
অভিসার
পলিন আবার অবাক বিস্ময়ে তাকালো বিশাখার দিকে। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো বিশাখাকে।
-ইউ আর আ গ্রেট উইম্যান! আমি এত অবাক হচ্ছি কি বলব! তাই তো বলি সৌভিককে প্রথম দিন দেখার পর তুমি এত চঞ্চল হয়ে গিয়েছিলে কেন? তারপর ওকে মাঝে মাঝেই বাসায় ডাকা, জোর করে খাওয়ানো ওর সাথে এত এত গল্প করা। ওহ মাই গড! আমি তো কিছু বুঝতেই পারি নি।
বিশাখা এবার কাঁপাস্বরে জানতে চায়
-তোর কি মনে হয় উনি আসবেন?
-আসবেন না মানে? একশোবার আসবেন, উনাকে আসতেই হবে। আমি নিজে উনাকে তোমার কাছে নিয়ে আসবো। ওহ মাই গড! কি করেছ তুমি সবার অলক্ষ্যে! একটা মানুষকে এত ভালোবাসলে! একের পর এক লিখে গেলে তাকে নিয়ে! ইউ আর ওরশিপার অফ হীম। এমন করেও নিজেকে বিসর্জন দেয়া যায়! এতগুলো বছর! আচ্ছা একটা কথার জবাব দাও।
-কি কথা?
-তুমি তো দাদাভাইকেও ভালোবাসো? মানে দাদাভাইকেও তো তুমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলে?
-হুম।
-আর আমার চোখে আমি যা দেখেছি তুমি এখনও দাদাভাইকে অসম্ভব ভালোবাসো। এই যে দাদাভাই ফুপির কাছে চিটাগাং গেছেন তুমি অস্থির হয়ে গেছ, রাতে ঠিকঠাক ঘুমাও না।
-অভ্যাস। তোর দাদাভাইয়ের শরীর না ছুঁয়ে আমি ঘুমাতে পারি না। বেচারা হার্টের রোগী রাতে বারবার আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি ওর গলার, বুকের ঘাম মুছিয়ে দেই, বুকে কান পেতে শুনি নিঃশ্বাস নিচ্ছে নাকি। এইজন্য দূরে গেলে অনেক বেশি চিন্তা হয়।
-দাদাভাই জানেন?
-তিনি তো সবসময়ই খোঁচা দেন, বলেন তোমরা কবি সাহিত্যক মানুষ কতজনের প্রেমে হাবুডুবু খাও, কতজনকে ভালোবাসো।
-অনেকজনকে ভালোবাসা আর একজনকে স্পেসিফিকভাবে ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই যে তুমি সাহিত্যে পুরস্কার পেলে আমরা অনেক খুশি হলাম, কিন্তু কেউ জানে না এর ভিতরে আসলে কি লুকিয়ে আছে।
-পলিন তোকে একটা কথা বলি আমাদের সবারই ভিতরে আর একটা আমি থাকে, যার খোঁজ পাওয়া এত সহজ নয়।
-দিদা তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজবে।
-ধুর পাগলী!
-আমি জানি তিনি কি কি পছন্দ করেন?
-তুই কি করে জানলি?
-আমি তোমার কোনো একটা বই পড়তে বাদ রেখেছি? সবই তো তাকে নিয়ে লিখেছ। পড়তে পড়তেই তো তোমার একটা বইয়ের মাঝে তার ছবি পেলাম, আমি তো জ্ঞান হারাচ্ছিলাম, হুবুহু সৌভিক! তারপর সেই ছবিটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে সৌভিককে দেখালাম তখন সে নিশ্চিত করল যে এটা তার ছোটদাদু। যিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। বাসায় বিশাখা আর পলিন ছাড়া কেউ নেই। পলিনের বাবা-মা দুজনই চাকরি করেন, দুজন কলিগ, একই কলেজে অধ্যাপনা করেন। তবে আজ তাদের একটা অনুষ্ঠান আছে ফিরতে রাত হবে। বিশাখার হ্যাজবেন্ড ইমতিয়াজ গত সপ্তাহে মেয়ের কাছে চিটাগাং গেছেন বেড়াতে। বিশাখার এক মেয়ে। পলিনের বাবা ইমতিয়াজের বড় ভাইয়ের ছেলে। ইমতিয়াজরা দুই ভাই। বড় ভাই-ভাবী মারা গেছেন বছর দশেক হবে। মুহু মানে ইমতিয়াজের মেয়ে তখন কেবল এসএসসি দিবে আর পলিন ক্লাস সিক্সে পড়ে। পৈতৃক বাড়িতে সবাই একসাথেই থাকতো। সবাই আধুনিক ফ্লাটে উঠে গেলেও পলিনের বাবা-মা এই পুরনো বাড়িতেই বিশাখা আর ইমতিয়াজের সাথেই থেকে গেছে, পলিনের জন্য। পলিনও বিশাখার খুব ন্যাওটা। বিশাখাও চাকরি করতো একটা স্কুলে। তবে মেয়ে হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। চাকরি, সংসার, সন্তান, লেখালেখি সব একসাথে পেরে উঠছিল না। বিষয়টা এমন হয়েছিল হয় চাকরি অথবা লেখালেখি। শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকেই বেছে নিল বিশাখা। এর মাঝে মেয়ে বড় হলো, তার বিয়ে দিলেন, সংসার হলো, নাতি-নাতনীরা বড় হলো। পলিন বিশাখার অন্তরআত্মা। