
আকিম মহমদের গল্পের জগত
একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ নির্বাচিত ৯ গ্রন্থের আলোচনা প্রকাশ করা হল। গল্প ও কাব্যগ্রন্থ মিলিয়ে ৯টি গ্রন্থ নির্বাচন করেছি আমরা। উল্লেখ্য যে, এগুলো প্রতিকথার বাছাই এবং অভিরুচি।
গ্রন্থগুলো হল : কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম– কবীর রানা, চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ– তাপস বড়ুয়া, আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান– বিজয় আহমেদ, জীবগণিত– আনিফ রুবেদ, জীবন এখানে এমন– মারুফ ইসলাম, ধর্ম নিরপেক্ষ বসন্ত– অনার্য নাঈম, শেকলের নূপুর– হানিফ রাশেদীন, আমাজান লিলি– নাজনীন সাথী, ভিন্ন দিনের জীবনায়ন– আকিম মহমদ।
বই : ভিন্ন দিনের জীবনায়ন ॥ ধরন : গল্পগ্রন্থ ॥ লেখক : আকিম মহমদ
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০ ॥ প্রকাশনা : প্রতিকথা ॥ প্রচ্ছদ : মনসুর আলম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট গল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন- ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা/ছোট ছোট দুঃখ কথা/নিতান্ত সহজ সরল…’। আকিম মহমদের গল্পগুলো নিতান্ত সহজ সরল নয়। দুঃখ কথাগুলোও খুবই তীব্র ও অনেক ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর ঘটে বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি। তার প্রত্যেকটি গল্পের মধ্যে মানুষের জীবনের মধ্যে অনিবার্যভাবে রাজনীতি ঢুকে যায়। কখনো চরিত্রের মধ্যে, কখনো লেখকের নিজস্ব বয়ানে নতুন এক সমাজের স্বপ্ন দেখে মানুষ।
আকিম মহমদের তার ভিন্ন দিনের জীবনায়ন গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় বলছেন- ‘সৃষ্টিসমূহের মাঝে যেখানে জীবনের গুঞ্জরণ সেখানেই গল্পের উম্মেষ। মহাকালের স্রোত বিস্তীর্ণ পরিসরে ব্যাপক জীবনের প্রবাহে সন্মিলিত ধারায় আগামীর পথে ধাবমান। তারই ফাঁকে, বাঁকে বাঁকে জীবনের অংশ- ভগ্নাংশ, ক্ষুদ্রাংশ কিংবা অখণ্ড জীবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ইচ্ছায় অথবা অবহেলায়।- আর সেসবের ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো নিয়েই নির্মিত হয় গল্প।’
প্রতিটি গল্পকারই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তার গল্পকে নতুভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চান। গল্পকার আকিম মহমদও তার ভিন্ন দিনের জীবনায়ন গল্পগ্রন্থে গল্পের প্রচলিত ফর্মের বাইরে গিয়েও গল্প সাজিয়েছেন। কখনো কখনো ফর্ম ভেঙ্গেছেন, কখনো রক্ষা করেছেন। লাগসই কাহিনী নির্মাণের প্রচেষ্টা আছে এই লেখকের প্রতিটি গল্পে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুধু বুনন কাঠামো ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে বানান রীতিতেও এসেছে।
