
আবুল হাসানের ‘একটি মহিলা আর একটি যুবতী’ কবিতার নারী পাঠ নির্মাণ
আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫) বাংলা সাহিত্যের কবি। ক্ষীণায়ু জীবন তাঁকে কেবল তিনটি অসামান্য কাব্যের স্রষ্টা করে রেখেছেন এবং তিনি এতেই তাঁর মৌলিক শিল্পীসত্তার স্মারক নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তাৎপর্যময় অধ্যায় বিশ শতকের ছয়ের দশক; আবুল হাসানের কবি হয়ে ওঠার সময়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশেই তাঁর প্রথম কাব্য রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২) প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্য এবং তৃতীয় কাব্য হলো যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪) ও পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫) তাঁকে যে স্বীকৃতি দেয় তার ধারাবাহিকতা তিনি অব্যাহত রাখার সুযোগ পাননি। তিনটি কাব্য ছাড়াও তাঁর বেশকিছু অগ্রন্থিত কিন্তু সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। আবুল হাসানের প্রতিটি কবিতার পাঠ একটি অনন্য অভিজ্ঞতার সম্পদ।
কবি শামসুর রহমানের ভাষায় আবুল হাসান ‘পা থেকে নখ পর্যন্ত কবি’ অর্থাৎ কবিতার ভেতরেই তাঁর জীবনের যাপন। সমশিল্পবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অসংখ্য কবিতা থেকে আলোচনার জন্য কোনো একটি বিশেষ কবিতা নির্বাচন দুঃসাধ্য। তবুও প্রচলিত সমালোনা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে ভাষাভিত্তিক পাঠ নির্মাণের প্রয়াসকে একটি তৃষিত অন্বেষা হিসেবে বিবেচনা করে একটি কবিতা নির্বাচন করা যায়। আপাত আড়ালে থাকা, কম পঠিত এবং প্রচলিত বাংলায় জনপ্রিয়তা মেলেনি এমন একটি কবিতা ‘একটি মহিলা আর একটি যুবতী’। আবুল হাসানের যে তুমি হরণ করো কাব্যের অন্তর্গত এই কবিতার ভাষা ভিত্তিক পাঠ নির্মাণের অবলম্বন হতে পারে। আবুল হাসান তার এই কাব্য উৎসর্গ করেন ‘উদ্বাস্তু উন্মূল’ যৌবনসঙ্গী, বন্ধুবরেষু কবি নির্মলেন্দু গুণকে। উদ্বাস্তু-উন্মূল জীবন যাপনের কবি আবুল হাসান। আবুল হাসানের নারীপাঠ বা নারীদর্শন প্রকাশ পায় এই কবিতায়। বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে কবিতার পঙক্তিগুলো উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক :
জানে না কখন ওরা পাশাপাশি এসে শুয়ে থাকে!
একটি মহিলা আর একটি যুবতী বহুরাত এইভাবে
শুয়ে শুয়ে দেখেছে আলোর পাশে নির্জনতা কত বেমানান!
একজন নারীর ভেতর একটি মহিলা এবং একটি যুবতী সত্তার বসবাস। এই সহবাস প্যারাডক্স নির্মাণ করে। নারী সচেতনভাবে কেবল মহিলা হয়ে থাকতে চায় এবং অবচেতনে তার সত্তা জীবিত হয় রমণীতে। দুই সত্তাকে পরস্পর সমন্বয় করা যায় না। একই শরীরে বাস তবুও আপাতবিরোধীতা তাদের মধ্যে একটি সার্বক্ষণিক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি করে। একজন নারীকে ব্যবচ্ছেদ করলে মস্তিষ্ক জড়িয়ে থাকবে মহিলা সত্তা এবং বাকী শরীরাংশ থেকে যাবে যুবতীর কাছে। বিজ্ঞানের