
অমাবশ্যা রাতে তোমার আমার গোপন সংলাপ
আমাদের গ্রামটাকে সাজাতে গিয়ে কত রঙের প্রয়োজন তা হয়তো তোমার জানা নেই, হয়তো আছে। হয়তো আমারও জানা নেই সাত রঙের কারসাজি। আমি ভুলে যেতে যেতে তোমাকে কিভাবে মনে করেছি তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই। জোর করে বললে কতকিছু নিয়েই জোর করা যায়! আমি জোর করতে পারি না তোমার অবাধ্য সৌরভে। আশার প্রদীপ বরাবরই আমি জ্বালিয়ে তোমার দেশের খবর জানতে উদ্গ্রীব থাকি। হয়তো পুরোটা জানতে পারি না, হয়তো জানতে পারি; কখনো কখনো রাষ্ট্রের সকল অনৈতিকতা তোমার শরীরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যায়। অগ্নিকন্যা হয়ে জ্বলতে জ্বলতে ভুলের ঠিকানায় কখনো হারিয়ে যাও; তা কিন্তু আমি টের পাই। শুধু আমিই না, সমগ্র প্রেমভুবন তোমার কথায় রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র হওয়ার কথা থাকে অন্যকিছু নিয়ে। ইদানিং আমাকে বড্ড বেমানান লাগছে বসন্তের হাওয়ার গন্ধে ভেসে আসা তোমার ফাল্গুনে। তবুও যেন মন মানে না আমার। অধিক চাওয়ার মতো হয়তো আমার কিছু নেই, হয়তো আছে। এমনটা আমি অস্বীকার করতে পারি না। অস্বীকার করলেই হয়তো ডাহা মিথ্যা কথা বলা হবে। কথায় কথায় তবুও বলাটা আমার বদঅভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কারও কারও কিছু এরকমই বদঅভ্যেস থাকে। আমার আছে। তোমাকে বুঝতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলি অবুঝের দলে। যদিও আমি কোনো নীল বা সবুজ দলের সদস্য নই। আমি রঙের কথা বলতে এসে তোমাকে কোন রঙে সাজাবো, এতোক্ষণ সেকথাটাই ভুলে গিয়েছি। ছোট আকারে কবিতা লিখতে গিয়ে তোমাকেই পুরোটা লেখার প্রয়াস নিয়েছি, হয়তো নিইনি, হয়তো তোমাকে পুরোটা লিখতে পারিনি, আর কোনোদিন লেখা হয়ে উঠবেও না। অক্ষমতা, অযোগ্যতা, অর্থহীন ভাষা এসব। এতোদিন ভেবেছি তোমাকে এক পৃষ্ঠার কবিতায় ভরিয়ে দেবো ভালোবাসার সুবাসে। কিন্তু তুমি যে মহাকাব্যের চেয়েও মহাকাব্য তা হয়তো অজানা ছিলো বিবিধ প্রসঙ্গে। আজ যতটুকু জেনেছি বা এখনো জানতেই পারিনি তা প্রশান্ত মহাসাগরীয় চেয়ে অধিক কিছু। সমুদ্র মন্থন করতে গিয়ে তোমার গভীরতায় নিজেকে যখন ভাসিয়েছি তখনই কতকিছু যে চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠেছিলো তা হয়তো সবকিছু দেখেও কতকিছুই চিনতে পারিনি, হয়তো কিছু কিছু চিনেছি কিন্তু তা চোখের আলোয় আবছা আবছা খেলা করে হঠাৎ হঠাৎ। কবিতা লিখতে বসেছি তোমাকে নিয়ে, তোমার রঙের ভাষা নিয়ে, ছন্দ নিয়ে, জাদু নিয়ে, প্রেম নিয়ে, ছলনা-প্রতারণা নিয়ে, কলা-কৌশল নিয়ে। না না, এসব হতেই পারে না। আমি তো তোমাকে অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেছি যা আমার ভাবার মতো কোনো যোগ্যতা নেই। মাঝখানে কি যেন বলেছিলাম— সমুদ্র মন্থন? হ্যাঁ হয়তো সমুদ্র মন্থন। এই শব্দটাতো পৌরাণিক, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের। সামঞ্জস্য আর অসামঞ্জস্য নিয়ে যখন দুই সম্প্রদায়ের লড়াই অব্যাহত, তখন কেউ একজন নিজেকে মহান হিসেবে উপস্থিত করে তোমার বুকের ভেতরে এঁকে দেয় সংকটের নতুন অধ্যায়। আরও দুটি