প্রথম গল্প ‘অ্যা ডিসকোর্স অব ডিটেনশন’ মূলত একজন বিপ্লবী নেতাকে কেন্দ্র করে। যিনি পেশায় ছিলেন অধ্যাপক। এখানে একজন দৃঢ়চেতা বিপ্লবীর চরিত্র একেছেন লেখক। বহু অত্যাচার-নির্যাতন, মানসিক নীপিড়নের পর একদিন এই বিপ্লবী নেতা অনুভব করেন তিনি মুক্ত হতে চলেছেন। লেখকের বর্ণনায়- ‘’আজ জনাব হায়দারের চোখ বাঁধা নেই, হাতের বাঁধনও ঢিলে। চারদিকে চেয়ে দেখেন তার দ্বিতীয় জন্মের দুনিয়া। ভাবতে থাকেন- স্বপথ থেকে পতন যতো গভীরেই হোক না কেনো, কর্মপন্থা যদি ঠিক থাকে, কঠিন মনোবল আর কঠোর শ্রম থাকে তাহলে আবারো সেই উচ্চতাকে অতিক্রম করা সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, উত্তরণের সেই অসম্ভব স্বপ্নকে অনুবাদের আগেই তিনি ঢুলে পড়েন গাড়ীর আসনে। আস্ত একটা ভূ-গোলক ঘুরতে থাকে তার মাথার ভেতরে-ঢাকা-কোলকাতা-করাচি, মস্কো-মদিনা-মন্ট্রিল, লক্ষ্মৌ-লন্ডন-লসএঞ্জেলস, ক্যানবেরা-কাঠমান্ডু-কলম্বো, অস্টিন-ওয়াশিংটন-ওয়ালস্ট্রিট; সারা দুনিয়ার মানুষ নেমে পড়েছে পৃথিবীর পথে পথে,-হাতছাড়া হয়ে যাওয়া দুনিয়ার দাবি নিয়ে-সড়ক-মহাসড়কে, স্ট্রিট-এ্যভিন্যুতে। নিউইয়র্ক শহরের মধ্য ম্যানহাটনে পুলিশ দাবড়িয়ে চলে সমবেত জনতাকে। তাদের মাঝখানে হালিম হায়দার আবিষ্কার করেন নিজেকে, উদ্ধত হাত উঁচিয়ে জোরালো গলায় ঘোষণা করতে থাকেন তিনি, ‘দুনিয়ার মোট সম্পদকে… মোট জনসংখ্যা দিয়ে … জনপ্রতি সম্পদ কতো…।’’ এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গল্পকার তার গল্পটিকে গোটা মানবজাতির মুক্তির স্বপ্নের সাথে, সমবন্টনে বাঁচার স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে দেন।
…“তারপর- তারওপর জনাব হায়দার, অধ্যাপক হায়দারের চেতনার চূর্ণগুলো নিরেট আঁধারের সূচালো গহ্বরের মাঝে হারিয়ে যায়। কড়া ব্রেকে দাঁড়িয়ে যায় গাড়ী, হালিম হায়দারের শরীর হেলে পড়ে গাড়ীর সিটের নিচে। তারপর প্রেসক্লাব বাঁয়ে ফেলে গাড়ী ছুটে চলে শাহবাগের দিকে, হাসপাতালে।” আসলে সেদিনই ছিল তার শেষ দিন। একজন স্বাপ্নিক মানুষকে দৈহিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। জীবনানন্দের কবিতার মত সেই স্বাপ্নিক মানুষ আর থাকে না, বেঁচে থাকে স্বপ্ন। গল্পের শেষ প্যারায় এসে আমরা বুঝতে পারি এটি নিছক গল্প বলার জন্য এই গল্প তৈরী হয়নি। আমরা জানতে পারি গল্পটি একটি বাস্তব ঘটনাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এমন নির্মম বাস্তবতা একটি দুটি নয়, অতীতে বহু ঘটেছে । বর্তমানে ঘটে চলেছে। এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম কখনো থেমে থাকবে না। অতীতে চলেছে, বর্তমানেও চলছে, ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত না একটি ন্যায়ভিত্তিক, সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়।
দ্বিতীয় গল্প ‘বেহুলার ভেলা ডুবায় লখিন্দরে’। এই গল্পটিতে প্রভাবশালী স্বামী কর্তৃক নির্যাতিতা এক নারী জরিনা ও তার বাবা জানালীর লড়াইয়ের গল্প। মানব মনস্তত্ত্বের জটিল চিন্তা ও অর্থনৈতিক কারণে নির্যাতিতা জরিনাই এক সময় মানসিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পিতা একাই আইনী লড়াই চালিয়ে যায়। মেয়ের অপমান ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জানালী এক সময় তার পাশে আর কাউকেই পায় না। এমনকি তার আইনজীবী পর্যন্ত তার কাছ দূরে সরে যায়। হয়ত জরিনার ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী স্বামীর হুমকিতে। ছোট দুই মেয়ের একটিকে আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি কৃর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বাধ্য হয়েই ছোট দুই মেয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। শহরে গার্মেন্টস এ কাজ নেয়। শেষ পর্যন্ত ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র মত দোটানায় জরিনা আত্মহত্যা করে। গ্রাম কিংবা শহরে শ্রমজীবী মানুষের যে পরিমাণ দূর্দশায় পতিত হতে পারে তার খানিকটা নির্দশন পাওয়া যায় এই গল্পে। জরিনার দাফন শেষে জানালীকেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিঃসঙ্গ যোদ্ধা জানালীও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গল্পের শেষটা এরকম-