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলায় অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। বিশাখার মতো তারও লেখালেখির অভ্যাস আছে। সৌভিক পলিনের বন্ধু, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে, একই বিভাগ ও ইয়ারে পড়ে। গতবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যোৎসবে পলিন বিশাখাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই সৌভিকের সাথে বিশাখার প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতেই বিশাখা অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল, সে কাঁপছিল। কিছুটা স্বাভাবিক হলে অনেকক্ষণ সৌভিকের হাত ধরে রেখেছিল। সৌভিকের মুখে হাত ছুঁয়ে বারবার প্রশ্ন করেছিল
-তোমার নাম কি? তুমি কে?
-আমি সৌভিক।
ফেরার সময় গাড়িতে একদম চুপ ছিল বিশাখা। পলিনও আর কিছু জানতে চায়নি, চুপ থাকাটাই উচিৎ বুঝে গিয়েছিল। কিন্তু সে লক্ষ করেছিল বিশাখা বারবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছছিলো। পলিনের মনে প্রশ্নটা রয়েই গিয়েছিল। সে বিশাখাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নিজে নিজেই উত্তর খুঁজে ফিরছিল। হঠাৎ একদিন সে তার উত্তর পেয়ে যায়। সে সেদিন বাসার লাইব্রেরিতে গিয়ে বিশাখার একটা কবিতার বই থেকে কবিতা পড়ছিল। আচমকাই বইটার ভিতর থেকে একটা ছবি নিচে পড়ে যায়। ছবিটা তুলে দেখতেই পলিনের চক্ষু চড়কগাছ। আরে এতো সৌভিক! আরও ভালো করে ছবিটা দেখে পলিন। ছবিটার পিছনে লেখা যাত্রিক, ১৯৯৪। আর ছবিটাও আজকের ডিজিটাল ছবি নয়, পুরনো রিল ক্যামেরায় তোলা, বোঝায় যাচ্ছে সেটা। ১৯৯৪ সালে তো সৌভিকের জন্মই হয়নি। তাহলে? আর এটা সৌভিক নয়। দেখতে এক রকম হলেও ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় চেহারায় অনেক জায়গায় অমিল আছে। পলিন বিশাখাকে কিছু না জানিয়ে ছবিটা নিয়ে যায়, তারপর সৌভিককে দেখায়। সৌভিক ছবিটা দেখে বলে
-আরে এটা তো আমার ছোটদাদুর ছবি! উনার সাথে আমার চেহারার ব্যাপক মিল। আমার নামটাও উনি রেখেছেন।
-তাই? তোর দাদু এখন কোথায় আছেন?
-এখন দেশেই আছেন। দীর্ঘদিন উনি ইউরোপে ছিলেন। গত মাসে দেশে ফিরেছেন।
-উনার কাছে আমাকে নিয়ে যাবি?
-কেন বল তো? আর উনার ছবিই বা তুই পেলি কোথা থেকে?
-আমার দিদার সাথে উনার কোন কানেকশন আছে।
-ধুস!
-হ্যাঁ রে, আমি এই ছবিটা দিদার কবিতার বইয়ের ভিতর পেয়েছি, আর এই যে যাত্রিক- ১৯৯৪ এটাও দিদারই হাতের লেখা।
সৌভিক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর গম্ভীরস্বরে বলে
-হুউউউম! সেটা থাকতে পারে। আমার ছোটদাদু যাত্রিক আহমেদ যে পরিমান প্লেবয়, সুন্দরী মেয়েদের সাথে তার সংযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। ইউরোপের ১৭টা দেশ তিনি ঘুরেছেন সব দেশেই একটা করে গার্লফ্রেন্ড ছিল। তার বর্তমান গালফ্রেন্ড জার্মানীর, বয়স ৫২, প্রতিদিনই ভিডিও চ্যাটে কথা হচ্ছে।
পলিন চোখ কপালে তুলে বলল
-কি বলছিস! ওহ মাই গড!