শব্দ অমৃত আর মৃতসঞ্জীবনী। কেউ ছলাকলা ও কূট চাল করেও পার পায়, শুধু তোমার মতো একজনের কাছে নিজেকে উদার, মহান, শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তোমার পায়ে শেষ শূলটা বিঁধিয়ে দেয়, যা তুমি বুঝতেই পারোনি। আমিও না। এগুলো তো তোমার জানার কথা কিন্তু তুমি জানো কিনা আমি জানি না। হয়তো জানো, নয়তো না। তুমি যেমন কোনো রঙের রাজত্ব ছাড়তে চাও না। পৃথিবীতে যুগে যুগে কেউ রাজত্ব হারাতে আগ্রহী নয়। সবাই নিজেকে বীর হিসেবে চিহ্নিত করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। সেভাবে তোমাকে পাওয়ার জন্য আমিও নিজেকে উপস্থাপিত করি। সৃষ্টি থেকে স্রষ্টা যেমন গুণকীর্তনে মত্ত থাকতে ভালোবাসে, ঠিক তেমনি করে তোমাকে পাওয়ার জন্য আমিও তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকি। তোমার রঙের রং থাকুক আর না থাকুক, তবুও দিনশেষে তোমার কাছে পৌঁছে দিই— তোমার রঙের কোনো কমতি নেই, তুমি সর্বজায়া, জননী, জগৎমাতা, সর্বাঙ্গীন।
আমার সাত পুরুষের কোনোদিনই তোমার গুণকীর্তন থেকে বিরত থেকেছে কিনা আমার ধ্যানে ধরা পড়ে না। ধারাবাহিকতার হাত ধরে তোমার কাছেও আমাকে আসতে হলো সাত রঙের খেলায়। বসেছিলাম ক-ছত্র কবিতা লিখবো। কিন্তু কবিতার হাত যে এতো বড় হয়, তা আমার মতো একজন অহংকারী কবির অযোগ্যতার প্রমাণস্মারক। আইনের লোকের কাছে জনসাধারণ বরাবরই শুনে থাকে যে, আইনের হাত অনেক লম্বা, অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে ধরা পড়তেই হবে। আমার অজানার আরও একটা শ্রমণ চোখের কোণে জ্বল জ্বল করছে— কবিতার হাতও অনেক লম্বা। অতএব কবি যত ছোটই হোক তাকে কবিতার আইনে ধরা পড়তেই হবে। কবি যে শহরেই বাস করুক, সেটা ছোট বা বড় শহর, কিংবা গ্রাম, কিংবা মহল্লা হোক, তাকে ধরা পড়তেই হবে। যুগে যুগে বা সভ্যতার ক্রমবিকাশে বহু জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী আর্বিভাব ঘটেছে, বহু ধর্মের, ধার্মিক ও অধার্মিকের; কিন্তু সময় কাউকেই ছেড়ে যায়নি। সবারই পক্ষ-বিপক্ষ মত-অমত খেলা করেছে। সবাই রঙের নানার ঢেউয়ে নিজেকে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ বাণী-মহাবাণী ছুড়ে দিয়েছে। মত-পথের সৃষ্টি হয়েছে। তুমিও যেমন মাঝে মাঝে জনসমাগমে বহু প্রশ্নের বহু জাদুর কেরামতি দেখিয়ে থাকো। ঠিক তেমনিভাবে তারাও করেছে নিজেদের ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে। কারো কারো বহুজন সৃষ্টি হয়েছে, কারো কারো সব মত উল্টিয়ে গেছে। সভ্যতার করালগ্রাস বড় নির্দয়, নির্মম, তা প্রকৃতির বহুজনের মাঝে ফুটিয়ে ওঠে। এখনো তোমার মতো কোনো কোনো মহান ব্যক্তি বা জননী, ধাত্রী নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উপযুক্ত হিসেবে নাজিল করে। সব যে তোমার রঙের খেলা, যা আমি কেন, সহজে কেউ জানতেই পারে না। যারা জানতে পারে তারা হয়তো চিৎকার করেও থেমে যায় সামান্য কিছুর প্রত্যাশায়। তবে কেউ কেউ চিৎকারের আওয়াজে আওয়াজে হারিয়ে যায় সাগরের গভীরে। আইনের হাত যেমন অনেক লম্বা, কবিতার হাত যেমন অনেক লম্বা, ঠিক তেমনি আরও কারো কারো হাত অনেক অনেক লম্বা লালসার