
আন্তন চেকভের গল্প আয়না : সমাজ-বাস্তবতা থেকে ঠিকরে আসা আলো
আন্তন চেকভ ১৮৬০ সালে ২৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন দক্ষিণ রাশিয়ার তাগানরোগে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯০৪ সালের ১৫ জুলাই। পিতামহ ছিলেন ভূমিদাস যিনি তার মুক্তি ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন আর পিতা ছিলেন একজন মুদি দোকানদার। চেকভ পড়ালেখা করে চিকিৎসক হন। লেখা ছিল তার নেশা ও পেশা, দুইই। পড়ালেখার খরচ চালাতেই লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেছেন কয়েক শো গল্প যার অনেকগুলোই কালজয়ী।
আন্তন চেকভের বিখ্যাত গল্পের তালিকা স্বাভাবিকভাবেই বড়। নাটকেরও। তার গল্পও অকৃত্রিম নাটকীয়তায় ভরা। এগুলো কেবল তৎকালীন রাশিয়ার সমাজ ও জীবনকে প্রতিফলিত করেছে তাই নয়, বৃহত্তর জীবন ও জগতের ছবি এঁকেছে, বহুকালব্যাপী যা মানুষকে আলোড়িত করবে। দা লুকিং গ্লাস গল্পটি আলোচনার কারণ এর একটি সাম্প্রতিক বাংলা অনুবাদ আমার হাতে আসে ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে এর একটি ঘরোয়াধর্মী বিশ্লেষণ হয়। যা আমাকে বর্তমান আলোচনাটি লিখতে প্রবৃত্ত করেছে। প্রথমে গল্পটি সংক্ষেপে বলে নেয়া যাক।
এক ভূস্বামীর অবিবাহিত কন্যা নেলী। সারাক্ষণ দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে। একদিন হাতে ধরা আয়নার ভিতর তাকিয়ে সে ডুবে যায় কল্পনার অতলান্ত সাগরে। কল্পনায় দেখা মেলে তার স্বপ্নের পুরুষের। মিষ্টি স্বপ্ন ছায়াছবির মতো এগিয়ে চলে। তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে ও বিয়ে করে। সংসারে সে সঁপে দিলো জীবনের সব। হঠাৎ বহুদিন পর এক কনকনে শীতের রাতে নেলী নিজেকে আবিষ্কার করলো সিভিল সার্জন স্টিফেন লুকিচের দরজায়। ডাক্তারের বাড়ি যেতে হয়েছিলো কারণ পরম প্রিয় স্বামী ভয়ানক জ্বরে আক্রান্ত। ডাক্তারও দিনরাত টাইফাসে আক্রান্ত রোগী দেখে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি কিছুতেই এত রাতে আর তিরিশ মাইল অতিক্রম করে নেলীর স্বামীর চিকিৎসা করতে যেতে পারবেন না। তিনি নেলীকে অনুরোধ করেন জেমস্তভো ডাক্তারের কাছে যেতে, যা আরো কুড়ি মাইল দূরে। নেলীর জন্য এখন যা অসম্ভব। সে সকল কিছুর বিনিময়ে লুকিচকে নিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞা করেছে। কারণ স্বামীই তার জীবন। সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে সে শেষ অবলম্বন হিসেবে ডাক্তারের দায়িত্ববোধ নিয়ে তার বিবেকের কাছে প্রশ্ন তোলে। বাধ্য হয়ে ডাক্তার লুকিচ রওনা দেন নেলীর সঙ্গে। ভোরে নেলীর বাড়িতে এসে ডাক্তার লুকিচ রোগীকে দেখার আগেই আবার ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়েন। নেলী আতঙ্কিত হয়ে দেখে ডাক্তার