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। বিকেলের অসহায় সূর্যও একসময় সমর্পিত হয় সন্ধ্যার কোলে। সারা দিনের গ্লানি নিয়ে সন্ধ্যাও মুখ লুকোয় রাতের গহ্বরে। সারা গ্রাম জুড়ে নেমে আসে রাতের নিকষ-কালো অন্ধকার। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে সে আঁধার ঠেলে একসময় সূর্যও ওঠে সকালে। কেবল জানালীকে দেখা যায় না আর কোথাও। ঘরে, উঠোনে, রাস্তায়, বাজারে- কোথাও না। একজন জানালীর অনুপস্থিতি কোথাও কারো কাছে মালুম হয় বলে মনে হয় না। কেবল জরিমনের মনোভাবটাই বুঝা যায়নি।
তৃতীয় গল্প ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’। এটিকে একটি গল্প, নাকি প্রতিবেদন, নাকি রাষ্ট্রের দন্ডমুন্ডের কর্তা এবং সিভিল সোসাইটির সদস্যদের কাল্পনিক গোলটেবিল বৈঠক বলব? লেখক নিরীক্ষা করেছেন এখানে। রাউন্ড টেবিল হোল্ডারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, একজন একটি বৃহৎ পাবলিক ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট প্রফেসর এবং বর্তমানে লিয়েনে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মাননীয় উপাচার্য। আরেকজন ব্যবসায়িক সমিতির সমন্বয়ক, সাবেক চেম্বার সভাপতি ও বেসরকারি উদ্যোক্তা। সাবেক সচিব, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য। একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, ডেনমার্ক ভিত্তিক বেসরকারী সংস্থার (এনজিও) পরিচালক এবং একজন সাবেক বিচারপতি, তদারকি সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা। আর সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, এক সময়কার তুখোর সম্পাদক এবং বর্তমানে একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানী লিমিটেডের মিডিয়া উইং-এর সেক্রেটারি জনাব….! আমরা এই ব্যক্তিদের পরিচয়পর্ব দেখেই বুঝতে পারি এরা কারা, কীভাবে কী করেন এবং এদের হাতেই আমাদের জীবন পেন্ডুলামের মত দুলছে। এদের হাতেই আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত। গল্পের শেষের দিকে কয়েকটি লাইনে গল্পকার লিখেন- “অবশেষে-এভাবে, কেবল এইভাবেই, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে থাকে, চলে থাকে।”
‘বয়ে যায় বুড়ীগঙ্গা সয়ে যায় সমাজ’ গল্পটিতে তিনটি শ্রমজীবী কিশোরের গল্প বলা হয়েছে। তিনজনেরই পৃথক পৃথক পরিবার ছিল। তিনজনেরই ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে। একসময় এই তিন কিশোর ঘটনাক্রমে এক হয়। বন্ধুত্ব হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আবারো তারা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একে অন্য থেকে হারিয়ে যায়। কেউ হারিয়ে যায় চিরতরে, জীবন থেকে। এখানে লেখক চমৎকার মুন্সিয়ানায় চরিত্রগুলো চিত্রন করেছেন। গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন শ্রমজীবী মানুষের ভয়ংকর সংগ্রামী জীবন। অনিশ্চিত জীবন। গল্পটি পাঠ করতে অনেক সময় অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এগিয়ে যেতে কষ্ট হতে পারে পাঠকের। অন্যান্য গল্পের মত এখানেও বাংলাদেশের তীব্র শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন লেখক।