-আরে হ্যাঁ। সে এক আজীব ক্যারেক্টর।
-বিয়ে করেন নি?
-করেছিলেন, টিকেনি।
-তোর দাদুর কাছে আমাকে নিয়ে যাবি?
-উহু।
-কেন?
-তুই যদি আবার তার প্রেমে পড়ে যাস?
সৌভিককে খুব জোরে একটা ধাক্কা দেয় পলিন
-যাহ!
সৌভিকের সাথে পলিনের সম্পর্কটা অনেকটা অসংঙ্গয়িত। কখনও তীব্র টান অনুভব করে, কখনও কেমন যেন ঠুনকো লাগে। অবশ্য দুজন সবসময় একসাথে ঘুরে বেড়ায়। কাছাকাছিও এসেছে দুজনে বেশ। লাস্ট ভার্সিটি এক্সকার্শনে সৌভিক পলিনের কপালে চুমু খেয়েছিল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরা ওদের মধ্যে স্বাভাবিক। পলিন সৌভিককে ঠিক বুঝতে পারে না, নিজেকেও না। পরেরদিন পলিন যায় সৌভিকের ছোটদাদু যাত্রিক আহমেদের সাথে দেখা করতে, সাথে বিশাখার প্রথম কবিতার বইটা নিয়ে যায়। সৌভিকের ছোটদাদুকে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায় পলিন। আসলেই প্রেমে পড়ার মতো মানুষ তিনি। প্রায় ষাটের কাছাকাছি উনার বয়স, কিন্তু ব্যাপক স্মার্ট। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পলিনের চোখের দিকে তাকিয়ে যাত্রিক আহমেদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন
-সো বিউটিফুল ইয়াং লেডি আমার সাথে তুমি কেন দেখা করতে চেয়েছ?
তার কন্ঠস্বরে পলিন আরও অভিভূত হয়ে যায়। অসম্ভব ভরাট আর আকর্ষণীয় কন্ঠ। মনে হচ্ছে কেউ কবিতা আবৃত্তি করছে। পলিন কোন ভূমিকা না করেই হাতের বইটি এগিয়ে দেয় যাত্রিক আহমেদের দিকে।
-বইটা আমার দিদার লেখা। উৎসর্গ করা হয়েছে কোনো এক ভালোবাসার অভিযাত্রীকে। অভিযাত্রী আর যাত্রিক শব্দদুটো খুব কাছাকাছি নয় কি?
চোখের চশমাটা খুলে বইটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে যাত্রিক আহমেদ। তারপর খুব ধীরে ধীরে কোন এক সুদূর অতীত থেকে উনি বলে ওঠেন
-বিশাখা! এক নক্ষত্রের নাম।
-কেমন আছে ও?
পলিন এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। উল্টো প্রশ্ন করে
-আপনি উনার লেখা পড়েন?
-পড়তাম। দেশের বাইরে যাওয়ার পর আর হয়ে ওঠেনি।
-উনি এবার সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।
-তাই!
-যে উপন্যাসের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন আপনাকে দেখার পর আমার মনে হচ্ছে সেটা আপনাকে নিয়েই লেখা।
-তাই নাকি? গ্রেট নিউজ। আমার কথা ওর মনে আছে?
-দিদার ম্যাক্সিমাম লেখাই আপনাকে নিয়ে। তখন বুঝতাম না এখন বুঝতে পারছি।
-আপনাকে একটা রিকুয়েষ্ট করতে পারি?
-অবশ্যই।
পলিনের চোখ ছলছল করে উঠলো।
-আপনি কি একদিন আমাদের সাথে চা খেতে আসবেন? মানে আমার দিদার সাথে…. দেখুন দিদা কিন্তু কিছু জানেন না। আমি আপনাকে ইনভাইট করছি।
হঠাৎ পলিনের হাতটা ধরেন যাত্রিক আহমেদ তারপর বলেন
-যাব।
-সত্যি?