গ্রাসে। তারমধ্যে কেউ হয়তো তোমাকে বুঝেও বুঝে না, তোমাকে জেনেও জানে না, যেমন আমি। আজ অবধি আমার যন্ত্রণায় তোমাকে সামিল করতে পারিনি কোনো অজানা সূত্রে। হয়তো আমার অনভিজ্ঞতা, নয়তো আমার কাপুরুষতা। বলতে বলতে কতকিছু বলে ফেললাম। বেশি কিছু বলা যাবে না, এমনিতেই কবিতার হাত অনেক লম্বা, আইনের হাত অনেক লম্বা। বেশি কিছু বললে হয়তো আমার গলা থেকে মাথাটা আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা ফেলে দেওয়া যায় না। তুমিও হয়তো তলে তলে নিজেকে আরও শিখর থেকে উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে আমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবে। হয়তো ভাববে সন্দেহ করছি। তাবৎ মানুষ সন্দেহ করে। পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতামাতাকে, প্রেমিক প্রেমিকাকে, প্রেমিকা প্রেমিককে, স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, ভাই ভাইকে, প্রধানমন্ত্রী দেহরক্ষীকে, দেহরক্ষী তার রক্ষককে, ডাক্তার রোগীকে, রোগী ডাক্তারকে— এভাবে বললে আরও কতকিছু বলা যাবে। না না, আর বলা যাবে না, থাকুক তোমার রঙের কারসাজি, থাকুক তোমার প্রেমের নিবেদন, থাকুক তোমার এড়িয়ে চলার ষোলকলা মন্ত্র। এই বেশ, আমি ভালো আছি তোমার সন্দেহের নানান উপাদেয় খাদ্যে। হৃদয় যদিও থামতে চায় না তবুও মাঝে মাঝে হৃদয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, স্থির থাকতে হয়, নীরবে কাঁদতে হয়, না পাওয়ার আফসোসে পুড়তে হয়, নিন্দুকের অকাট্য যন্ত্রণা মেনে নিতে হয়। শুধু রাত শেষে তোমার কাছে ফিরতে চাই সহস্র বছরের ভালোবাসার ফেরারী আগুন নিয়ে।
দুই.
আজ অমাবশ্যার রাত। তোমার সাথে সংলাপ শেষে চিরচেনা সাগরের গভীরে ডুব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঘরের বাইরে কুকুরগুলোর অনবরত ঘেউ ঘেউ ডাক। গ্রামের লোকেরা বলে তারা নাকি ভূত, পেত্নি, দেবতাসহ বাতাসবাহিত নানান কিছু দেখতে পায়। তারা নাকি পাঁচমন্ত্রী জাতীয় কিছু। কুকুর তো কুকুরই। তারও একটা জীবন আছে, ধর্ম আছে, সে কি মানুষের মতো বা তোমার আমার মতো বুঝতে পারে! যতই সময় গড়াচ্ছে ততোই কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ তেজ বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগে আমার ভাতিজি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু তার যে এটা অসুখ সেটা বুঝাই যায় না। প্রথমত এগুলো আমি বিশ্বাস করি না, এমন কি ধারও ধারি না। শহরে থেকে থেকে আর কমিউনিস্ট ধারার ছোঁয়ায় এসবের বিশ্বাস-ভালোবাসা একেবারেই মুছে গেছে। বিশ্বাস করি না কিন্তু ভাতিজির কান্নার রোল যখন পুরো গ্রামকে জাগিয়ে দেয় তখন আমিও স্থির থাকতে পারিনি। দৌড়ে গিয়েছি, দেখেছি সত্যি সত্যিই তার অন্যকিছু। এখন তাহলে পেছনের দিকে ফিরে গিয়ে বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বলতে চাই— আমার পূর্বপুরুষ অর্থাৎ আমার দাদা একজন নামকরা ওঝা ছিলেন, যাকে গ্রাম্য ভাষায় ওঝা বা মাহাতো বলে। তিনি শুধু ওঝা ছিলেনই না, বাড়ির পাশের কালিপূজার প্রধানও ছিলেন। তোমাকে বলতে আমার কোনো সংকোচ নেই; কারণ তোমাকে