
অমৃতা-ইমরোজ, অরূপ আলোর ঝলকানি ॥ পর্ব ১
এই গল্পের পাত্রপাত্রী চারজন:
– সাহির লুধিয়ানভি, ভারতীয় কবি ও গীতিকার। পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার, পদ্মশ্রী পুরস্কার। মারা যান ৫৯ বছর বয়সে। তাঁর জন্মের নব্বইতম বার্ষিকীতে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।
– অমৃতা সিং, অমৃতা প্রীতম নামে বেশি পরিচিত। “সুনেহর” নামের এক কবিতার জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর গল্প ‘পিঞ্জর’ হয়েছে সিনেমা। জ্ঞানপীঠ, পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। জীবনভর এক মূর্তিময়ী ব্যতিক্রম, সময়ের তুলনায় অগ্রগামী। সাহিত্যকীর্তির পাশে খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে নিজের মতো করে তাঁর সাহসী ব্যক্তিগত জীবনও আগ্রহোদ্দীপক। সাহিত্যজীবন নয়, আমাদের আলোচনা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।
– ইমরোজ ইন্দ্রজিৎ। চিত্রশিল্পী, কবি।
– রেনুকা নিদাগুন্ডি। লেখক, ইমরোজের প্রতি নিঃশব্দ অনুরক্ত।
সাহির লুধিয়ানভির সাথে অমৃতা প্রীতমের সম্পর্ক কী ছিল? কী ছিল ইমরোজের সাথে? বিয়ে করা বরের সাথেই বা কী সম্পর্ক ছিল অমৃতার? অথবা ইমরোজের সাথে রেনুকারই বা কী সম্পর্ক ছিল?
যুগে যুগে ভালোবাসার মানুষদের মধ্যে এমন কিছু সম্পর্ক হয় যা সংজ্ঞার সীমানায় বাঁধা যায় না। রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পো, ইসমত-মান্টো, নিবেদিতা-বিবেকানন্দ, আবুল হাসান-সুরাইয়া, সার্ত্রে-সিমন এইসব জুটির সাথে আজ কেবল অমৃতা-সাহিরই বলতে পারতাম। কিন্তু ইমরোজের প্রতিই যেন টান অনুভব করছি বেশি। আমাদের এই আলোচনায় তাই ঘুরে ফিরে অমৃতা আর ইমরোজের কথাই আসবে বেশি।
৩১ আগষ্ট ১৯১৯ অমৃতার জন্ম হয় পাঞ্জাবে (এখনকার পাকিস্তান অংশে)। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, বাবা কারতার সিং হিতকারি ছিলেন ব্রজ ভাষার কবি এবং শিখ ধর্মপ্রচারক। এগার বছর বয়সে তাঁর মা রাজ বিবি মারা গেলে বাবার সাথে অমৃতা লাহোর চলে যান। পার্টিশন পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। ১৬ বছর বয়সে দুটো ঘটনা ঘটে অমৃতার জীবনে। লাহোরের আনারকলি বাজারের হোসিয়ারি ব্যবসায়ী প্রীতম সিং এর সাথে বিয়ে হয় এবং তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ের অমৃত লেহরান (“Immortal Waves”) এর প্রকাশ পায়। এরপর আর তিনি থামেন নি। ১৯৪৩ এর মধ্যে তাঁর অন্তত ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
বিয়েতে অমৃতা সুখী ছিলেন না। ব্যবসায়ী স্বামী প্রীতমের সাথে বোধগম্য কারনেই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক দূরত্ব ছিল। অনুভূতির স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ছিল না দাম্পত্যে।
এই সময়ে ১৯৪৪ সালের লাহোরের কাছে প্রীতনগর নামে এক গ্রামে এক মুশায়রায় (কবিতা পাঠের আসর) দেখা হয় কবি গীতিকার সাহির লুধিআনভির সাথে। তারপর দুজনের পত্রালাপের কথামালায় তৈরি হয় এক অনিন্দ্য সুন্দর ‘সম্পর্ক’। ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় ২৮ বছরের অমৃতা, গর্ভের সন্তান-সহ, একজন পাঞ্জাব রিফিউজি হিসাবে চলে আসেন দিল্লীতে। লক্ষ নিরীহ মানুষের রক্তের দাগ তখনো শুকায়নি, ঘরছাড়া মানুষের হাহাকারে ভারি হয়ে আছে বাতাস, অমৃতা দেরাদুন থেকে দিল্লী যাচ্ছেন ট্রেনে, ভূবন জোড়া অনিশ্চয়তাকে সামনে নিয়ে অমৃতা হাতে তুলে নেন এক টুকরো কাগজ আর সমস্ত ক্ষোভ ও বেদনা দিয়ে রচনা করেন সেই কালজয়ী কবিতা ‘‘Ajj Aakhaan Waris Shah Nu” (I ask Waris Shah Today)। অনেকে বলেন, সারাজীবনে অমৃতা যা করেছেন, তার কিছুই যদি আগে পরে নাও করতেন, তবু এই কবিতা তাকে অমর করে রাখতো।
