
আত্মপরিচয়ের সন্ধানে এক পরিব্রাজক কবি ডেরেক ওয়ালকট
সাহিত্যের কোন সীমানা নেই। সাহিত্য আঞ্চলিক বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা হলেও সময়ের বিচারে যা কখনো কখনো নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে সাত সমুদ্র অতিক্রম করে সব মানুষের কাছে নিজ নিয়মেই পৌঁছে যায়। তবে যেসব সাহিত্যে বঞ্চিত এবং পরাধীন মানুষের হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়, সেসব সাহিত্য অত্যাচারী ও দখলদারী প্রভুদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ঠিক সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আপন মানুষদের চিনে নেয়। উল্লেখ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, চিনুয়া এচিবি, ফ্রানসৎ ফানো, এডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়াম চমস্কি ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বলে সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেন। আর বর্তমান সময়ে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে টি. এস. এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ফিলিপ লারকিন, সিমাস হিনি, ডেরেক ওয়ালকট নিজেদের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বে নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি রক্ষার পাশাপাশি ধর্মের মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় নৈতিক অবক্ষয়কে ফিরিয়ে আনার আহবানের কারণে সবার কাছে আপন হয়ে ওঠেন। উল্লেখিত সবাই তথাকথিত মর্ডান বা আধুনিক বিশ্বে বসবাস করে মর্ডানিজমকে নগ্নভাবে আক্রমণ করেছেন। তবে ডেরেক ওয়ালকট অন্যদের চেয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন ধারায় সাহিত্যকে উপস্থাপন করে পাঠক হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
ডেরেক ওয়ালকট সম্পর্কে বলার আগে প্রাসঙ্গিক কারণে ডক্টর স্যামুয়েল জনসন বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাট্যসমূহ মূল্যায়ন করতে গিয়ে যে উক্তি করেন তা উল্লেখ করা যেতে পারে। ডক্টর জনসন বলেন কোন সৃজনশীল লেখক কিছু লিখলে বা মানব জাতির উন্নয়নে নিজেদের নিবেদন করলে লেখকের জীবদ্দশায় সমালোচকেরা কেবল সে লেখকের ব্যাক্তিগত ভুলত্রুটি এবং সাহিত্যের নেতিবাচক দিকসমূহ পাঠককূলের মাঝে নিবেদন করে। ফলে পাঠককূল সে সৃজনশীল লেখক সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা লাভ করে এবং পাঠকের প্রকৃত বার্তা পেতে বিলম্বিত হয়। তিনি আরও মনে করেন, অথচ সে সৃজনশীল লেখক মারা যাবার সাথে সাথে কান্নার রোল পড়ে যায় এবং তার সম্পর্কে এমনভাবে প্রশংসা করতে থাকে যেন তার জীবদ্দশায় তার চেয়ে আর কোন ভাল মানসিকতার লেখক ছিল না। এর ফলেও পাঠক প্রকৃত বার্তা পেতে ব্যর্থ হয়। ডেরেক ওয়ালকটের জীবদ্দশায় বর্হিবিশ্বে যাই ঘটুক বাংলাদেশে স্বল্প সংখ্যক পাঠক সচেতন ছিলেন। কিন্তু ১৭ মার্চ, ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর আলোচনা ও প্রশংসার বানে কোন কোন ক্ষেত্রে অযাচিত এবং ঐতিহাসিক ভুল আমাদের মাঝে এসে যায়।