লুকিচ প্রলাপ বকছেন। কারণ তিনি অত্যধিক ক্লান্ত আর নিজেও নেলীর স্বামীর মতোই অসুস্থ। অগত্যা নেলীকে আবার ছুটতে হয় জেমস্তভো ডাক্তারের বাড়ি। কারণ প্রাণপ্রিয় স্বামীকে তার বাঁচাতেই হবে। এসময় নেলীর মনে পড়ে তার সংসার-জীবনের ইতিহাস। যা অনেক অভাব-দুঃখ-দুর্দশার হয়েও নেলীর কাছে স্বর্গীয় আনন্দ-সুখের উৎস। ঠিক তখনই নেলীর হাত থেকে আয়নাটি মেঝেয় পড়ে ভেঙে যায়। আর সামনে টেবিলে রাখা আরেকটি আয়নায় নেলী নিজেকে দেখতে পায়। যে নেলী কল্পনায় নয়, বসে আছে বাস্তবের জমিনে।
প্রায় দেড়শো বছর আগের লেখা এ গল্প যেমন সেদিনের তেমনি আজকেরও সমাজ, জীবন ও মনের ছবি ধারণ করছে। গল্পটিতে আঁকা হয়েছে একদিকে কল্পনার ফেনিল অগাধ জলরাশি, অন্যদিকে বাস্তবের কঠিন পাড় ও মাঝখানে স্বপ্ন ও বাস্তবের চিরভঙ্গুর মিলনরেখা। কল্পনা ও বাস্তবের দুই পাড়েই নেলীর নিয়ত গোপন সহজ আনাগোনা, বলা যায় ভেসে বেড়ানো। আসলে সবাই তো এমনই ভেসে বেড়ায়। তবে একেকজনের কল্পনাসমুদ্র ও বাস্তবক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়।
নেলীর ওভাবে কল্পনায় স্বপ্নের পুরুষকে পাওয়া ও ঐ অসহনীয় কষ্টের সমুদ্রে অবগাহনের কারণ কী। সে তো ভূস্বামীর মেয়ে। তার সুখের কল্পনা এমন ব্যতিক্রমী জীবনের হলো কেন? সামন্তবাদী একটি রক্ষণশীল সমাজে অবিবাহিত একটি মেয়ে এভাবে দিবাস্বপ্নে ডুবে যাওয়া ছাড়া তার মনের মানুষকে পেতে পারে না। এ চিত্র এখনও পৃথিবীর দেশে দেশে বিদ্যমান। নেলীর ভূস্বামী পরিবারের জীবন যে তাকে সুখী করে না, তা এ গল্পে স্পষ্ট। ভিতরে ভিতরে নেলীও গোপনে এই নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। সে ভালবাসতে চায় ও নিজেকে নিবেদন করতে চায় প্রেমসুখের কাছে। যে সুখ স্বার্থপরতায় পরিতৃপ্ত হয় না, বরং ত্যাগে মহীয়ান হতে চায়। নেলী মানুষ হিসেবে পূর্ণতা চায়।
সামন্তবাদী একটি রক্ষণশীল সমাজে নারীর নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মুল্য নেই। তার বলার মতো কোনো সাফল্য থাকে না। কিন্তু মনে মনে সেও গর্ব করার মতো কোনো সাফল্য লাভ করতে চায়। নেলী অসুস্থ স্বামীকে বাঁচাতে জীবনের সবকিছু পণ করেছে। যেকোনো ত্যাগ ও দুঃখকষ্টই এখন তার কাছে তুচ্ছ। জীবনের মানে সে খুঁজে পেয়েছে ধনসম্পদ আহরণের মাঝে নয়, ধনসম্পদ ত্যাগের বিনিময়ে তার ভালবাসাকে বাঁচানোর চেষ্টায়। যদি সে তা পারে তবেই সে নিজেকে সার্থক মনে করবে। তা না হলে সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন।
