পাড়াতে পৌঁছালাম, তখন সকলের বুকের ধড়ফড়ানি ভয়ানক মাত্রায় বেড়ে গেলো। যেন কামারের সাতটি হাঁপড় একসাথে উঠানামা করছে। আমি নিশ্চিত স্টেথোস্কোপ ছাড়াই বাইরে থেকেই হার্টবিটের শব্দ শুনতে পেতেন ডাক্তার। সময় তখন দুপুর ১টা। অল্পক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা এবার পাহাড়ের ঢাল নামতে থাকি। অবশেষে রুমা বাজারের আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে দলনেতা প্রিন্স ভাই ছাড়া সকলে হাতের লাঠি ছুড়ে ফেলি। তখন মনে হচ্ছিল হাতের লাঠিটিরও অনেক ওজন বেড়ে গেছে। রুমা বাজারে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে ঐ টিলার ওপর উঠে আমাদের কারোরই রিপোর্টি করার মত শারীরিক শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। ভাবছিলাম একজন কাউকে পাঠিয়ে কাজটি সেরে ফেলি। গাইড রেফাত স্পষ্টভাবে সবার উদ্দেশ্যে তার শেষ নির্দেশ প্রদান করে ‘সবাইকে যেতে হবে’। আমরা আবারো তাকে অনুসরণ করে কোনোরকমে ওপরে উঠে সেনা ভাইদের বলে আসি আমরা সবাই সুস্থভাবে ফিরেছি। দ্রুত নৌকাঘাটের দিকে এগিয়ে যাই। ঘাটে একটি নৌকো ঠিকঠাক করে দেয় রেফাত। রেফাতকে বিদায় জানাই। চমৎকারভাবে আমাদের গাইডের দায়িত্ব পালন করেছে সে। আমরা রুমা বাজার ছেড়ে বান্দরবানের উদ্দেশে যাত্রা সেই চাঁদের গাড়িতে।
রুমা বাজারে যখন আমরা ঢুকছিলাম তখন আমাদের উদ্দেশ্যে একজন দোকানদারের মন্তব্য এখনো আমার কানে ভাসে— ‘কী আছে পাহাড়ে যে এত কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে বগা লেক থেকে আসতে হল আপনাদের? কীইবা আছে পাহাড়ে দেখার মতো?’
ভাবনার কথা, পাহাড়ে কী এমন মধু আছে যে এমন কষ্ট করে পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে? অভিযাত্রীরা কেনই বা এতো কষ্ট করে পর্বতারোহন করে? পর্বতশৃঙ্গ জয় করে? উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেয়? দুর্গম মরু অতিক্রম করে যায়? কিংবা গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যায়? কী এর রহস্য?