পাঠ থেকে জানা যায় প্রজেস্টেরণ হরমোনের প্রভাবে নারী আলাদা হয় পুরুষের থেকে। তবে পুরুষ ও নারীর প্রেম যৌনতার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে ডোপামিন ও অ্যাড্রেনালিন হরমোন ও গ্রন্থির ক্ষরণ। প্রকৃতিগত স্বাভাবিক এই শারীরবৃত্তিকে অস্বীকার করার উপায় তো থাকে না কারো। তবুও সমাজ, সংস্কার নারীকে মস্তিষ্ক চালিয়ে আপাত সংযমী করে তোলে। এতে নারীর অবদমন হয়। তার প্রকাশও ঘটে ঘটনার অবদমিত প্রতিক্রিয়া হয়ে। আবুল হাসানের অধিকাংশ কবিতার ভেতর একটি অন্তর্গত নারীস্বর উপস্থিত থাকে এবং সেই সাথে থাকে একটি রমণীলক্ষ্য। দ্বিতীয় কাব্যের আরেকটি কবিতা; যা বহুল পাঠে, জনপ্রিয় সেই ‘নিঃসঙ্গতা’ কবিতাকে এই কবিতার সাথে প্রতিতুলনা করা যায়। সেখানে এক নিঃসঙ্গ বালিকার পুরুষের কাছে রমণী হবার আকুতী প্রকাশ পায়। একটি মহিলা আর একটি যুবতী থেকে উল্লিখিত চরণে দেখা যায় কবি লেখেন যুবতী আর মহিলা শুয়ে শুয়ে দেখেছে আলোর পাশে নির্জনতা কত বেমানান। নারীকে তিনি বললেন ‘আলো’ তাই সেই আলোর পাশে সঙ্গীহীন নির্জনতা মানানসই নয়। সঙ্গীর সাথেই তো নারীর দ্যুতি আরো বিকশিত হওয়ার কথা। এরপরেই কবি উচ্চারণ করেন :
ফলে একদিন দিনভাঙা দিনান্তের আলো দুই দেহের ভিতরে নিয়ে
দেখেছে আঁধার আজো কেন উষ্ণ, কেনে এত তীব্র গন্ধময়!
দেখেছে খোঁপায় কালো ভাঙনের বিলাসীতা কেমন মানায় সেই তমসায়
কেমন কালোর বর্ণ ধরে রাখে দুজনের দটি কালো চোখ
এই ছত্রগুলিতে কবি বারবার ‘কালো’ শব্দটি লেখেন কিন্তু সব কালোকে তিনি একই অর্থে ব্যবহার করেন না। আঁধারেই কী জেগে ওঠে নারী! কালো অন্ধকার তাকে যৌনতার আকাঙ্ক্ষী করে তোলে। নারী নিজে আলো কিন্তু আলোতে সে নিজেকে দেখে না। ফ্রয়েডের ইরস জীবন সঞ্জিবনী তো মূলত সেক্স ড্রাইভ বা যৌনযাত্রা তা অন্ধকারেই নারীর ভেতর প্রবেশ করে। আবুল হাসানের চেনা জগতে বাস করা সকল নারী বাঙালি। কাজেই এই ভূমির অগ্র-পশ্চাৎ সকল ধর্ম ধারণ করা, সারল্য-সংস্কারে পূর্ণ সেই নারী। সুতরাং আঁধারপ্রিয়া এই নারীকে পাশ্চাত্যের নারীসত্তার সাথে মিলিয়ে দেওয়া চলে না। এই কবিতা যখন রচিত তারও বছর দশেক পূর্বে পশ্চিমের নারীরা ‘অন্তর্বাস’ স্বাধীনতার দাবিতে নগ্ন হয়ে রাস্তায় শ্লোগান তোলে। কাজেই বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকে নারীকে তার হৃদয়দ্বার উন্মোচন করতে অন্ধকারের অপেক্ষা করতে হয়নি। কান্টের এনলাইটমেন্ট তাদের ভেতর প্রবাহিত। কিন্তু আবুল হাসান এ কবিতার মহিলা যুবতী আঁধারবৃত্তে আাবদ্ধ। তমসায় সে নিজেকে দেখে আর অনুভব করতে চায় শরীরি আবেদনকে। কবি বলেন ‘কেমন কালোর বর্ণ ধরে রাখে দুজনের দুটি কালো চোখ’। এই দুজনের এবং দুটি শব্দের উপর আবশ্যক জোর দেবার কারণ এই যে, কবি নিজেই এখানে মিলিয়ে দেন এই দুই সত্তাকে। দুজনের চারটি চোখ হওয়ার কথা কিন্তু কবি বোঝালেন সত্তা আলাদা হলেও শরীর আলাদা নয়। এর পরবর্তী পঙক্তিগুলো হলো :
একটি মহিলা আর একটি যুবতী এইভাবে বহুরাত
আধখানি চোখ চায় আধখানি ইশারায় কী যে সব বলে!
