
আন্তর্জালিক ধোঁয়াশে জীবন
খুব গোপনে
বৃষ্টি আঁকি বৃষ্টি মাখি এই নয়নে
নদীর জলে ভাসাই এ মন সন্তরণে
আমার সাথে বিষণ্ণ সব ফুল-কাননে,
বিরহী মেঘ ভিজতে থাকে
খুব গোপনে…
খুব গোপনে ।
ঝির ঝির ঝির অশ্রুধারা,
হই একাকার
বালুচরে ফেরারি প্রেম, মন পারাবার।
মেঘবতী-মন পুড়েছে
এই শ্রাবণে।
প্রেম-পুরাণের রূপকথারা
ধায় স্বপনে…
খুব গোপনে।
উড়ে যাওয়া সুখগুলি মোর নীল গগনে
গ্রহের মত ওই যে জ্বলে তারার বনে
আমি যে তার পাই না দেখা ঘোর গহনে
বৃষ্টি-শেষে পেখম পোড়ায়
প্রেম দহনে…
খুব গোপনে।
আন্তর্জালিক ধোঁয়াশে জীবন
আন্তর্জালিক প্রেম— অনেকটা উড়াল সেতুর মত,
আচ্ছন্নতার কমলা রোদ ছুঁয়ে যাবার আগেই মিলিয়ে যায়,
তবুও কোথাও যেন একছিটে মেঘ-মল্লার রেশ,
মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে বেড়ায় কোন প্রোফাইল পিকচারে,
ইন-বক্সে সহস্র স্বপ্ন আর প্রেমের ধুম্রজাল
ধোঁয়াশে এক হিসেবনিকেশ কড়া নাড়ে বিক্ষুব্ধ বাতিঘরে।
বিশ্ব কোয়ারেন্টাইন
বাক্সবন্দী বাঁচার লড়াই শেষ হলে
আমিও একদিন আগুনপোড়া রোদ ছোঁব,
তুমি অপেক্ষায় থেক অমলকান্তি।
আজ নিশ্বাসও পৃথক হতে চায় বাতাস থেকে—
শ্বাসনালীতে কখন দুমড়ে মুচড়ে ঢুকবে পিশাচ
মৃত্যুবীণা বাজিয়ে চলেছে মন,
ধাবমান মেঘে সাঁতার কাটে শবের পরে শব
আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তায় কম্পিত মানচিত্র
হাতের মুঠোয় বিষাক্ত স্পর্শ,
পাতাদের মর্মরে নিস্তব্ধতার হাহাকার
নিঃসঙ্গ ঘরের জানলায় দাড়িয়ে দেখি—
দূরে জাম আর জামরুলের পাতায়
হাসি মাখা মিষ্টি একফালি লাজুক রোদ,
অমলকান্তি,
কোন এক নির্জলা দুপুরে
আমি একফালি লাজুক রোদ ছোঁব।
আতঙ্কিত খবরে ভারী ইনবক্স
স্ক্রল করে করেও খুঁজে পাই না জীবন
অনির্দিষ্ট লকডাউনের রোজনামচা
নিঃসীমের দিকে জমা হতে থাকে কষ্ট,
একা একা ভাঙাচোরার খেলা,
হিসেবি ডাল-ভাত,
অথচ কালবোশেখির তাণ্ডব উপেক্ষা করেও
খড়কুটো মুখে নিয়ে ফিরছে পাখিরা,
আমরাও আবার অফিস শেষে ঘরে ফিরব
খোলা প্রান্তরে ছুটে যাব ছুটির দিনে,
আহ! কতদিন নরম রোদে গা ভেজাই না!
