
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ : একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্মকথা
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখকদের একজন। ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের সময় জন্ম নেয়া এই কথাশিল্পী যখন বেড়ে উঠছেন তখন তাঁর সাথে বেড়ে উঠছে একটি দেশ। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত ১৯৪৭ এর তথাকথিত স্বাধীন পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান। যার রয়েছে হাজার বছরের পুরনো ও গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ, উর্বর ভূমি আর অনুর্বর মস্তিষ্কের জনমানুষ। ‘৪৭ এর দেশভাগের পর ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে নতুন নগরজীবনের সূত্রপাত তার অনেকটাই ইলিয়াস ছুঁয়েছেনে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। দেশের উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত অংশে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা তাঁর ঢাকাতেই। তাই নতুন নগরের গোড়াপত্তন বেশ ভালোভাবেই দেখার সুযোগ ঘটে। নগরের সাজসজ্জা, ব্যক্তিমানুষের ভেতর ও বাইরের সাজসজ্জা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুর রূপবদল খুব কাছ থেকে দেখেন তিনি। দেখেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের হাজার বছরের গোলামীর ইতিহাস মুছে বিশ্বের মানচিত্রে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণার দৃপ্ত অঙ্গীকার।
এই জনপদের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ ইলিয়াসের লেখায় ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত হয়ে। তাঁর দেখার ভঙ্গিটি ছিল স্বতন্ত্র। ভাবাবেগকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বাস্তবতার ভূমিতে তিনি তাঁর শিল্পের জগতটি নির্মাণ করেন। আমাদের আজকের আলোচ্য লেখা তাঁর ‘রেইনকোট’ গল্প। মোটামুটি বড় আকৃতির এই গল্পটি ১৯৯৫ সালে লেখা হয়। সরলরৈখিক আখ্যানের বিষয়বস্তু এমন :
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একদিনের কথা। কলেজের কেমিস্ট্রির লেখচারার নুরুল হুদা বৃষ্টিবিধৌত দিনটিতে বাড়িতে বেশ আয়েস করে থাকার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এই বাদলা দিনের সকালে কলেজের প্রিন্সিপ্যালের পিওন ইসহাক যে বাংলা ছেড়ে উর্দুতে কথা বলা ধরেছে জানায় ‘তলব কিয়া। আভি যানে হোগা।’ সাথে এটাও জানায় ‘কলেজের দেওয়াল ঘেঁষে কারা বোমা ফাটিয়ে গেছে গতরাতে।’ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আখ্যানে আর নুরুল হুদার মস্তিষ্কে। এই ডাক উপেক্ষা করার সাহস নেই নুরুল হুদার। বৃষ্টির মধ্যে বেরুবে দেখে স্ত্রী আসমা তার ছোটভাই মিন্টুর রেইনকোটটা পরে নিতে বলে। আখ্যানে মিন্টু ঢুকে পড়ে। যে কয়েকমাস আগে অর্থাৎ জুন মাসের ২৩ তারিখ বাড়ি ছেড়ে গেছে। ভীরু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার তার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে চায় না। আমরা বুঝে যাই মিন্টুর বর্তমান অবস্থান কোথায়। মিন্টু বোনের বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতো। তার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে ভেবে নুরুল হুদা চারবার বাড়ি বদলায়। যাতে তাদের কেউ সন্দেহ না করে। যুদ্ধের বিভীষিকার সময় এটাও এক চরম বাস্তবতা। নিজেকে বাঁচাতে এমনটা করেছে অনেকেই। আর এমন ভীরু মানুষদের মধ্যে থেকেই একটা শ্রেণি অসম সাহসিকতার নজির রেখেছে। একটা যুদ্ধ মানুষকে ভেতর এবং বাহির থেকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। যাহোক, মিন্টুর ফেলে যাওয়া রেইনকোট পরলে নুরুল হুদাকে অনেকটা মিন্টুর মতো দেখায়। তার আড়াই বছরের মেয়ে বলে,’আব্বু ছোটোমামা’ আর পাঁচ বছরের ছেলে বলে,’আব্বুকে ছোটোমামার মতো দেখাচ্ছে। আব্বু তা হলে মুক্তিবাহিনী।’ শুরুটা কিন্তু এভাবেই। এই রেইনকোট পরার পর থেকে নুরুল হুদার মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে থাকে। সে বাসস্টপেজে আসে কলেজ যাওয়ার জন্যে বাস ধরতে। পথে তার মনে হয়,’তাকে কি মিলিটারির মতো দেখাচ্ছে? পাঞ্জাব আর্টিলারি, না বালুচ রেজিমেন্ট, না কম্যান্ডো ফোর্স, নাকি প্যারা মিলিটারি, না মিলিটারি পুলিশ,—ওদের তো একেক গুষ্ঠির একেক নাম, একেক সুরত। তার রেইনকোটে তাকে কি নতুন কোন বাহিনীর লোক বলে মনে হচ্ছে? ‘তার মনে মিন্টুর সাহসী অভিযানের কল্পনা তৈরি হয়। বাসে ওঠা থেকে কলেজ পৌঁছানো অব্দি অনেকটা চেতনাপ্রবাহরীতির আদলে সে একটানা স্মৃতিতে ভাসতে থাকে। সেখানে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, উর্দুর শিক্ষক আকবর সাজিদ, জিওগ্রাফির শিক্ষক আবদুস সাত্তার, হিস্ট্রির আলী কবির, কর্নেল সাহেব, মিসক্রিয়েন্টরা উঁকি মারে। বাসে কয়েকটি ছিঁচকে চোর এবং পকেটমার উঠে এবং তাকে দেখে দ্রুত নেমে পড়ে। তার রেইনকোট বাস ভিজিয়ে দিলেও কেউ কিছু বলে না। সে অনুভব করতে থাকে একটা শক্তি। বাসে মিলিটারি উঠলে সে তাদের দিকে সরাসরি তাকায় তখন “মিলিটারির চোখা চোখ সরে যায় তার মুখ থেকে, নেমে পড়ে তার রেইনকোটের ওপর। মনে হয় রেইনকোটের পানির ফোঁটাগুলো লোকটা গুণে গুণে দেখছে। ভেতরের তাপে এইসব পানির ফোঁটা কি একটু লালচে দেখছে? পানির দেশে মানুষ মারতে এসে পানির ফোঁটা দেখে মিলিটারির এত থ মেরে যাবার কী হলো? লোকটা কি এগুলোতে রক্তের চিহ্ন দেখে? রেইনকোটের বৃষ্টির ফোঁটা গোণাগুনতি সেরে মিলিটারি হ্ঠাৎ বলে, ‘আগে বাঢ়ো।'”রেইনকোট তাকে নিজের প্রতি আস্থা এনে দেয় এবং তার মনে হয় ভেতর থেকে একটা উত্তাপ সে অনুভব করছে। এমনকি উর্দুর প্রফেসর আকবর সাজিদ যাকে সে ভয়ে এড়িয়ে চলে তার সাথেও কথা বলার ইচ্ছে জাগে। কলেজে এলে প্রিন্সিপ্যাল তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ‘জাঁদরেল টাইপের এক মিলিটারি পাণ্ডা’র সাথে। অতঃপর তাকে এবং জিওগ্রাফির আবদুস সাত্তার মৃধাকে চোখ বেঁধে জিপে তোলা হয়। মস্ত উঁচু একটা ঘরে তাদের আনা হলেও চোখ খুলে নুরুল হুদা সাত্তারকে আর দেখে না। তার সামনে চেয়ারে এক মিলিটারি বসে এবং ইংরেজিতে একই প্রশ্ন বারবার করে। বিষয়টা হলো ক’দিন আগে কলেজে ১০টি লোহার আলমারি কেনা হয়। যা দেখার দায়িত্ব ছিল নুরুল হুদার। কুলিরা ওগুলো নিয়ে আসে ঠেলাগাড়িতে। মিলিটারি বলে, ‘কুলিরা ছিল ছদ্মবেশী মিসক্রিয়েন্ট।’ তারা আজ ধরা পড়েছে এবং কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে নুরুল হুদাকে চেনে এটা বলেছে। নুরুল হুদা এতে ভয় পায় না বরং অবাক হয়। মনে পড়ে আলমারি সাজিয়ে রাখার সময় ঘোরতর বর্ষা নিয়ে সে কিছু একটা বললে কুলিটা বিড়বিড় করে বলে, ‘বর্ষাকালেই তো জুৎ।’ কথাটা সে দুবার বলেছিল। এর মানে নুরুল হুদা না বুঝলেও তার মনে পড়ে স্টাফ রুমে শোনা সেই কথাটা, ‘বাংলার বর্ষা তো শালারা জানে না। রাশিয়ার ছিল জেনারেল উইনটার, আমাদের জেনারেল মনসুন।’ এখন নুরুল হুদার মনে হয়, ‘ঐ ছদ্মবেশী ছেলেটা কি এই কথায় বুঝিয়েছিল? তার ওপর তাদের এত আস্থা?—উৎসাহে নুরুল হুদা এদিক-ওদিক তাকায়।’ মিলিটারির ঘুষি খেয়ে সে একটুও ভীত না হয়ে বলে তাদের আস্তানার খবর তার ভালোভাবেই জানা আছে। কিন্তু ঠিকানা বলে না যখন তখন তার ‘বেঁটেখাটো শরীরটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ছাদে-লাগানো একটা আংটার সঙ্গে। তার পাছায় চাবুকের বাড়ি পড়ে সপাৎ সপাৎ করে।’ এগুলোকে নুরুল হুদার নিছক উৎপাত মনে হয়। রেইনকোট খুলে রেখেছে ওরা ‘কিন্তু তার ওম তার শরীরে এখনো লেগেই রয়েছে। বৃষ্টির মতো চাবুকের বাড়ি পড়ে তার রেইনকোটের মতো চামড়ায় আর সে অবিরাম বলেই চলে, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তার জানা আছে।’ এদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে এই অনুভব তাকে এতটা সাহসী করে তুলে যে চাবুকের বাড়ির দিকে তার আর কোন মনোযোগ দেয়া হয়ে উঠে না। গল্প শেষ ।
