
অভিনেত্রী
সাগুফতা হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের তিন তলায় উঠে এলো। কেবিনগুলো এখানেই। তিন তলায় উঠতেই সুজিত দাদার সাথে দেখা হয়ে গেলো, থিয়েটারের অন্যরাও আছে।
-দাদা, আমাকে রাতে জানাও নি কেন?
হাঁপাচ্ছে সাগুফতা, সিঁড়ি দিয়ে উঠেছে।
-তুই শান্ত হ, বিপদ কেটে গেছে, ও এখন ভালো আছে।
-কিভাবে? মানে কি হলো? এত ছোট্ট একটা মানুষ, এত ভালো অভিনয় করে।
এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে ও প্রশ্ন করে
-তোরা কেউ কিছু জানিস না? মানে তোরা তো ওর অনেক কাছের।
সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কোন উত্তর দেয় না। সাগুফতা আবার বলতে থাকে
-তোরা থিয়েটারের মানে বুঝিস? থিয়েটার মীনস আ ফ্যামিলি, একটা পরিবার। আমাদের পরিবারের একজন সুইসাইড এটেম্প করলো আর তোরা কেউ কিচ্ছু জানিস না।
সুজিত এসে ওর হাত ধরলো
-তুই শান্ত হ, আমি আছি তো।
-না দাদা, কি বল? আর সাত দিন পরে শো, সব রেডি। আর এই ঘটনা, তুমি আমাকে শান্ত হতে বলো?
-আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে।
এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে সুজিত বলল
-এই তোরা এবার যার যার বাড়ি যা, সারারাত সবার অনেক ধকল গেছে। সামনে শো, সবাইকে অসুস্থ হওয়া যাবে না, আমি আছি, এখন তোদের দিদি চলে এসেছেন, আমরা সামলে নেব।
সবাই মাথা নিচু করে চলে গেলো।
সবাই চলে গেলে সুজিত সাগুফতার হাত ধরলো
-তোকে কিছু বলার আছে, একটু শান্ত হ।
-বলো, সিরিয়াস কিছু?
-হুম। একটু সামলে নে নিজেকে।
-বলো, সমস্যা নেই।
-মুকুল সুইসাইড নোটে তোর কথা লিখেছে।
-মানে? হোয়াট দ্যা…..
সাগুফতা সুজিতের হাত ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
-এদিকটা আমি সামলে নিয়েছি, পুলিশ কেস টেস হয়নি, নোটটাও আমার কাছেই আছে। তোকে জানানো দরকার তাই জানালাম।
-দাদা!
আর কিছু বলতে পারে না সাগুফতা।
-মুকুল তোকে ভালোবাসে। সেটা তুই এবং আমরা সবাই জানি।
-ও আমার পনেরো বছরের ছোট, শুধু ও ই না ওরা সবাই আমার এক একটা সন্তান। অভিমন্যু আর ওদের মধ্যে আমি কোন পার্থক্য করি না।
-কিন্তু ও তো তোকে……
-ব্যাস।
হাত তুলে থামিয়ে দেয় সাগুফতা।
-ডিরেক্টর হিসেবে আমাকে অনেকের অনেক কাছাকাছি যেতে হয়, অনেক কিছু করতে হয়, তার মানে এই না….
একটু থামে ও। আবার বলতে থাকে
-ওর জ্ঞান ফিরেছে? আমি দেখা করতে পারব?
-হুম। ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বিকেলে রিলিজ করে দিবে।
আর কোন কথা বলে না সাগুফতা, সোজা কেবিনে ঢুকে যায়। মুকুল বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে ওর বোন যূথী বসা। সাগুফতাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ায়।
-যূথী, একটু বাইরে যাবে? আমি একটু কথা বলব ওর সাথে।
যূথী কিছু না বলে বাইরে চলে যায়। সাগুফতার কণ্ঠ শুনে মুকুল চোখ খোলে, উঠে বসার চেষ্টা করে। সাগুফতা তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে আবার শুইয়ে দেয়।
-উঠতে হবে না, শুয়ে থাক।
তারপর বেডে বসে সাগুফতা। ঠিক মুকুলের চোখে চোখ রাখে ও।
-কেন এমন করলি?
মুকুল চোখ বন্ধ করে ফেলে। দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা অশ্রু।
-মুকুল আমি তোকে প্রশ্ন করেছি?
-আমি যেদিন থেকে তোমাকে ভালোবাসার কথা বলেছি তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ। আমি তোমার প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারি নি।
-জীবন এত সহজ? কতটুকু তুই আমাকে জানিস?
-জানি, অনেকটা জানি। কি দোষ আমার? কেন একটু ভালোবাসতে পারো না আমায়?