প্রসঙ্গক্রমে একথা বলা যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটের জন্য ভালোভাবেই জানে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ মূলত বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া ক্যারিবীয়ান সাগরের বুকে জেগে ওঠা ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের সমষ্টি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অঞ্চলের ২৩৮ বর্গ কিলোমিটারের ছোট এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে বেষ্টিত প্রায় দুই লক্ষ জনবসতি সম্পন্ন স্বাধীন দেশে ২৩ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৯২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া ডেরেক ওয়ালকট। ডেরেক ওয়ালকট এবং তার যমজ ভাই রডারিক ওয়ালকট যখন মায়ের গর্ভে ছিলেন তখন তাদের বাবা মারা যান। ফলে বাবার স্মৃতি ধারন না করলেও চিত্রকর ও কবি বাবার রেখে যাওয়া কর্ম এবং স্কুল শিক্ষিকা মায়ের বাসায় নিয়মিত কবিতা আবৃতি দুই ভাইয়ের পাথেয় হিসাবে কাজ করে।
ডেরেক ওয়ালকট জীবনের শুরুতে চিত্রকর হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। এঁকেছেন অসংখ্য ছবি। তার ছবিতে কেবল ক্যারিবীয়ান দ্বীপ অঞ্চলের লড়াই-সংগ্রাম এবং মানুষের স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ সব ছবি কেবল শখের বসে বা বাল্য জীবনের স্মৃতি তাড়িত হয়ে এঁকেছেন বলা যাবে না। বরং সচেতনভাবে এ সব ছবির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ক্যরিবীয়ান অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-মূল্যবোধের পুনঃজাগরণ তুলে ধরেছেন। তিনি সমুদ্র নির্ভর জেলে এবং কৃষি কাজের ছবি এঁকে আত্মঅংহকার প্রকাশ করেছেন। যেখানে বিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শাসনামলে শিল্পনির্ভর কাজকে সম্মানের সাথে দেখা হলেও তা তিনি মেনে নেননি। এসব ছবিতে প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের যে আনন্দ আছে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। তার ছবিতে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ক্যারিবীয়ান অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্বিসহ অভিজ্ঞতা ঠাঁই পায়নি বললেই চলে। এর মূল কারণ হিসাবে বলা যায় ঔপনিবেশিক শাসনের কালো অধ্যায়ের আলোকপাত করে যন্ত্রণাকে বাড়াতে চাননি, তেমনি প্রকৃত ক্যারিবীয় চিত্র তুলে ধরে স্বাধীন স্বকীয় সেন্ট লুসিয়ার আত্মসম্মানবোধকে তিনি সবার সামনে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।
ওয়ালকট নিজের ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র সেন্ট লুসিয়ার ক্যাসট্রাউসের সেন্ট মেরিস কলেজে পড়াশোনা করেন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে ‘ঔপনিবেশিক উন্নয়ন ও কল্যাণ’ শীর্ষক বৃত্তি পেয়ে ক্যারিবীয়ান আরেক দ্বীপ রাষ্ট্র জ্যামাইকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য চলে যান। সেখানে এসেই নিজের আসল প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করেন ফরাসি, লাতিন এবং স্প্যানিশ ভাষা শিখার মাধ্যমে। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা যে পরিবারে নিয়মিত বিষয় ছিল সেখানে তিনিও শিল্প-সংস্কৃতির সব শাখায় বিচরণ করবেন এটি স্বাভাবিক। এর ধারাবাহিকতায় জ্যামাইকায় পড়াশোনার সময় সেখানে নাট্য থিয়েটার তৈরি করেন এবং তরুণদের নিয়ে নাট্য চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন, যার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের কাছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের মানুষকে দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে আত্মসম্মানী হতে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। সেখানে সফল হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি দেন এবং ১৯৮১ সাল থেকে সেখানে ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সের শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ২০০৯ সালে তিন বছরের জন্য