শিশুকাল থেকেই অমৃতা সাহসী, স্বাধীনচেতা আর প্রখর ছিলেন। দেশভাগ তাকে আরো শানিত করে তুললো। তিনি ক্রমে প্রথাভাংগা প্রতিবাদী ও একটিভিস্ট হয়ে উঠলেন। কিন্তু বহিরাবরণে শক্ত হলেও ঝিনুকের মত তাঁর অভ্যন্তরীন কোমলতা ক্রমশ প্রকাশিত হতে থাকলো সাহিরের সাথে প্রেমের বিষয়টা সামনে আসায়। অনেকে বলেন, তাঁদের প্রেম শুরু হয়েছিল সিনেমার মত করে। ‘দেখামাত্র প্রেম’ যাকে বলে। অমৃতার সৌন্দর্য আর মেধার সাথে তাঁর কথালেখা ও কথাবলার স্টাইল, বাক্যচয়ন, বলা আর শোনার মাঝের বিরতি, তাকানো। সাথে মিলেছিল সাহিরের মনোযোগ আর রোমান্টিসিজম। এই মিলন-বিরহের নিত্য দ্বন্দ্ব দোলা দুজনের প্রেমের মূল উপাদান ছিলো। দুজনের অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যে খুব বেশি কথা বলত তা নয়। তাঁদের প্রেমের প্রকাশ হত চিঠিতে, নৈঃশব্দে আর দুজনের লেখায়।
আকাঙ্ক্ষা আর বেদনার রসে সিক্ত তাঁদের এই প্রেমের গল্প ষাট আর সত্তুরের দশকের বুদ্ধি ও সংস্কৃতির জগতের পুরো প্রজন্মের আগ্রহের বিষয় ছিল। কারণ নানান দিক দিয়েই তা ছিল বৈচিত্রে আর সাহসে ভরপুর। অমৃতা আর সাহিরের ভালোবাসাতে মিশেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতা আর সৃজনশীলতা। অকুন্ঠ প্রশংসা করতেন একে অন্যের। অমৃতা আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমি ভেঙ্গেচুরে তোমাকে ভালোবেসেছি, তুমিও কি তেমন করেই ভালোবেসেছ আমাকে? (ম্যায়নে টুট কে প্যায়ার কিয়া তুম সে / ক্যায়া তুমনে ভী উতনা কিয়া মুঝ সে?)
কিন্তু সাহিরের অন্তর অমৃতার আবেগের গভীরতার মতো অতল ছিল না। বরং অমৃতার চিঠি, অদৃশ্য স্পর্শ, অধরা মাধুরীই হয়ত সাহিরের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল।
দেশভাগের পর সাহিরও চলে আসেন মুম্বাইয়ে। ক্রমে ভাটা পড়ে দুজনের সম্পর্ক। সাহিরের জীবনে অন্য নারী আসেন। অমৃতার সাথে পরিচয় হয় চিত্রশিল্পী ও কবি ইমরোজের। অমৃতার ব্যথিত প্রাণ শান্তি খুঁজে পায়। মৃত্যু অবধি জীবনের পরবর্তী চল্লিশটি বছর তিনি ইমরোজের সাথেই বাস করেন।
ইমরোজ জানতেন অমৃতার মনের মন্দিরে চিরকালের পুজা পেয়ে যাচ্ছেন সাহির। তথাপি ভালোবাসায় যত্নে শুশ্রুষায় আগলে রেখেছিলেন অমৃতাকে। অমৃতা-ইমরোজের একত্র জীবন নিয়ে উমা ত্রিলোকের লেখা Amrita Imroz : A Love Story বইয়ে আছে, লেখক ইমরোজকে প্রশ্ন করছেন, “Amrita lived with the memory of Sahir, did it bother you?” ইমরোজ জবাব দিচ্ছেন: “No. I accepted it. There is no hassle when one loves without ego, without argument, without making artificial arrangements, and without calculations.”
আসলে সাহিরের সাথে অপ্রাপ্তিই ছিল অমৃতার প্রাপ্তি। বয়সে অনেকটাই ছোট ইমরোজের সাথে থাকা সময়েও ভুলতে পারেনি সাহিরকে। আর ইমরোজ? ভালবাসার সব সীমার বাইরে এক অসীমতায় নিয়ে গিয়েছিল তার প্রেমকে। বাইকের পেছনে বসা অমৃতা ইমরোজের পিঠে নখের আঁচড় দিয়ে লিখে চলেছে … সাহির সাহির…. খেয়াল হতেই ইমরোজকে বলেছে, ‘ম্যায় সাহিরকে নাম লিখ রহি থি, তুমহে খারাব লগা, নহি? ইমরোজ বাইক চালাতে চালাতেই বলেছিল, ‘তুমহে লিখনে কি আদত হ্যায়, মুঝে সহনে কি….’ এ এক অদ্ভুত ত্রিকোণ !
না কি চতুষ্কোণী?
এইসব গল্প আমরা জানবো আগামী পর্ব গুলোতে।