তারপর মহিলা যুবতী মিলে, যুবতী ও মহিলায় একটি উত্তপ্ত কণ্ঠ কামুক রমণী হয়ে যায়!
আর সেই রমণীকে দেখে ফেলে একটি আদিম কালোরাত!
এই রমণী হওয়া চিত্রাঙ্গদার নারী হবার বাসনার মতো। মুণিপুর রাজার দুহিতা চিত্রাঙ্গদা পুরুষের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। ধ্যানরত অর্জুনতে দেখার পরেই প্রথম রণব্রতা চিত্রাঙ্গদা সুরূপা রমণী হবার আকুলতা প্রকাশ করে মদনদেবের কাছে। মদনদেব তাকে অর্জুনপ্রিয়া করে তোলে। নূতন প্রাণ দাও, পাণসখা বলে চিত্রাঙ্গদার যে আকুতি তা চিরন্তন। একই শরীরে নারী ও পুরুষ সত্তা নিয়ে বাস তার। পুরুষের সান্নিধ্যেই তাঁর নারী অর্থাৎ যে সত্তা পুরুষের সাথে শরীরে, মনে মিলিত হত পারে তার প্রতি বাসনা। কিন্তু মিথ্যায় আবৃত্ত নারী ঘচাবে মায়া অবগুণ্ঠন’ তাই নারী-পুরুষ হবার খেলা সাঙ্গ হয় চিত্রাঙ্গদার। তেমনি করে মহিলা আর যুবতীর রমনী হওয়ার সময়টি কেবল একটি আদিম কালো রাত’। এরপরের স্তবকটি কবিতাটির মূলসুরকে ধারণ করে। কবি লেখেন :
আর সেই রমণীকে দেখে ফেলে নগ্ন মহিলা আর নগ্ন যুবতী
আর সেই রমণীকে দাঁতে দাঁতে দীর্ঘতর করে তোলে তীব্র দংশন
আর সেই রমণীকে ঘৃণা করে মহিলা ও যুবতী আবার! যে নারী যৌনতার আবেদনে সাড়া দিলো সেই আবার নিজের এই অন্তর্গত সত্যকে অস্বীকার করে ঘৃণার মধ্যদিয়ে। পুরুষের যৌনতার উচ্চারণ স্বতঃস্ফূর্ত তবে নারীর ভেতর এটি এক লজ্জার নাম। শব্দের রাজনীতিতে নারীকে তুচ্ছ করার নমুনা কী নারীকে আরও ক্ষুদ্র করে তোলে সে প্রশ্ন ভারতবর্ষে সবসময়ই অনুচ্চারিত। সামন্তযুগের কেরালার এক নারীর প্রতিবাদের কথা স্মরণে আসে। দক্ষিণভারতে তখন নারীর পোশাকের উপর কর দেবার প্রচলন ছিল। যে নারী তার শরীর কাপড়ে আবৃত্ত করবে তাকে কর দিতে হবে। বিত্তবান সমাজের নারীর এতে খুব অসুবিধা হয় না কিন্তু নিম্নজীবী নারীকে সবশ্রেণির পুরুষের জন্য উন্মুক্ত যৌনবস্তুতে পরিণত করার অপচেষ্টা ছিল তখন। এক নারী কর অস্বীকার করে তার বক্ষ অনাবৃত্ত করে রেখে কাজে যায় এবং এর শাস্তি হিসেবে জমিদার তার স্তন কেটে নেয়। এই কবিতার আলোচনার প্রয়োজনে সেই স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই। নারীর পোশাক, নারীর শরীর সবকিছুর উপর পুরুষ আধিপত্য করেছে আদিম সময় থেকে। নারীর পোশাক পরা বা না পরা সবসময় নির্ভর করেছে পুরুষের ইচ্ছার উপর। কিছু শব্দের ভয়, শব্দের সাথে যুক্ত হবার আসক্তি তাকে স্বাভাবিক হতে দেয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যেসকল প্রশংসা এবং নিন্দাসূচক শব্দের ব্যবহার নারীর সাথে ব্যবহার করা হয় তার কোনো পুরুষবাচক শব্দ হয় না। ‘সতী’ শব্দের বাসনায় নারী কলঙ্ক, বেশ্যা ইত্যাদি শব্দকে ‘সতী’ শব্দের বাসনায় নারী কলঙ্ক, বেশ্যা ইত্যাদি শব্দকে ভয় করে। নারীবাদীতত্ত্বের আলোকে এই আলোচনা নয় কিন্তু আবুল হাসানের এই কবিতার বিশ্লেষণে এটুকুর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন বর্তমান সময়ের কবিতা পুরুষ উচ্চারণে পূর্ণ। আবুল হাসানের কবিতা সেই ধারাকে ভেঙে দেন। তাঁর কবিতা নারীহৃদয়ের অন্তর্লোকের সন্ধান দেয়। সিমোন দ্য বোভেয়ার নারী দশাগ্রস্ত কবিসত্তা আবুল হাসানের। কবিসত্তা নির্বাচন প্রকাশ পায় তাঁর ভাষায়। যুগে যুগে নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্যকামী সহিংসতার একটি তীব্র কিন্তু নারীর মতোই কোমল প্রতিবাদ আবুল হাসান করেন তাঁর কবিতায়। নারীকে ব্যবহার করে পুরুষের যে প্রতিবাদ, প্রতিশোধতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক সানী হুন্দালের মন্তব্য প্রকাশ করা যায়। তিনি বলেন :