খুশিতে পলিনের চোখ ঝলমল করে ওঠে। পলিন চলে যায়। যাত্রিক আহমেদ অতীতে হারিয়ে যান। ১৯৯২ সাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে জয়েন করেন। বিশাখা! এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রেমময় নারী। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে তখন ওরা। ক্লাসে ওর রেসপন্স ভালো ছিল। একই ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ইমতিয়াজের সাথে তার রসায়ন চলছে এ খবরটা জানতে পেরেছিলেন যাত্রিক আহমেদ। মেয়েটা লিখতো। বেশ কয়েকবার যাত্রিক তার খাতায় ছাড়া ছাড়া অনেক লেখাই পেয়েছিলেন। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো। ডিপার্টমেন্টের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওরা কজন এসেছিলো ইয়াং টিচার হিসেবে তাকে আবৃত্তি করার অনুরোধ করে গিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে বিশাখা নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছিল। যাত্রিক সেই কবিতার প্রশংসা করেছিল। একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল টিএসসিতে।
-ভালোই তো লেখিস তুই।
-জ্বী স্যার! মানে….
আর কোনো কথা হয়নি সেদিন। এভাবে কেটে গিয়েছিল কয়েকমাস। যাত্রিকের ক্লাসগুলো একটাও মিস করতো না সে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো। কখনও সবাই বের হয়ে যাওয়ার পরেও বিশাখা বসে থাকতো। চোখাচোখি হয়ে যেতো কখনও। এই চোখের ভাষা বোঝে যাত্রিক। ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ইমতিয়াজের সাথে দেখা যেতো। জুটিটা ভালোই লাগতো। কিন্তু বিশাখার মনে তখন ঝড় উঠেছে। একদিন হঠাৎ চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে বিশাখা ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চায়লো
-স্যার আসতে পারি?
-আয়।
বিশাখা ভিতরে ঢুকে যায়।
-বস। বাবা আজ এতো সাজ কেন? নীল শাড়ি, চুলে কাঠগোলাপ।
কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বই এগিয়ে দেয় বিশাখা
-শুভ জন্মদিন স্যার।
-আজ আমার জন্মদিন নাকি? আজ পহেলা ডিসেম্বর?
-স্যার আসি?
উঠে দাঁড়ায় বিশাখা। চলে যায় সে। প্রায়ই এমন আসতো বিশাখা। জাতীয় দৈনিকেও তার লেখা ছাপা শুরু হলো নিয়মিত। যাত্রিক পড়তো। সে বুঝতে পারছিল একটা বকুল নিভৃতে তার জন্য ঝরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার কিচ্ছু করার নেই। সিগারেট টানতে টানতে সে সুইজারল্যান্ডের ফেলোশিপ নিয়ে ভাবছিলো। সেদিনও এলো বিশাখা। আবার নীল বালুচরি শাড়ি, সাদা মুক্তার মালা। সাধারণ অথচ কি অপূর্ব। কিন্তু মুখ মলিন। সামনের চেয়ারে বসে উসখুস করছে সে।
-কিছু বলবি?
-আগামী মাসের ৫ তারিখ ইমতিয়াজের সাথে আমার বিয়ে।
বলেই সাইডব্যাগ থেকে কার্ড বের করে যাত্রিকের দিকে এগিয়ে ধরলো।
যাত্রিক বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল
-অভিনন্দন।
মুহুর্তে বিশাখার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো
-আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি স্যার?
যাত্রিক কোন কথা না বলে ওর হাত দুটো ধরলো। বিশাখা কাঁদছে। গুমরে গুমরে কাঁদছে, শব্দ হচ্ছে না।
যাত্রিক বসা থেকে উঠে এসে ওর পাশে দাড়ালো। কোন কিছু না ভেবেই বিশাখা তাকে জড়িয়ে ধরলো। যত্রিকের শার্ট বুকের কাছে ভিজে গেলো। যাত্রিক ওর চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। কানে কানে ফিসফিস করে বলল
-সব ভালোবাসার পরিনতি হয় না রে পাগলি। সামনে সপ্তাহে আমার ফ্লাইট সুইজারল্যান্ডের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ফেলোশিপ পেয়েছি।
বিশাখা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যাত্রিককে। মুখে কোন কথা বলল না। সব কথা মুখে বলা যায় না।
২৮ বছর! হ্যাঁ ২৮ বছর পর আবার যাত্রিকের সাথে দেখা হবে। এই ২৮ বছরে একটা মুহুর্তের জন্যও যে মানুষটাকে ভুলতে পারেনি বিশাখা। পাগলের মতো ভালোবেসেছে। বারবার দেখতে ইচ্ছে করেছে। যাত্রিক এর মাঝে কয়েকবার দেশে এসেছিল, ইমতিয়াজ মাঝে মাঝে বলতো
-তোমার প্রিয় স্যার যাত্রিক আহমেদ তো দেশে এসেছেন। যাও দেখা করে এসো।
ইচ্ছে করেই যেত না বিশাখা। কেন যাবে? যে মানুষটা একবারও তার খোঁজ নেয় না, তার কাছে কেন যাবে? তার সকল অভিমান, ভালোবাসা সে কাগজে লিখে ফেলল। লিখতে লিখতে এতগুলো বই হয়ে গেলো! এত কথা ছিল মনে? সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। পলিন জোর করে নীল একটা শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে বিশাখাকে, চুলে কাঠ গোলাপ। বিকেলে তার আসার কথা। বিশাখা ছটফট করছিল মনে মনে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। বিশাখা চমকে উঠলো। পলিন যেয়ে গেইট খুলে দিল। বহুদিন, বহুদিন পর সেই পরিচিত গন্ধ, সেই মানুষটা! বিশাখা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, সোফায় বসে পড়লো। সেই ভরাট কন্ঠস্বর
-কেমন আছিস বিশাখা?