একজন চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব ও সামাজিক কর্তব্যও এ গল্পে ফুটে উঠেছে। ডাক্তার লুকিচ নিজে অসুস্থ হয়েও শেষ পর্যন্ত রোগীর আপনজনকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি। তিনি অন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে চেষ্টা করেছেন নেলীকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু নেলী যখন তার নৈতিক দায়িত্বের প্রশ্ন তুলেছে তখন না যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আজকের সমাজে আমরা উল্টোচিত্র দেখছি। এখন আর ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বিশ-তিরিশ মাইল দূরে ডাক্তার ডাকতে যেতে হয় না। আশপাশেই অনেক চিকিৎসক। একটি ফোনই যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবে তারা বিশ-তিরিশ মাইল নয়, বিশ-তিরিশ লক্ষ মাইল দূরে লুকিয়ে থাকেন। কোনো আবেদন-নিবেদনই তাদের বিবেককে নাড়া দেয় না। অত দূর থেকে আজকাল ডাক্তারের নাকে কেবল টাকার গন্ধ ছাড়া কিছু পৌঁছাতে পারে না। আজকালকার নেলী স্বামীকে ডাক্তার দেখানোর স্বপ্নটা কিছুতেই এভাবে দেখতে পারবে না।
এ গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে পাশাপাশি ঘনিষ্ঠভাবে বহমান দুটি জগৎ—কল্পনার ও বাস্তবের। শুধু একটি ছোট্ট আয়না দেয়াল হয়ে তাকে আলাদা করে রেখেছে। হাতে ধরা আয়নার সামনে বসে নেলী মানুষকে দাসে পরিণত করা এ নির্যাতনমূলক নৃশংস জগৎ থেকে ছুটি নিয়ে চলে যায় স্বর্গীয় কল্পনার জগতে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টেকে না। আয়নাটি হাত থেকে পড়ে যাওয়া মাত্র তাকে শোষণ ও স্বার্থপরতার রূঢ় বাস্তবে ফিরে আসতে হয়। স্বপ্ন-কল্পনার ভুবন পায়ের কাছে পড়ে থাকে। সে তার মুখ দেখতে পায় টেবিলে রাখা আয়নায়, বাস্তবে।
নেলী মানুষকে ভালবাসতে চায় শ্রেণীস্বার্থের টান উপেক্ষা করে। ভূস্বামী পরিবারের সুখশান্তির জীবন তার কাছে একঘেঁয়ে হয়ে পড়েছে। তাই সে ভিন্ন জীবনে অবগাহন করে সুখদুঃখময় জীবনের প্রকৃত স্বাদ পেতে চায়। সে তার প্রেমকে অনেক উঁচুতে স্থান দেয়। প্রেমের উচ্চতার প্রমাণ হিসেবেই নেলী চরম দুঃখকষ্টকে বরণ করতে প্রস্তুত। কল্পনার জগতে তার এ ইচ্ছে সে পূরণ করে। অচিরেই তাকেও এ শোষণের ঘূর্নাবর্তে পড়ে হয় শিকার না হয় শিকারিতে পরিণত হতে হবে। প্রচলিত জীবনের বাস্তবতায় কারো জন্য অন্য পথ খোলা নেই। এই বাস্তবকে অস্বীকারের চেষ্টায় তার এ প্রেমের কল্পনা।
নেলীও হয়তো শেষ পর্যন্ত তার শ্রেণীতেই অধিষ্ঠিত হবে বা হয়েছিলো। আয়নায় দেখেছে সে তার মানবিকতার উদ্ভাস। মানুষের কল্পরাজ্যে এই ইচ্ছেঘুড়ি উড়িয়ে দেয়াই শিল্পীর কাজ। শিল্পী বাস্তবকে পরিবর্তন করেন না, পরিবর্তনের জন্য মানুষকে আহ্বান করেন আর তার মনে অমোঘ পরিবর্তনের অমোচনীয় ছবি এঁকে দেন। নিবর্তনমূলক নিজ শ্রেণীর কাছে আত্মসমর্পণের পূর্বে নেলী তার প্রকৃত মানবিক সত্তাকে দেখতে পেয়েছে ধ্যানমগ্ন কল্পনায়। যে নৃশংস বাস্তব জগৎকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে আয়না পড়ে পাঠকও সে সম্পর্কে সচেতন ও তৈরি হয়, গভীর অবচেতনে।