নিস্পন্দন সময় কেটে গেলে
হলদে সোনারোদ সকালের জন্য
আমৃত্যু অপেক্ষা কর অমলকান্তি।
কারফিউর নিকষ অন্ধকারে
হঠাৎ যৌবন হারিয়ে ফেলা শহরটি
যন্ত্রণার স্রোতে আজ বড্ড বেশী এলোমেলো
স্বপ্ন রোমন্থন করে,
নিয়ন বাতির মায়া অনেক দূর অবধি চলে গেছে
গলিতে গলিতে নেমেছে সন্ত্রাস
আতঙ্কিত অস্পষ্ট গোঙানি,
অন্ধকার ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে এস অমলাকান্তি
তোমার চোখ আগুনে লাল
তুমি রোদ হও, তুমি রোদ হও—
বিশ্ব কোয়ারেন্টাইন কেটে গেলে
আমি একদিন দু’হাত ভরে আগুনরঙা রোদ ছোঁব।
জীবনের বলয়ে আরেক জীবন
কিছুটা দূরের কার্নিশ ঘেঁষে নামে হলদেটে একাকী বিকেল
এমন বিকেলে ফেরে না কেউ,
হয়ত না ফেরার জন্যই বিকেলগুলো বড্ড একা,
থামের আড়ালে নীলচে-লাল সন্ধ্যে আলো বিষণ্ণ ছায়া হয়ে স্পর্শ করে
শহরের কোলাহলে নেমে আসে ডানাকাটা নীরবতা
মেট্রো শহরে সে নীরবতা আর্তনাদ হয়ে ফিরে ফিরে আসে।
দু-কামরার একাকীত্ব আসলে ভুতুড়ে প্রাসাদ,
নিস্তব্ধতায় কান পাতি—
আনন্দ-উল্লাসে, গানে, হাসিতে,
বীভৎস আর্তনাদ,
প্রতিমুহূর্তেই রঙ বদলান সাবলীল অভিনয়।
তামাটে এই শহরে—
জীবন আজ রূপান্তরিত কৃত্রিম বলয়
জীবন থেকে দূরে থাকা আরেক জীবন…
সে রাত
সে রাতে চন্দ্রমল্লিকায় কোন গন্ধ ছিল না
যেন লাশ কাটা ঘরে সাদা চাদরে মোড়া নিস্তব্ধতা
জোছনার কাফনে ঢাকা চাঁদ—
লোকালয়ে লোকালয়ে লোবানের মহোৎসব
মৃত ফুলেদের সাথে ছিল ফুলশয্যা।
সে রাতে বৃষ্টির উচ্ছ্বাসে ছিল প্রিয় গান
পেখম ছড়ানো অতীত
মেথির মাদকতায় আতরের ঘ্রাণ
করতলে মেহেদীর ঘা
হাজারো ফাটল ধরা জীবন-সিঁড়ি।
সে রাতে আদিগন্ত চোখে ছিল নোনা গন্ধ
জলে ভিজে স্বপ্নেরা চুড়াচুড়
আগুনে লেলিহান দেহমন
স্মৃতি পারাপার নদী ভাটার টানে
বয়ে চলে প্রতিমা বিসর্জনে।
সে রাতে চাঁদ ছিল, ফুল ছিল
স্বপ্ন ছিল, অশ্রু ছিল
বৃষ্টি ছিল, আগুন ছিল
লাল বেনারসির কফিনে ছিল নিথর দেহ।
নেশাতুর রাত
আবার ফিরে এলো নেশাতুর রাত, আকাশে নিকনো জমাট জ্যোৎস্নার ভিড়ে একফালি রক্তাক্ত ঠোট, ছায়াপথের ক্যানভাসে শৈশব-কৈশোর-যৌবন, বিশেষ মুহূর্তরা ফিরে আসে রামধনু হয়ে, এলোমেলো তুলির আঁচড়ে অস্পষ্ট কিছু ভেসে উঠবার প্রয়াস।
নিঃসঙ্গ রাত্রিযাপন একান্তে নিয়ে যায় কোন পরিত্যক্ত পূর্ণিমায়, জোছনাভেজা মেঘেরা যেদিন আনমনে ব্যাকুল হয়েছিল, তাঁদের সাথে পাল তুলে দিয়ে আকুল হয়েছিলাম আমি নিজেও। অপেক্ষায় ছিলাম কোন ঘোর কালবৈশাখীর—ভয়াবহ বাতাসের তাণ্ডবে, বিজলী-বজ্রের শীৎকারে, প্রচণ্ড ভালোবাসার আবর্তে, ভেঙ্গে-মুচড়ে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দের অপেক্ষায় ছিলাম।
অনন্ত আকাশ জুড়ে হিমেল হাওয়ায় কিছু ধুলোমাখা সুখ, খরতপ্ত এই হৃদয় অপেক্ষায় আছে এক জীবনঘাতী কালবৈশাখীর।