‘ঊনমানুষ, নমানুষ, নিষিদ্ধ মানুষ’ গল্পে হিজড়াদের জীবনের নানা জটিলতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কর্তৃক একজন সোচ্চার, প্রতিবাদী হিজড়াকে হত্যার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। এই গল্পটিতে লেখক যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে লিখেছেন। এতে অনেক সময় পাঠকের সাবলিলভাবে পাঠে সমস্যা হতে পারে। এই গল্পে ভিন্নধর্মী শব্দ ও বাক্যবন্ধ নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন লেখক। তবে একটা বিষয়, লেখক যেমন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন নিজের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য, পাঠকও সাবলীল ভাষাশৈলীর মধ্য দিয়ে নিজেকে গল্পের গভীরে নিয়ে যেতে চান। অনেকক্ষেত্রে বিষয়ের গভীর দ্যুতনা বা তীব্রতার পরও ভাষাশৈলীর কারণে পাঠক পিছিয়ে যেতে পারেন। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে একটা লেখায় লেখক যেমন তার মননগত ও সৃষ্টির গভীরতা প্রকাশ করার প্রয়াস পান, তেমনি কখনো লেখককে পাঠকের কথাও বিবেচনায় রাখতে হয়।
‘বদ বেচনে বেড়ে উঠা বৃক্ষ’ গল্পটি মূলত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অবক্ষয়ের চিত্র এঁকেছেন লেখক। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিবরিয়ার পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং সমাজকে দেখার নানা বয়ান রয়েছে। গল্পের একস্থানে লেখখের বর্ণনা এরকম- “কোনো সমাজে মানি অ্যাক্যুমুলেট হয় অস্থির সময়ে, আর সে মানির সুষ্ঠু সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজন স্থির সমাজ। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, স্বাধীনতার পর থেকে সেনা শাসনের শেষ পর্যন্ত ছিলো চরম সামাজিক অস্থিরতা। অবশ্য তারপরও মানি অ্যাক্যুমুলেটেড হচ্ছে, হয় বিভিন্ন পথে, পন্থায়। তবে তার গতি কমেছে, বদলেছে তার প্রকৃতি। গতো শতোকের শেষ দশোকের আগ পর্যন্ত অস্থিরতার কারণে এসব সঞ্চিত অর্থ সঞ্চালিত হতে পারেনি, সমাজে। তাই সুযোগ বুঝে পাখা মেলেছে বাইরে…।” এই কথাগুলোর মধ্য থেকে বর্তমান বাংলাদেশের অস্থিরতার একটা চিত্র আমরা পাই। অর্থনীতি যে একটি রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি এবং সেই অর্থনীতির ভিত্তি যদি হয় লুটপাট করা টাকায় তাহলে ঐ সমাজ অস্থির ও দিকভ্রান্তহীন হতে বাধ্য। এমন সমাজ সর্বত্রই হয় সন্ত্রাস কবলিত। এই লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই সমাজের ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠাটাই স্বাভাবিক। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে তারই সত্যতা মেলে।