এসব জানতেই হবে, না জানালে তুমি খুউব মন খারাপ করবে। প্রতিবছরের চৈত্রসংক্রান্তিতে ঢাক আর সানাইয়ের সুরে দাদা কালিপূজা করতেন এবং মেলাও বসতো। মেলায় আসতো মিষ্টির দোকান, খেলনার দোকান, নানান রকম পোস্টারের দোকানসহ আরও অনেক কিছু। তবে আমার ছেলেবেলাকে কেড়ে নিতো মেলায় আসা ঘুড়ি কেনার মহড়া। তুমি কখনো মেলায় ঘুড়ি কিনেছো কিনা তা আমার জানা নেই। আমি কিনেছি বহুবার। আমার শৈশব-কৈশোর হারিয়ে যেতো নানান রঙের ঘুড়ির আকাশে। একদিন আমার দাদা মারা গেলেন, তবে সেই কালিপূজার কিছুটা ভাটা পড়লো। দাদার পরে আমার বাবা এটার হাল ধরলেন। কিন্তু বাবা দাদার মতো অতোটা পারদর্শী না। আমাদের গ্রামে বা আশপাশের গ্রামের লোকজন চৈত্রসংক্রান্তিকে ‘শিরুয়া-বিষুয়া’ বলে আখ্যায়িত করে। তারা চৈত্রসংক্রান্তি বোঝে না। তারা ‘শিরুয়া-বিষুয়া’ বুঝে। আমিও গ্রামে থাকা অবস্থায় ‘শিরুয়া-বিষুয়া’ই জানতাম। যখন শহরের নানান জাতের ইটের সাথে আমার পরিচয় ঘটলো তখনই বুঝলাম চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ বা নববর্ষ উপলক্ষে শোভাযাত্রা। গ্রামে থাকা অবস্থায় আমি শৈশব-কৈশোরে রং ও কাদা খেলায় মেতে উঠতাম। কখনো হাড়ির কাজল নিয়ে মাতামাতি করতাম গ্রামের দাদী ও বউদিদের সাথে। আমার দাদা ছিলেন কালিপূজার দেবংশি, দাদার পরে বাবা হলেন দেবংশি। ফিরে আসা যাক আমার ভাতিজির কথায়— ভাতিজি বারবার নামান দিচ্ছে অর্থাৎ ভাতিজির উপর কালি ভর করেছে। ভাতিজির দ্বারা কালি দেবী বলছেন, তাকে জোর করে এই ভক্তের বাড়িতে আনা হয়েছে, তাকে গাছের ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। যদি কোনো ওঝা বা মাহাতো তাকে শয়তানদের হাত থেকে রক্ষা করে তাহলে সে এখান থেকে চলে যাবে। এভাবে বেশ কয়েকদিন চলতে থাকলো। তার কথা মতো ওঝা বা মাহাতো আনা হলো। একটু সুস্থ হলো ভাতিজি। এই কালিকে কয়েকজন মাহাতো বা তান্ত্রিক বা ওঝা চালান করে ভাতিজিকে নাগান করেছে (জাদু করেছে)। এভাবে কয়েকদিন চলতে থাকলেও ভাতিজি আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে না। হঠাৎ একদিন তার অসুস্থতা বেড়ে যায়। ফলে বাড়িতে আবার কান্নার রোল চাউর হয়ে ওঠে। পুরো গ্রাম জেগে ওঠে পুনরায়। সবাই হায় হায় করে। বাড়ির কেউ কেউ পাশের বাড়ির কাউকে সন্দেহ করে যে, এটার সাথে তারা জড়িত। আবার মাহাতো বা তান্ত্রিক আসে কিন্তু এখন আর কোনো কাজ হয় না। নতুন মাহাতোর বা তান্ত্রিকের সন্ধানে বাড়ির লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে। অবশেষে সে রকম একজন তান্ত্রিকের খোঁজও মেলে। কিন্তু সে তান্ত্রিক বাড়িতে আসবেন না প্রথম প্রথম। তার কাছে গেলে তিনি একটা পানিপড়া দিয়ে বললেন— এই পানিটা ছিটা দেওয়ার পর যদি মেয়েটা সুস্থ হয় তাহলে নিয়ে আসবেন। সেই পানিপড়া নিয়ে এসে মেয়েটার মুখে ছিটা দেওয়া মাত্রই অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। সবাই অনুমান করলো যে, এই মাহাতো দ্বারাই হবে। তিনি দূরের কোনো আত্মীয়বাড়িতে গিয়ে কাজ করাতে বললেন। সেরকমই একজন আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাজ করানো হলো। ভাতিজিটা ওই দিন থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে গেলেন। সেখান থেকে জানা গেলো যে, তাকে শ্মশানকালি দিয়ে বান মারা হয়েছিলো। যে কথাটা বলছিলাম যে, কুকুর ঘেউ ঘেউ করার রহস্য। ভাতিজি যে মাহাতো বা তান্ত্রিকের কাছে ভালো হলো সেই মাহাতো ওখান থেকেই বাড়ির চারপাশ বন (বন্ধক) করেছেন, যেন কোনো দেও-দেবতা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। যেহেতু দেও-দেবতা বা কালি বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারছে না সেহেতু বাড়ির বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর এগুলোই নাকি কুকুরগুলো দেখতে পাচ্ছে।
আজ অমাবশ্যার রাত। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ির বারান্দার ইলেক্ট্রিকের বাতির আলোয় আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসেছি তোমাকে নানান ফিরিস্তি শোনাব বলে। মনের মধ্যে ভয় ভয় চিত্ত আর্বিভূত হয় দেও-দেবতা বা কালির জন্য। অমাবশ্যার রাতে নাকি এরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় যেখানে সেখানে। কিন্তু তোমার জন্য আমাকে লিখতেই হবে। ভয়কে উপেক্ষা করে তোমাকে আজ শুনিয়েই ফিরবো আমার নতুন কোনো গন্তব্যে। গ্রামের তাবৎ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার একটা সাগরের ঢেউ আছে সেটাও এখন নিঃস্তদ্ধ হয়ে আছে। বাইরে কেউ নেই, ঝিঁ ঝিঁ পোকারা তাদের কবিতার সুর ঢেলে দিচ্ছে ধরণীর বুকে। আমার কানের সাধ্য নেই সে সুর উপেক্ষা করার। আমার বাড়ির পূর্বকোণে একটা প্রকাণ্ড জামগাছ। সবেমাত্র মূল ছাড়িয়ে ছোট ছোট জামের দানা বেঁধেছে, সামান্য বাতাসে কিছু কিছু দানা আমার ছোটো ভাইয়ের টিনের চালায় ঝরে পড়ছে এবং শব্দের খেলা খেলছে। তুমি হয়তো বলবে— এসব শুনে আমার কি হবে? তোমাকে এ জন্যই বলছি যে, আমাকে বুঝতে হলে তোমাকে আমার গ্রামকে বুঝতে হবে, আমার মাটিকে বুঝতে হবে। তুমি হয়তো ভিন্ন গ্রহে বড় হয়েছো। দিনশেষে যে আমাকে আমার কাছে ফিরতে হয় অমাবশ্যার রাতে অথবা রুপালী জ্যোস্নায়। তুমি কখনো গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে হেঁটে পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছো? আমাদের এখানে প্রবাদ আছে যে, পূর্ণিমার দিন কবরস্থানে বা যেখানে সেখানে ভূত-পেত্নীরা কবর থেকে বের হয়ে আসে। তারা সাধারণ মানুষের মতোই চলাচল করে। গ্রামের কোনো কোনো মানুষও নাকি তাদের দেখতে পায়। তুমি এসব বিশ্বাস নাও করতে পারো, আমি তো আর এড়িয়ে যেতে পারি না। বিশ্বাস করি বা না করি, এসব তো আমাকে শুনতেই হবে। যদিও আজ পর্যন্ত কোনো ভূত বা দেবতার সাথে আমার দেখা হয়নি। থাক এসব কথা, তোমার কথায় এখন আসা যাক, তোমাকে নিয়ে যে কবিতা আমি লিখবো তা যদি মহাকাব্য হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আমাকে কোনো দোষারোপ করতে পারবে না তুমি। কারণ তোমার তো মহাকাব্যে মুদ্রাদোষ আছে, যেটা তুমি নিজেই স্বীকার করো। তোমার বক্তব্য— আজ পর্যন্ত যত মহাকাব্য লেখা হয়েছে সেগুলো ব্যতীত আর কোনো মহাকাব্য তুমি পড়তে চাও না। আমারও একটা দোষ হচ্ছে ইদানিং— কোনোকিছুতেই মন বসাতে পারি না। ঘরের বাইরে