In patriarchial and feudal societies, women are almost always seen as the bearers of culture and honor’. Traditional, conservative South Asian culture fetishizes Women to such on extent that, while the official line says they are held in high esteem and regard, in actual fact, they are treated simply as vessels of that honor, and their lives are forced to be structured around preserving that. (Sunny Hundal 2013 : 10)
অর্থাৎ দক্ষিণ এশীয়, পিতৃতান্ত্রিক, রক্ষণশীল নারীদের সবসময় পুরুষের কর্তৃত্বকে মেনে চলতে হয়। সকল সম্প্রদায়ের মানুষ নারীকে তাদের জাতিগত সম্মাননার প্রতীক মনে করে। সুতরাং নারীকে অসম্মান করতে পারলে গোটা সম্প্রদায়কে পরাজিত করা যায়। যেমন পৃথিবরি সকল যুদ্ধেই নারী চরম অবমাননাকর এবং অনিরাপদ পরিস্থিতির স্বীকার হয়। যুদ্ধবাজ পুরুষের সানী হুন্দাল ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ব্লগার। তিনি ব্রিটেনের Gurdian পত্রিকায় উপর্যুক্ত বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রবন্ধে দেখান বর্ববরতম আক্রমণ নারীর উপরই ঘটে। এর নেপথ্যে ব্যক্তিগত অবদমনের প্রতিক্রিয়াও ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে এই অবদমনের বিপরীত প্রতিক্রিয়াও কীভাবে প্রকাশ পায় সেকথা লেখেন কবি আবুল হাসান। স্মরণ করতে হয় তিনি তাঁর প্রথম কাব্য উৎসর্গ করেন এভাবে :
আমার মা
আমার মাতৃভূমির মতোই অসহায়
মাতৃভূমিকে নারী ভাবা হয় সবসময় এবং অন্য আগ্রাসী পুরুষ হয়ে তাকে হরণ করে, পরাজিত করে। ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের জন্ম হয় তার সাথেও এই ঘটনাই ঘটে। তাই আবুল হাসান নারীর মতো পরজিত, নত স্বরে লেখেন তার প্রতিবাদ। কবিতার শেষ ছত্রদ্বয় আর সেই রমণীটি মহিলা ও যুবতীতে পুনরায় পর্যবসিত হতে হতে পুনরায় তারা ফের ঘৃণা ও ঘুমের মধ্যে হয় অন্তর্হিত! নারীর নিজেকে নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়ার এই লজ্জা ধারণ করেন আবুল হাসান। সেই নিঃসঙ্গতা কবিতার মতো একটি পুরুষ তাকে বলুক রমনীতে যে আকুলতা প্রকাশ পায় তার বেদনা। কুণ্ঠা, লজ্জা, বিদ্বেষে নয় নারীর সকল সত্তা প্রকাশিত হোক সগর্বে। পুরুষের সাথে তার সম্পর্ক হবে মিলনে, প্রেমে, শ্রদ্ধায়-এটুকুর বোধই নারীকে এই জড়তা থেকে মুক্তি দিতে পারে। আবুল হাসানের এই কবিতার ভাষা তাই জাগ্রত হয় নারীর জন্যে, নারীর পক্ষে।
সহায়কগ্রন্থ
আবুল হাসান, রচনাসমগ্র; ১৯৯৪, বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা
Mittalsouthasianinstitute.havard.edu. visited on 25.5.2018 : 10 : 10