আলবার্তো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ২০১০ সালে এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এটি ছিল তার পেশা জীবনের শেষ কর্মস্থল। বাকী জীবন তিনি নিজ শহরে সমুদ্রের গর্জনের মধ্যেই সময় পার করেন। তবে ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার শিক্ষক পদের প্রস্তাব পেয়েও স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য ভিন্ন। কেননা, এখানেও ঔপনিবেশিক থাবা এবং ষড়যন্ত্রের কারণে এই পদের প্রার্থী রুথ প্যাডেল সাংবাদিকদের প্ররোচিত করে সংবাদপত্রে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। ফলে নিজের সম্মান রক্ষায় তিনি আইনি লড়াইয়ের চেয়ে পদ ছেড়ে দেয়া ভালো মনে করলেন। এসময়ে আরেক ঔপনিবেশিক আয়ারল্যান্ডের আত্মসম্মানী কবি সিমাস হিনি তার পাশে অবস্থান করেন এবং তার চেষ্টাতেই এ সত্যটি বেরিয়ে আসে। তিনি এও প্রমাণ করেন অনেক সভ্য মুখোশ পড়া কতিপয় পশ্চিমা সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা হেন কাজে জড়িত ছিলেন যা তিনি সব রক্তচক্ষূকে অবজ্ঞা করে টেলিগ্রাফে এ সত্যটি প্রকাশ করেন। এ ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি ঔপনিবেশিক শাসনের নোংরা চেহারাকে আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে।
ডেরেক ওয়ালকট ইংরেজি ভাষায় কবিতা চর্চা করে সারা জীবন সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সমালোচকদের মোদ্দা কথা হলো ওয়ালকট ঔপনিবেশিক শাসন বিশেষ করে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সারা জীবন সোচ্চার হয়েও নিজ ভাষায় সাহিত্য রচনা না করে স্বদেশীয় জনগণের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য স্বদেশীয় বিষয়বস্তুকে কাব্যের মূল অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করেন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের উৎসাহ পাওয়া তার মূল উদ্দেশ্য। সমালোচকরা কেনিয়ার ওপনিবেশিক বিরোধী লেখক নওগি ওয়া থুইংগির ইংরেজ বিদ্বেষী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে ওয়ালকটকে হেয় করার চেষ্টা করে। নওগি ওয়া থুইংগি ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করেও ইংরেজদের লুকিয়ে থাকা ইচ্ছা আকাঙ্খাকে বুঝতে পেরে এবং ইংরেজি ভাষা যেভাবে ঔপনিবেশিত অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে তার প্রেক্ষাপটে তিনি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা ও সবধরনের কথোপকথন বন্ধ করে দেন। এ ক্ষেত্রে ডেরেক ওয়ালকটের যুক্তি বেশ স্বচ্ছ। তিনি প্রথমত বিশ্বাস করেন ইংরেজি ভাষা ইংরেজদের সম্পত্তি নয় কেননা এ ভাষার অধিকাংশ শব্দই বিভিন্ন ভাষা থেকে অধিগ্রহণ করে পূর্ণতা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত, ‘The English language is nobody’s special property. It is the property of the imagination; it is the property of the language itself.’ এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে তার অবস্থান। এর পাশাপাশি তিনি আরো বিশ্বাস করেন যেহেতু বর্তমান বিশ্বে নানা কারণে ইংরেজি ভাষা সবার বোধগম্য তাই সে ভাষায় সাহিত্য রচনা করে ইংরেজ তথা ঔপনিবেশের কলঙ্কময় চেহারাকে তোলে ধরাই শ্রেয়। তবে তার এমন আচরণের হেতু হিসেবে উত্তর-উপনিবেশিক সমালোচকেরা মনে করেন, ‘ভাষার অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে রক্তাক্ত সময়গুলোর অঙ্গীকার ও আলো। ভাষার ভিন্নতাই কোনো কবিকে স্বতন্ত্র করে তোলে। তবে মনে রাখতে হবে, ভাষাই কবিতা নয়।’ তবে এ প্রসঙ্গে উত্তর-উপনিবেশিক সমালোচকেরা আরও মনে করেন, ‘আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সে তার ভেতরের অমিত শক্তিকে জানতে চায় না। কবির ভেতরে কবির যে নিজস্ব ঈশ্বর বাস করে, তাকে জাগাতে না পারলে কবিতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। ভাষার আছে অলৌকিক গুণ। ভাষাই মন্ত্র, এই মন্ত্রই কবিকে সাহায্য করে বৃহত্তর পাঠকের হৃদয় জয় করতে। ভাষাই সর্বোপরি এক সৌন্দর্য-শৌধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবিতার অঙ্গে রেখে যায় চিরকালীন মৌলিক স্বাক্ষর। কবিতা যে উদ্দেশ্যেই লেখা হোক না কেন, তার সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা চলে না।’
ওয়ালকট ছোট বেলা থেকেই সাহিত্য চর্চা করতেন। স্কুলের গন্ডি না পেরুতেই তার প্রথম কবিতা ‘The Voice of St. Lucia’ প্রকাশ করেন এবং আঠারো বছর বয়সে 25 Poems নামে প্রথম কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন দুইশো ডলার ধার করে। মায়ের চেষ্টায় এ টাকা নিয়ে আরেক ক্যারিবীয়ন দ্বীপ রাষ্ট্র ত্রিনিদাদ থেকে প্রকাশ করেন কেননা সে সময়ে সেন্ট লুসিয়ায় কোন প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। বেশ সাহসিকতা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে বন্ধুদের ও পরিচিতদের কাছে গিয়ে নিজের বইটি বিক্রি করে ছাপানোর টাকা তুলে মাকে ফিরিয়ে দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন, যা দুটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, তিনি পরিচিতজনদের কবিতার মাধ্যমে প্রতারিত করেননি। দ্বিতীয়ত, পাঠককূলের কাছে স্বদেশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে এ কাব্যগ্রন্থটি বেশ ভূমিকা রাখে।
বহুপ্রতিভাধর ডেরেক ওয়ালকট চিত্রকর, নাট্যকর ও অভিনেতা হওয়ার পরও কেন কবি হলেন তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘Midsummer’ কবিতায়। এখানে তিনি বলেন,
‘Forty years gone, in my island childhood,
I felt that
the gift of poetry had made me one of the chosen,
that all experience was kindling to the fire of the Muse.’
তার এ ইচ্ছাটি তারই সমসাময়িক কবি ও বন্ধু সিমাস হিনির ‘Digging’ কবিতায় যেভাবে হিনি ঘোষণা করেন কেন তিনি পূর্ব পুরুষদের পেশাকে অনুসরণ না করে কবি হতে চেয়েছেন এবং টেড হিউজের ‘The Thought Fox’ কবিতায় একজন কবির কবি হয়ে ওঠার যে রহস্য প্রকাশ করেছেন তারই প্রতিধ্বনি বলেই মনে হয়।
ডেরেক ওয়ালকট সমসাময়িক বিভিন্ন কবির কবিতায় প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি নিজেই স্বীকার করে বলেন, ডব্লিউ এইচ অডেন, টি এস এলিয়ট, ডিলান টমাস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট লাওয়েল এবং এলিজাবেথ বিশপের লেখায় প্রভাবিত হয়েছেন। ওয়ালকটকে কেউ কেউ ট্রাডিশনালিস্ট, মর্ডানিস্ট বলেন। কিন্তু এগুলিকে ছাপিয়ে তিনি একজন ন্যাচারালিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্টিক, সুররিয়ালিস্টিক, ইমেজিস্টিক, হারমেটিক এবং কনফেশনাল। তার লেখার মধ্যে মেথোডিজম এবং স্পিরিচুয়ালিজমের বেশ প্রভাব রয়েছে।