বের হলেই কত ঢেউয়ের মৌ মৌ গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে যা নিজেকে সামাল দেওয়া যেন কঠিন থেকে কঠিনতর। আমি তো আর মহাপুরুষ নই, শত শত বছর তপস্যা করে ঋষি দূর্বাসার মতো মহাজ্ঞান লাভ করবো। আমি তো সামান্য একজন ধ্যানমগ্ন মানুষ। আমার ক্ষেত্রে শুধু নয়, বাইরের যাদের তুমি দেখতে পাও, তাদের একটু আড়চোখে খেয়াল করো, দেখবে ভেতরে ভেতরে সবাই তোমাকে কামনা করছে, মনে মনে মনকলাও খেয়ে ফেলেছে। তোমার বা তোমার জাতের কারোর বেলা এরকম হয় কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়ার সময় বান্ধবীদের আড্ডায় কিন্তু আমি দেখেছি, তারা কিন্তু মনে মনে মনকলাও খেয়ে বসে থাকে। যে বান্ধবীটার নতুন যোগ হয়েছে তারও কিন্তু অন্যদিকে চোখ জুড়িয়ে যায়। আফসোসের বন্যা কি কেউ কখনো থামাতে পেরেছে! আসলে তৃপ্ত এবং তৃপ্তি বিষয়টাকে আমরা কেউ ধারণ করি না। ধারণ করি বহুজনের বহুমতে। এই যে তোমাকে নিয়ে আমার এতো লেখালেখি, এতো অনুনয়, বিনয়, তবুও কি তৃপ্ততাকে লালিত করতে পেরেছি! হয়তো পারিনি, নয়তো পারার যাত্রা-মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছি।
আজ অমাবশ্যার রাত। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকার পরও আমি ঘুমাতে যেতে পারছি না। তোমাকে নিয়ে যে একটু ঘুমাবো তাও হচ্ছে না, তোমার যৌবনে যে একটু ঘাম ঝরাবো তাও হচ্ছে না, সবকিছু যেন কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে, তাও বুঝতেছি না। আর যদি এই অমাবশ্যার রাতে আমি ঘুমাতে যেতাম তাহলে হয়তো তোমার সাথে আমার এই দীর্ঘ সংলাপ কখনো সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ জাগে। ঘুমাতে না গিয়ে বেশ ভালোই হলো। কতদিন পর তোমার সাথে আমার মন-প্রাণ খুলে আলাপ। প্রাণটা যেন নতুন করে আবার জেগে ওঠলো জ্যৈষ্ঠের আম-কাঠালের মৌ মৌ ঘ্রাণে। আহা! কী শান্তি! পৃথিবীর তাবৎ প্রশান্তি যেন আজ তোমার আমার বাহুর যুগল ধরে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। এ পথ যেন শেষ হওয়ার নয়, এ যোগ যে বিছিন্ন হওয়ার নয়।
আজ অমাবশ্যার রাত। এই রাতে তোমার সাথে যে আমার প্রণয়খেলা হলো, তা কেমন করে ভুলে যাই পৃথিবীর মোহনায়। তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম ক-ছত্র কবিতার সংলাপ শুনাবো বলে; কিন্তু মনের অজান্তেই মনের ব্যাকুলতা তোমার কোলে ঢলে পড়লো, বুঝতেই পারলাম না। যখন লোকমুখে তোমার কথা ছড়িয়ে পড়বে তখন দেখবে— চারদিকে হাহাকারে, আর্তনাদ, চিৎকারে ও করুণ কান্না আছড়ে আছড়ে পড়বে কলঙ্কিনীর বদনাম দিয়ে। কিন্তু তুমি কোনোদিনই সেরকম ছিলে না। তুমি তো একটু ভালোবাসার জন্য রাধার মতো যুগ যুগ ধরে কেঁদেছো। শেষবেলায় এসে তোমাকে এরকম কঠিন কথা শুনতে হবে তা আমার কাম্য নয়। কিন্তু সত্য যে বড় কঠিন, আর কঠিনেরে সবাই ভালোবাসতে চায়, পারে না। কঠিনের সাথে কঠিন যে হতে হয় তা কয়জনের বুকে বল থাকে! অমাবশ্যার রাত বলে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ বাইরে নেই। তারা কি জানে না, হয়তো জানে, বাইরের ভূত তাড়ানো যায়, মনের ভূত তাড়ানো যায় না।
২২ মে, ২০২০
তিন.