বিশাখার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, কিন্তু কোন শব্দ বের হলো না। পলিন পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বলল
-দিদা, ছোটদাদু তোমার জন্য নিজের বাগানের অপরাজিতা নিয়ে এসেছেন, দেখ।
ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালো বিশাখা, খুব মৃদুস্বরে বলে উঠলো
-বসুন স্যার, ভালো আছেন?
-আর ভালো! বয়স তো কম হলো না।
বলে সিগারেট ধরালেন, পলিনের দিকে তাকিয়ে বলল
-এস্ট্রে প্লিজ।
পলিন সাথে সাথে এস্ট্রে এনে দিল।
-স্মোক আর ছাড়তে পারলেন না?
-ছাড়ার চেষ্টাই তো করিনি কখনও।
-দিদা তোমরা কথা বল, আমি আর সৌভিক উপরের লাইব্রেরি থেকে তোমার বইগুলো নিয়ে আসি।
পলিন আর সৌভিক চলে গেলো। বিশাখা নাতনীর চালাকিটা বুঝে মনে মনে হেসে উঠলেন।
-স্যার বসুন আপনার জন্য চা নিয়ে আসি।
বিশাখাও যেন পালাল। কিচেনে এসে জোরে একটা শ্বাস নিল বিশাখা। কিছুকক্ষণ পর চা আর নাস্তা নিয়ে ফিরলো সে।
-শুধু লিকার তো?
-হুম, মনে আছে তোর!
-মনে রেখেছি।
-আর কি মনে আছে?
-কেউ একজন পুরো হৃদয় জুড়ে আছে।
মাথা নিচু করে বলল বিশাখা, চোখ ছলছল করছে।
যাত্রিক কিছু বলে না, চায়ে চুমুক দেয়।
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিশাখার খুব ইচ্ছে করছে যাত্রিকের হাত ধরতে। কিন্তু ধরা হয় না। দুজন মুখোমুখি বসে থাকে। বাইরে বেপরোয়া বৃষ্টি কত কথা বলে যায়। ২৮ বছরের সব কথা এক জায়গায় স্থীর হয়ে থাকে। পলিন আর সৌভিক দূর থেকে সবই লক্ষ করে।
-কি অদ্ভুত তাই না?
পলিন নেশতুর চোখে তাকায় সৌভিকের দিকে, সে নেশা সৌভিককেও সংক্রমিত করে। সে পলিনের হাতে হাত রেখে বলে-
“তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।”
পলিন একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। ঠিক সৌভিকের চোখে চোখ রেখে বলে
“Blow gentle over my garden
Wind of the southern sea
in the hour that my love cometh
And calleth me.”
সৌভিক পলিনের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে
-তাহলে চুমু খেতে বলছিস?
-এখানে চুমু এলো কোথা থেকে?
কেন এর অনুবাদে রবিবাবু বলেছেন
“চুমিয়ে যেও তুমি
আমার বনভূমি”
পলিন সোভিকের ঠোঁটে হাত রেখে ওকে থামিয়ে দেয়। তারপর ঠোঁটটা ওর ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে
-প্লেবয় দাদুর নাতি, এত সাধু কেন তুই? চুমু খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে হয়? চুমু খেয়ে নিতে হয়।
তারপর নিজের ঠোঁটের সাথে সৌভিকের ঠোঁট একাকার করে ফেলে। চোখের কোনে চিকচিক করে ওঠে জল। মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণি। সুখ-দুঃখ সব অনুভূতিতেই তার চোখ ভিজে যায়। বাইরে তখনও অনেক বৃষ্টি, আকাশ-পৃথিবীর অভিসার তুঙ্গে। বিশাখা আর যাত্রিক বসে থাকে মুখোমুখি। একজনমের সব কথা আজ শেষ হয় নীরবতায়।