ডেরেক ওয়ালকট জীবদ্দশায় চব্বিশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, 25 Poems, In a Green Night: Poems 1948—60, The Gulf and Other Poems, Another Life Midsummer, Omeros, White Egrets| In a Green Night: Poems 1948—60 কাব্যগ্রন্থটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হবার পরই তার কবি খ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের ভূদৃশ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তার সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর হিসাবে পাঠক হৃদয়ে ধরা পড়ে। এরপর যত কবিতাই তিনি লিখেন প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাধারণ মানুষের জীবন ও ভাষা এবং মূর্তমান হয়েছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ও উপকথা। একে একে প্রকাশিত ওয়ালকটের কবিতায় ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিচিত্র আত্মপরিচয়ের চমৎকার সম্ভাবনার সূত্রগুলো উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান, যেখানে একটি আতঙ্কের দিকও ফুটে ওঠে যে, একদিন হয়ত এই দ্বীপ সংস্কৃতিক ব্রিটিশ আধিপত্য এবং পর্যটকদের ঘনঘন আগমনে মলিন হয়ে যাবে। তার একটি বিখ্যাত কবিতা St. Lucia-য় তিনি ক্যারিবীয় অঞ্চলের ভাষা-উপভাষাগুলোর মর্ম বেশ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ধ্বংস প্রায় ক্যারিবীয় ভাষা-উপভাষাগুলোকে পুনঃরায় সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় পরিণত করার আহবান করে বলেন, “Come back to me/ my language/ Come back/ cacao/ grigri/ solitaire/ oiseau.” ঔপনিবেশিক সময়ের অন্যায়-অত্যাচার, অসংগতি এবং তা থেকে উদ্ভূত ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিরক্তি প্রকাশ করেন বিভিন্ন কবিতার মাধ্যমে। তিনি তার ‘The Schooner Flight’ কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি করে বলেন, ”I met history once, he aint recognize me/ a parchment Creole, with warts/ like an old sea bottle, crawling like a crab/ through the holes of shadow cast by the net…”
ওয়ালকট তার প্রবন্ধ সমূহেও নিজের দেশ ও জাতির জন্য ঔপনিবেশিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে হৃদয়ে যে যন্ত্রণা এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তার বর্ণনা দেন এভাবে, “What we were deprived of was also our privilege. There was a great joy in making a world that so far, up to then, had been undefined… My generation of West Indian writers has felt such a powerful elation at having the privilege of writing about places and people for the first time and, simultaneously, having behind them the tradition of knowing how well it can be done — by a Defoe, a Dickens, a Richardson.”
পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যিকরা সমসাময়িক সময়ের প্রেক্ষাপটকে চিত্রিত করার জন্য এবং অন্যায়-অত্যাচারকে দূর করার জন্য কোন অকুতোভয় সাহসী যোদ্ধার প্রয়োজন অনুভব করেন তখনই তারা প্রাচীন ক্লাসিক সাহিত্যের চরিত্র, বিষয়বস্তু বা পৌরণিক কাহিনীর নানা অনুষঙ্গ ব্যবহার করেন। ডেরেক ওয়ালকটও তাদের ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তিনি প্রাচীন ক্লাসিক সাহিত্যের ওডিসির ঘটনাপ্রবাহ এবং স্ট্রাকচার ব্যবহার করেও কোন তথাকথিত সাহসী যোদ্ধা বা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত চরিত্র ব্যবহার করেননি। বরং তিনি ক্যারিবীয়ান জেলে, বেশ্যা, মুচি, চামার, ভাঁড়, স্থানীয় আমজনতা ও তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে আলোকপাত করেছেন তার মহাকাব্য Omeros-এ। এখানে ওডিসিটির প্রধান চরিত্র একিলিস, হেলেন এবং হেক্টরের সমান্তরাল কোনো কোনো চরিত্র সৃষ্টি না করে সম্পূর্ণ বিপরীতে ক্যারিবীয়ান জেলে, বেশ্যা, মুচি, চামার, ভাঁড়, স্থানীয় আমজনতা ও তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে তথাকথিত পশ্চিমা বিশ্বের নিপীড়নমূলক সংস্কৃতির