আজ ২১ শে জুন, আষাঢ় মাস, বর্ষার যাত্রা-মঞ্চ। আরও একটা অমাবশ্যার রাত। দিনের শুরুতে পৃথিবী দেখেছে বছরের প্রথম বলয় সূর্যগ্রহণ। আমিও দেখেছি, তুমিও দেখছো। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তোমার কাছে ফিরতে পেরেছি যন্ত্রণার কালো থাবায় লীন হয়ে। তোমার সম্মুখে বসার পরও বুকের দীর্ঘশ্বাস ও যন্ত্রণাটা আমাকে কুড়েকুড়ে খেতে শুরু করেছে। আর কে যেন বারবার আমাকে তাড়া দিচ্ছে তোমার কাছে থেকে চলে যাওয়ার। কিন্তু তোমাকে যে আমার খুব মনে পড়েছে, পারছি না তোমার কাছে না ফিরে। যন্ত্রণা যে কতোটা নির্মমতার সাক্ষী তা পৃথিবীর সভ্যতার দিকে তাকালেই যে কেউ হারে হারে টের পায়। আর যারা পায় না তারা তো ভিন্নগ্রহের ভিন্ন কিছু। তাদের কথা কেউ মনে রাখে না, রাখতে চায় না, বলতেও চায় না তাদের উপস্থিতির চিহ্নটুকু। শুধু তাদের কথা সভ্যতা ও ইতিহাস বলে দেয় এবং সাক্ষ্যও দেয় যারা নিজের জন্য পৃথিবীকে ভালোবাসেনি। পৃথিবীকে ভালোবাসতে গিয়ে তোমাকে ভালোবাসার কমতি হোক তা তুমি চাও না, সেটুকু বোঝার জন্য আমার চোখ তার ভাষায় বুঝিয়ে দেয়। সেজন্য হয়তো পৃথিবীর বুক থেকে আমি বিলীন হয়ে যাবো তোমার চিরচেনা ভাষার সাগরে। আমাকে হয়তো কেউ মনে রাখবে না, তুমিও না। সময়ের স্রোতে সহজে কেউ কাউকে মনে রাখে না, এটাই সভ্যতার চরম সত্য। শুধু মনে রাখে ভালোবাসা বিলি করা বরপুত্রদের। আমি তো আর ভালোবাসার বরপুত্র নই, হওয়ারও যোগ্যতা নেই। কেউ স্বীকার করুক বা না-করুক, এটা অন্তত তুমি স্বীকার করো। আমার সারা আকাশ জুড়ে তোমার নামেই যত পদ্য-কবিতা পড়া হয় তার থেকে কয়টা কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে, সেটা তুমিও যেমন জানো, আমিও জানি কিছু কিছু, হয়তো কিছুই জানতে পারি না তার ইতি-বৃত্তান্ত। শুধু মাঝরাতে আমাকে তাড়া করো, জোর করো, বিতাড়িত করো তোমার সঙ্গমের যাত্রা-মঞ্চে। আমার ক্লান্তিতা, আমার ঘুমহীন চোখ, আমার নিদারুণ হৃদয় বোঝে না তোমার দূরত্বের দূরুত্ব! তোমার সঙ্গমের ভাষার তেজস্ক্রিয়তা, আমার বালখেল্যতার সঙ্কটময় রাতের গল্প। সবারই এরকম একটা না একটা গল্প থাকে। কেউ বলতে পারে, কেউ পারে না; আবার কেউ অস্বীকার করে, দাম্ভিকতা দেখায়। কিন্তু এটা তো মহাকালের মহাসত্য। যে কেউ অস্বীকার করুক, তার মন-হৃদয়কে তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না, সেখানে তো তাকে পরাজয় বরণ করতেই হয়। এ-রকম গল্প তোমার আছে কি-না তা কখনোই আমাকে জানতে দাওনি, হয়তো আমিই বুঝতে পারিনি।
আজ অমাবশ্যার রাত, সারা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। আজকের রাতে তোমার কাছে এত যেতে চেষ্টা করছি তবুও যেন যেতে পারছি না, আর পারবো কি-না, মাথায় কিছু আসে না। এ-কষ্ট, এ-যন্ত্রণা, এ-নিদারুণ মঞ্চ আমার বুকের চারপাশটা এফোঁড়-অফোঁড় করে দিচ্ছে। তুমিও যেন আজ আমাকে খুবই এড়িয়ে যাচ্ছ। আমার কাছেই ভিড়তে চাচ্ছ না, হয়তো চাও কিন্তু অন্য কেউ হয়তো তোমাকে আমার কাছে ফিরতে দিচ্ছে না। যা আমার চোখের দৃষ্টিহীন ভাষায় মিলিয়ে যায় অচেনা সুরের ব্যঞ্জনায়। তোমার কাছে ফিরতে না পারার যে ব্যর্থতার গ্লানি তা কিভাবে আমি জীবনের সাথে মিলিয়ে নেবো, কিভাবে অমাবশ্যা রাতের গল্পগুলোয় রং মিশাবো! তা কেন যেন বুঝতেই পারছি না, হয়তো পারছি; কিন্তু কিভাবে যে ভালোবাসার ছন্দগুলো এসে আবার মিলিয়ে যায় তোমার প্রেমের বর্ষাপ্লাবনে। হয়তো তোমাকে বুঝতে না-পারার অযোগ্যতা হচ্ছে নিজেকে বুঝতে না-পারার অক্ষমতা। হয়তো জীবনের