“পৃথিবীতে পাগলাগারোদে যতো পাগল, তার বাইরে বহু বহুগুণ বেশি। কেবল আজ নয়, অতীতেও; এবং ভবিষ্যতে এই হিসাব সংখ্যার সীমা ছেড়ে মানবকুলকে শঙ্কিত করে তুলবে বলে আমাদের মনে হয়।” সপ্তম ও শেষ গল্পের নাম হচ্ছে ‘পাগলাগারোদ! পাগলাগারোদ!! পাগলাগারোদ!!!’ এই গল্পের শুরুতেই পাগলা গারদের ভেতরের ও বাইরের পরিসংখ্যানটাও এভাবে জানিয়ে দিচ্ছে এই গল্পের চরিত্র দুটি চরিত্র, যারা বিষয়টি নিয়ে গবেষণারত। জাহিন জহুর ও মাহিন মুসা। তারা নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণারত থাকে মূলত মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষদের নিয়ে। এই গল্পটির মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের এই চেনা জগতের পাগলামো, চেনা জগতের মানুষের অসুস্থতা, মানসিক বিকারগ্রস্থতার কথা তুলে ধরেন। তাদের গবেষণার একটা জায়গায় এমন আছে-
“তারও অনেক পরে একটা প্রবন্ধ বেরোয় পত্রিকায়- লেখক অধ্যাপক নাজির উদ্দীন আহমেদ। মূলত এটা ছিলো অধ্যাপক আহমেদের ডায়রীর অংশ বিশেষ যা সেদিন তার বাসা থেকে জাহিন জহুর সংগ্রহ করেছিলো। প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ এই-আমাদের এই বাস্তব ভূগোলের দুনিয়া একটা হলেও প্রতিটা মানুষের মনোজগত বা মনোদুনিয়া আলাদা-ভিন্ন ভিন্ন এবং সকলের ভিন্ন ভিন্ন দুনিয়ার সুন্দরের সারাংশ দিয়েই এই বাস্তব দুনিয়ার সুখসৌন্দর্য নির্মিত। পৃথিবীতে যতো মানুষ-দুনিয়াও ততো। একজন মানুষের স্বাভাবিক চিন্তন প্রনালি ও প্রক্রিয়া যখন বিগড়িয়ে যায়, তখন বাস্তব দুনিয়ার সাথে সে তাল মেলাতে অপারগ হয়, এবং সকলে তাকে তখন মানসিক রোগি বা পাগল বলে। বাস্তব দুনিয়ার সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হলেও সে তার মনোদুনিয়ার জন্য শতোভাগ ফিট। এইভাবে বিগড়িয়ে যাওয়া মনের মানুষদের মনোজগতের সমষ্টি, আমাদের বাস্তব দুনিয়ার আপাত স্বাভাবিক মানুষদের মনোজগতের সমষ্টিকে ছাড়িয়ে গেলে- সেদিন তথাকথিত পাগলের দুনিয়াই স্বাভাবিক দুনিয়া; আর আপাত স্বাভাবিক দুনিয়া পাগলের দুনিয়াতে পরিণত হবে কিনা- এরকম একটা অতিদূর ও শ্রমকল্প সম্ভাবনাকে উস্কে দিয়ে প্রবন্ধের ইতি টেনেছে সে-লেখক-অধ্যাপক নাজির উদ্দীন আহমেদ।”
গল্পের এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির মধ্য দিয়েই আমাদের আলোচনার ইতি টানব। আমরা আকিম মহমদের গল্পপাঠে লক্ষ্য করি, তার গল্পে মানুষের ভিন্ন দিনের জীবনায়নের নানা কথা কথা ঘুরে ফিরে এসেছে। মানুষ ও সমাজের সম্পর্কের জটিলতা, কখনো কখনো বিভৎসতার চিত্র অতিক্রম একটি নতুন সমাজের কথাই এসেছে। প্রত্যেকটি গল্পেই বৈষম্যমূলক সমাজের করুণ ও ভয়ংকর চিত্র দেখতে পাই। প্রত্যেকটি গল্পেই একটি নতুন সমাজের স্বপ্ন প্রচ্ছন্নভাবে এসেছে। এই নতুন সমাজের জন্য জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে আকিম মহমদের চরিত্রগুলো নানাভাবে লড়াই করে যায়। পূর্বের কথার সূত্র ধরে বলব- আকিম মহমদের গল্পের বিষয়বস্তু দূর্দান্ত নিঃসন্দেহে কিন্তু ভাষাশৈলীগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে দু’একটি গল্পের গতি অনেকটা ধীর। পুনর্বার এই কথাটি বলতে হচ্ছে, বর্তমান এই গতির দুনিয়ায় পাঠকের পাঠ প্রবণতাকে কী লেখকের বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন নয়? সব মিলিয়ে বলব, আকিম মহমদের গল্পের ভেতরে একবার প্রবেশ করলে এর বিষয় ও বক্তব্য পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে এই সমাজের ভয়ংকর ও বিভৎসতা নিয়ে। নতুন এক সমাজের স্বপ্ন নিয়েও ভাবাবে। তবে তার গল্পের শেষে কিন্তু চিরায়ত সেই অনুভূতিই হয় “অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হইয়াও হইল না শেষ।”