প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। সমালোকদের মতে, এ মহাকাব্যটি সারা বিশ্বে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ক্যারিবীয় আইডেন্টিটি বা আত্মপরিচয় সন্ধানে এবং এর প্রকৃত রূপ প্রকাশ করেছেন। তাই একে বলা যায় ‘ক্যারিবীয় অঞ্চলের ইতিহাসের মধ্যে পরিভ্রমণ, একধরণের তীর্থযাত্রা’। আর ওয়ালকট নিজেই এ মহাকাব্য সম্পর্কে বলেন, “কবিতার সর্বাাঙ্গ ঘিরে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পুনঃপুন অনুরণন যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চরিত্রগুলোর জীবন-গড়নে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। একিলিসের আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের ওপর ক্রীতদাসদের পাশবিক আক্রমণ, নেটিভ আমেরিকানদের ওপর ইউরোপীয়ানদের আক্রমণ, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ এবং বাতাস প্রবাহের দিকের দ্বীপগুলোতে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন. . . এইসব মৃত্যু ও দুর্ভোগের দৃশ্যাবলি একজন হোমারের বস্তুনিষ্ঠ সহানুভূতির আলোকে স্মরণ করেছেন।” আর মহাকাব্যের জন্যই তিনি ১৯৯২ সালে সাহিত্যের সবচেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সীমিত আকারে আধুনিক সাহিত্য পড়ানো হয়, সেখানে ওয়ালকটের বাচাইকৃত তিন চারটি কবিতা পড়ানো হয়। তার মধ্যে ‘ভালবাসার পর ভালবাসা’, ‘অন্য কেউ’, ‘নিজেকে অভিবাদন’, ‘ঝড়ের পরে’ ও ‘আফ্রিকার সুদূর পরাহত কান্না’ অন্যতম। আশার বিষয় হলো সম্প্রতি তার কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে, যার মাধ্যম্যে ওয়ালকট পাঠের সুচনা হয়েছে বলা যায়। তবে এদের মধ্যে ‘ভালবাসার পর ভালবাসা’ ও ‘আফ্রিকার সুদূর পরাহত কান্না’ কবিতা দু’টি পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন দখল করেছে এদের বিষয়বস্তুর কারনে।
‘ভালবাসার পর ভালবাসা’ কবিতায় ওয়ালকট দেখিয়েছেন কিভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো প্রেমের অভিনয় করে ধীরে ধীরে আমাদের সব দখল করে নেয়। অথচ তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে আমরা একসাথে গেয়ে উঠি, ‘তুমি আবারো ভালবাসবে/ সেই আগন্তুকে,/ আগন্তুক তোমারই ছদ্মবেশে।’ কিন্তু এমন বোকামী দেখে ওয়ালকট বেশ হতবাক। ফলে নানা রূপকের মাধ্যমে ঘুমন্ত জাতিকে জাগাতে না পেরে সরাসরি রাগান্বিত হয়ে ওঠেন এবং নির্দেশ দেন, ‘নামাও সব প্রেমপত্র তোমার ঐ/ বুকশেলফ থেকে! সরাও সব ছবি!/ তুলে ফেলো নিজের প্রতিবিম্ব/ আয়না থেকে!’
‘আফ্রিকার সুদূর পরাহত কান্না’ কবিতায় তিনি সরাসরি আঙুল দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের নির্মমতাকে তুলে ধারেন বেশ নাটকীয়ভাবে। শুরুতেই বক্তা বলেন, ‘একটা বাাস এলামেলো করে দেয় তামাটে পশুকে/ আফ্রিকার, কিকুয়া, মাছির মতো দ্রুত ধাবমান/ রক্তপ্রবাহের উপর ভেসে যায় তৃণভূমি।’ ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে আর্তচিৎকার করে বক্তা বলেন, ‘পরিসংখ্যান ন্যায্য করে আর জ্ঞানীরা আয়ত্ব করে/ এই বিক্ষিপ্ত ভূখণ্ডের ঔপনিবেশিক নীতি।’ বক্তার ক্রন্দন আরো তীব্র হতে থাকে যখন বক্তার কাছে শুনি, ‘বিছানায় ক্ষত-বিক্ষত শিশুটির কী মানে?/ অসভ্যের কাছে, ইহুদির মতো খরচ করে ফেলা?’ এভাবেই তিনি সভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পশ্চিমা বিশ্বের কালো মুখোশকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরেন এবং সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা জীবন সংগ্রামী মানুষের প্রকৃত পরিচয়ের সন্ধানে তিনি একজন সত্যিকারের পরিব্রাজক।