প্রান্তে এসে এখনো নিজেকেই জানতে পারিনি, চিনতে পারি না হৃদয়ের শব্দগুলোর অক্ষর-চিহ্ন। নয়তো এখনো শিশু-নার্সারির পাঠ-ই শেষ করিনি। যেটা তুমি হয়তো অনায়াসে বুঝে আমাকে বুঝাতে আসোনি কষ্ট-যন্ত্রণার সাগরে ডুর দেবো, এই ভয়ে। কিন্তু তোমার তো ভয়ের কোনো কারণ ছিলো না। যত অযোগ্যতা, অক্ষমতা— সবই তো আমার-ই। আসলে কেউ নিজেকে প্রথম বুঝতে চায় না, বুঝতে পারে না, কারণ নিজেকে জানা, বুঝা যে বহু পথের সন্ধান-যাত্রা। একবার যেই নিজেকে বুঝতে ও চিনতে পারে তাকে তো আর কেউ হাতের নাগালে পায় না। তখন সে হয়ে যায় পৃথিবীর আরেক মহত্তম ব্যক্তিজন।
আজ অমাবশ্যার রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। এই বর্ষায় তোমাকে নিয়ে কয়েকটা লাইনের কবিতা লিখতে বসে আমার যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা মহত্তম পুরুষই জানেন। শুরুতেই বলেছি, আজ পৃথিবী দেখেছে বছরে প্রথম বলয় সূর্যগ্রহণ। দিনে দু-বার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে নিজেকে একটু ভিজিয়ে নিয়েছি বলেই তোমার উপহারের সুবাস আমাকে একটু ছুঁয়ে যেতে পেরেছে। আমিও সানন্দে গ্রহণ না করে এড়িয়ে যেতে পারিনি। বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার হৃদয়াকাশ ডাকছিলো এই বর্ষায় নিজেকে একটু ভিজিয়ে নিতে। প্রতিদিনই মনস্ত করি— আজই ভিজবো বর্ষার প্রবলধারার বৃষ্টির ছন্দে ছন্দে। কিন্তু একটা ভয় আমাকে সবসময় তাড়া করে বেড়াতো। যখনই আজ নিজেকে বর্ষায় শাণিত করতে পারলাম তখনই তুমি এসে উপস্থিত হয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে গেলে নতুন গানের সুরে ও কথায়। যে সুর, যে কথা, তোমার-আমার যুগলমন ধরে ফেলে যুগান্তকারী প্রলয়ে।
আজ অমাবশ্যার রাত। চারদিকে নিস্তব্দ, কেউ জেগে নেই, একমাত্র প্রকৃতির কন্যারা আর তুমি-আমি। মনের ভেতর ভুত-পেত্নীর ভয়। ভয়কে মানুষ সহজে জয় করতে পারে না, যারা পারে তারা সাধারণ কেউ না। আর আমি তো অতি সাধারণ, অহংকারী নির্বোধ এক কবি। কবিরা অহংকারীই হয়, কারণ তোমাকে নিয়ে এতো এতো ভাবতে হয়, মেতে থাকতে হয়, বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে হয়, বলতে গেলে সব ছেড়ে-ছুড়ে তোমাকে নিয়ে পৃথিবীর কথা ভুলে যেতে হয়। যে মানুষ তোমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না সে তো অহংকারী হবেই। তোমাকে নিয়ে তার তো কোনো চাওয়া-পাওয়ার থাকে না, যাদের চাওয়া-পাওয়ার থাকে তারা কবি হতে আসে না, অন্যকিছু হতে আসে। সেজন্য হয়তো তারা মুছে যায় তোমার মনের ভাষার বর্ণে বর্ণে। কবি অহংকারী হয়, কবি অহংকারী হয় বলেই তুমিও অলংকার হয়ে ওঠো পৃথিবী ও সভ্যতার। আর পৃথিবী ও সভ্যতার বুকে যারা তোমাকে নিয়ে ষোলকলায় মেতে ওঠে তারা ধ্বংসের প্রান্তে এসে তোমাকে নিয়ে বেঁধে ফেলে প্রলয়ের নতুন কাব্য। শোকে, দুখে, যন্ত্রণায় লীন হয়ে যাই তোমাকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু তোমাকে তারা বুঝেও বুঝে না তাদের লালসার গ্রীবার দাম্ভিকতায়। আর আমি তাদের শাপ দিই— নিপাত যাক তোমার বুকের প্রতিবাদমুখর ভাষার মেলায়। আমি কাঁদতে চাই না কোনো অমাবশ্যার রাতে, আমি ভয়ে থাকতে চাই না কোনো অমাবশ্যার রাতের দুপুরে, আমি তোমাকে নিয়েই প্রতিটা অমাবশ্যা কাটতে চাই— তোমার ভালোবাসার মহাফাল্গুনের মহামিলনের জয়োল্লাসে। শুধু আমিই না, পৃথিবীর তাবৎ শান্তিপ্রিয় ভালোবাসার বরপুত্ররাই তোমাকে দেখতে চায় মহাফাল্গুনের মহামিলনের জয়োল্লাসে।
২১ জুন, ২০২০