
অমৃতা-ইমরোজ, অরূপ আলোর ঝলকানি ॥ পর্ব ২
সাহিরের সাথে অমৃতার দেখা হয়েছিল কবিতা পাঠের আসরে। তারপর কবিতার মতোই হয়ে উঠেছিল তাঁদের পথ আর গন্তব্য। তাঁদের প্রেম আর প্রেম ভাঙার গল্পও তাই তেমন কাব্যময়, বিশুদ্ধ ও কোমল।
সাহিরের ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’ ছিলো। ভয় পেতেন বন্ধনের। এছাড়া শৈশবে মায়ের সাফারিংস দেখেছেন। মায়ের প্রতি তাঁর একটা অদ্ভুত নির্ভরতা ছিল যাকে কেউ কেউ বলেছেন quasi-oedipal predilection বা ইডিপাস গূঢ়ৈষা।
সাহির দেখতেও ভালো ছিলেন না। মুখে ছিলো বসন্তের দাগ। মদ আর সিগারেট ছিলো নিত্যসঙ্গী। অন্যদিকে অমৃতা কমিটমেন্ট চেয়েছেন বটে, কিন্তু জেঁকে বসে দখল করতে চান নি সাহিরকে। প্রখর ব্যক্তিত্ব ছিলো, স্বাধীনতা ঝ’রে পড়তো তাঁর লেখায় চলায় বলায়। সিগারেট খেতেন প্রকাশ্যে। সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রগামী এই নারী ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী।
তাঁদের ভালোবাসা কেমন কোমল তা তাঁদের একান্ত আচরণেও ধরা পড়েছে বারবার। যেমন অমৃতা যে কাপে কফি খেয়েছেন সাহিরের বাড়িতে, সাহির তা না ধুয়ে রেখে দিয়েছেন। আবার সাহিরের ফেলে দেওয়া সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে যত্নে রেখেছেন অমৃতা। এক ইন্টারভিউয়ে অমৃতা বলেছেন, ”সাহির মেরে সার্ত্রে আউর ম্যায় উনকি সিমোন থি।”
এ কথা সত্যি যে, অমৃতা যতোটা ও যেভাবে চেয়েছেন সাহিরকে, সাহির ততোটা ও সেভাবে চান নি অমৃতাকে। দুজনেই স্যাপিওসেক্সুয়াল ছিলেন। ইগো ছিলো দুজনেরই। ফলে একদিন বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠল।
শেষ দেখায় অমৃতা নিজের লেখা একটা চিঠি দেন সাহিরকে। ফেরার সময় আবৃত্তি করেন বায়রন থেকে… “In her first passion, a woman loves her lover, in all the others all she loves is love.” বিদায়ের সময় সাহিরও কিছু কথা বলেন কবিতায়,
”তুম চলি যাওগি, পরছাইয়া রাহ যায়েঙ্গি
কুছ না কুছ ইশক কি রানাইয়ান রাহ যায়েঙ্গি।”
এই কবিতাটি পরে গান হিসাবে মোহাম্মদ রফির কন্ঠে ‘সগুন’ মুভিতে ব্যবহৃত হয়। সাহিরের অনুরোধে রফি ইশক এর জায়গায় হুসন শব্দটি গেয়েছিলেন।
সেইখানেই যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সময়। দৈনিক জং-এ অমৃতার প্রিয় বন্ধু ফাহমিদা রিয়াজ এঁর লেখা ”অমৃতা কি সাহির সে আখরি মুলাকাত” থেকে আমরা এসব জানতে পাই।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে একজন বিদগ্ধ স্রোতার মনে হয়ে, এ-ই ভালো। ঘনিষ্ঠতা যদি কোনদিন পরিণত হয় প্রাত্যহিক বিরক্তিতে, তবে তার সমাপ্তি দরকার। যদি কোনও সম্পর্ক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলাই ভালো। যে সম্পর্কে আর কোন মাধুর্য নেই, আবিষ্কারের নেশা নেই, নিরন্তর শ্রদ্ধা আর একের পর এক ভালোলাগার আবেশ নেই, যা পৌঁছায় না কোথাও, পৌঁছাতে পারে না, চায়ও না, কেবল গতিহীন যুক্তি তর্ক দায়িত্ব অনুশাসনের বৃত্তে আবদ্ধ সেই সম্পর্ককে কোন এক মনোরম মুহূর্তে এসে ছেড়ে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তত এইটুকু লাভ হয় যে, সোনার খাঁচায় অটুট রয়ে যায় জীবনের কিছু আশ্চর্য মুহুর্ত। কিছু স্মৃতির রুমাল আজীবন উড়তে থাকে হৃদয়ে।
সাহির লিখছেন, চলো আরেকবার আমরা নতুন করে পরিচিত হই। আবার নতুন করে শুরু করি। আর যদি তা না পারি, যদি আর গতি ও গন্তব্য না-ই থাকে, তাহলে এখানেই তার শেষ হোক।
Woh afsana jise anjam tak lana na ho mumkin
Use ek khoobsurat mod dekar chhodna achchha
ভারত পাকিস্তান ভাগ হলো। সাহির বোম্বে আর অমৃতা দিল্লী চলে এল। দুই সন্তান আর স্বামী নিয়ে অমৃতার দিল্লীর জীবন শুরু হলো রেডিওর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আর কবিতা লেখা দিয়ে।
একদিকে সাহিরের জীবনে এলো নতুন নারী। আর এদিকে এক সন্ধ্যায় অমৃতার পরিচয় হলো তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী তাঁর থেকে দশ বছরের ছোট ইমরোজের সাথে।
সেই রাতেই অমৃতা লিখলেন ‘শাম কি ফুল’ (সন্ধ্যার ফুল) নামে এক কবিতা। এই ফুলের নাম ইমরোজ।
অমৃতা রোজ অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যায় ইমরোজের বাড়ির সামনে দিয়ে। ইমরোজ বারান্দা থেকে দেখে। অমৃতা বাসে চেপে যায় এটা ইমরোজের ভালো লাগে না। অথচ তিনি তখন টাকা বাঁচানোর জন্যে বাইসাইকেলে চড়েন। অমৃতার জন্যে ইমরোজ মোটরবাইক কেনে এবং একদিন অমৃতাকে বলে, “আসুন আপনাকে পৌঁছে দিই।” অমৃতা জবাব দেয়, “কেন এত দেরিতে এলে?” নাটক নাটক শোনালেও এইভাবেই জীবন এসে হাত ধরে দুজনকে এক বাহনে তুলে দেয়।
এরপর দিন যায়। প্রতিদিন ইমরোজ অমৃতাকে রেডিওতে নামায়, আবার অনুষ্ঠান শেষে বাড়ী পৌঁছে দেয়। একদিন দুজনে মিলে গাড়ি কেনে, বাড়ি বানায় এবং সেই বাড়িতে একসাথে থাকতে শুরু করে। আর পরের চল্লিশ বছর ধরে প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে তৈরী হতে থাকে অনির্বচনীয় ভালোবাসার অপূর্ব সব রূপকথা। শুরু হয় এক অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক। যাকে প্রেম, পরকীয়া, বন্ধুত্ব, দাম্পত্য কোন নামেই ডাকা চলে না।