একটা রেইনকোট এতটা শক্তিশালী কি করে হয়? হ্যাঁ, অবশ্যই প্রতিকায়িত এই উপস্থাপনা। রেইনকোটটি মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর। আর এই রেইনকোট তথা বর্ষাতি একটা আচ্ছাদন বিশেষ। নুরুল হুদার ভীরু, কাপুরুষজনোচিত আত্মকেন্দ্রিক মানসে এই মুক্তিযোদ্ধার আচ্ছাদনটি বিপুল পরিবর্তন আনে। এটি পরিধানের পর তার শিশুসন্তানেরা যেমন বলেছিল আব্বু ছোটোমামা হয়েছে মানে মুক্তিযোদ্ধা কার্যত ঠিক তাই হয়। ইলিয়াস কৌশলে দেখান এই পোশাকটি কি করে আদর্শের প্রতীক হয়ে যায়। যার সংস্পর্শ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে ভেতর থেকে। মনে শক্তি যোগায়। তাই তো নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অকুতোভয় নুরুল হুদা মিসক্রিয়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগকে স্বীকার করে উৎসাহের সাথে। তাঁদের তার প্রতি আস্থা দেখে সে অভিভূত হয়। এভাবে ইলিয়াস একজন ভীরু, আত্মকেন্দ্রিক মানুষকে একটু একটু করে পাল্টে যেতে দেখান আমাদের। হয়ে উঠতে দেখান প্রাণকে তুচ্ছ করা এক অনমনীয় স্বাধীনচেতা সাহসী দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে। একাত্তুরে ঠিক এভাবেই ঘরে ঘরে জন্ম নিয়েছিল সহজ সরলপ্রাণা, অস্ত্র চোখে না দেখা মুক্তিযোদ্ধা। শুধু দেশকে ভালবেসে একটা অন্যায় যুদ্ধে নিজেদের উৎসর্গ করে স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণ ছিনিয়ে এনেছিল হায়েনাদের কাছ থেকে। তাই প্রতিকায়িত নামকরণের গল্প ‘রেইনকোট’ একজন নুরুল হুদার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প নয় বরং লক্ষ লক্ষ অকুতোভয় বীরসেনানীর জন্মের আখ্যান এটি। মাহমুদুল হক(১৯৪১-২০০৮) এর ‘কালো মাফলার’ গল্পেও আমরা এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্মের উপাখ্যান পড়ি। মধ্যবিত্তের আত্মকেন্দ্রিকতা আর ভাবালুতা থেকে মনোয়ার বের হয়ে আসে । অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে ছোটভাই টুলটুল। যে কিনা যুদ্ধে গেছে। গল্পের শেষে দেখা যায় বাবার নিষেধ অমান্য করে মনোয়ার ঘর ছাড়ে। ‘সে জানে, মাঝরাত থেকে সেও টুলটুলের মতো জড়িয়ে পড়ে, এখন তার অনেক কাজ।’ আসলে মনোয়ার বা নুরুল হুদার এসব আকস্মিক কোন পরিবর্তন নয়। তাদের চেতনার গহিনে একটা লড়াই চলছিলই সর্বক্ষণ। পিছুটান কাটিয়ে বের হয়ে আসার একটা উপলক্ষ খুঁজছিল মন। রেইনকোট বা কালো মাফলার সেই উপলক্ষ। এভাবেও ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। অন্যদিকে ইলিয়াসের আরেকটি গল্প ‘অপঘাত’ এর সাথেও কিছুটা সাদৃশ্য মেলে ‘রেইনকোট’ এর। ‘অপঘাত’ গল্পে মোবারক ভয় পেতে পেতে একসময় তার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে নিয়ে গর্ববোধ করে আর এখানে নুরুল হুদা কুলিবেশী মুক্তিযোদ্ধা এবং শালা মিন্টুর জন্যে গর্ববোধ করে। সমালোচক জাফর আহমদ রাশেদ বলেন, “‘রেইনকোটে’র বিশেষত্ব এখানে যে, নুরুল হুদা নিজেই রূপান্তরিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধায়। ‘সমালোচক সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার রেইনকোটের সংস্পর্শে নুরুল হুদার এমন রুপান্তর ও মুক্তিযোদ্ধার মানসিকতা অর্জনে তাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করা যায়।’ এর সাথে সহমত পোষণ করে শেষ কথায় বলতে চাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ হয়ে উঠেছে চেতনাকে ঘা দিয়ে বোধ আর বোধির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধার জন্মকথার শৈল্পিক লেখ্যরূপ ।