-মুকুল, তুই আমার ১৫ বছরের ছোট। আর তাছাড়া তুই এসব বুঝিস না এখনো, এটা ভালোবাসা না, শুধু আকর্ষণ।
-ওসব বয়স টয়স বাদ দাও। আমি ওসব মানি না। তোমাকে না দেখলে আমার খারাপ লাগে, তোমার হাত না ছুঁতে পারলে কষ্ট হয়।
-সেটায়, এটা ভালোবাসা না, শুধু আকর্ষণ।
-অন্য কারো জন্য আমার কখনো এমন হয় নি। কখনোই না। কেন আমাকে ভালোবাসো না? একটু ভালোবাসলে কি হয়?
-বাসি তো। ভালোবাসা অনেক রকমের হয়, মায়ের ভালোবাসা, বোনের ভালোবাসা, বন্ধুর ভালোবাসা।
-আমার এসব ভালোবাসা চাই না, আমি তোমাকে সবসময় দেখতে চাই, ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকতে চাই।
-তোরা এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা ছোঁয়াছু্ঁয়ি ছাড়া কিছু বুঝিস না, রবীন্দ্রনাথ পড়।
-ধুর তোমার রবীন্দ্রনাথ! সারাজীবন যে লোকটা শুধু প্রেমই করে গেলো, হাজার রকমের প্রেম, হাজার মানুষের সাথে আর তুমি তাঁর উদাহরন দিচ্ছ?
-আচ্ছা তর্ক বন্ধ কর, তুই তো এখন সুস্থ, কাল থেকে আবার রিহার্সাল শুরু হবে। গ্রুপকল বিকেল ৫টা। সময় মতো চলে আসিস।
-অভিনয় ছাড়া তুমি আর কিছু বোঝ না?
-না।
সাগুফতা উঠে দাঁড়ায়।
-রেস্ট নে। আমি এবার উঠব।
সাগুফতা দরজার দিকে পা বাড়ায়।
-শোন!
খুব কাতর ডাক মুকুলের। সাগুফতা দাড়িয়ে যায়, পিছনে ফিরে তাকায়।
-কি বল?
-এদিকে আসো একটু।
সাগুফতা আবার মুকুলের বেডের কাছে আসে। তার চোখে জিজ্ঞাসা।
-তোমার হাত দুটো একটু দেবে? ছুঁয়ে দেখবো।
সাগুফতা কথা বাড়ায় না। দুহাত দিয়ে মুকুলের হাত ধরে। মুকুল হাত দুটো চিবুকে ছুঁইয়ে রাখে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। সাগুফতা এবার হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর কিছু না বলে চলে আসে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় সাগুফতার। কারো সাথে কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে চলে যায় সে। বাবা-মা আর এক বোন। বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার, ভিষণ ডিসিপ্লিন্ড। তবে সাগুফতা এসব কখনোই কেয়ার করে না। আগে যা ও একটু মানতো, ইশতিয়াক মারা যাওয়ার পরে আর অভিমন্যুকে ওর দাদা নিয়ে যাওয়ার পরে আর ওসব একদম কেয়ার করে না। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে, তারপর চলে যায় ছাদে। আজ বিকেলে বেশ ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। একটু শীত শীত করছে। বোতলের মুখ খুলে গ্লাসে ঢালে তরল পদার্থ। আকাশের দিকে মুখ করে বসে চলে মাতাল হওয়ার প্রস্তুতি। কতক্ষণ কেটে গেছে ঠাওর করতে পারে না ও। হটাৎ কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। পিছনে ফিরে দেখে ছোটবোন শাম্মী।
-কয় পেগ হলো?
-৫।
-এবার থাম। তা তোর কিশোর প্রেমিকের খবর কি? এত কিছুর পরেও তুই-ই ডিরেকশন দিবি?
-বাজে বকিস না। ও আমার প্রেমিক হবে কেন? আর ডিরেকশন দিব না কেন? নাট্যকর্মীদের এত আবেগী হলে হয় না। আবেগ সংযত করে অভিনয় করতে হয়।
-হুম বুঝলাম, বাট হি লাভস ইউ।
-বাট আই ডোন্ট। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কেন?
-দ্যাট ওয়াজ এন এক্সিডেন্ট।
-নট এট অল। দ্যাট ওয়াজ আ মার্ডার। আই কীলড হীম।
সাগুফতা আবার গ্লাস তুলে নেয়।
-ভুল দিদি। পিয়াস পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলো। কেন নিজেকে দোষারোপ করিস?
-না ও পা পিছলে পড়েনি শাম্মী। ওর চোখ দুটো এখনো আমি দেখতে পাই। কি আকুতি! ভালোবাসায় ভরা! তারপর পড়ে গেলো।
-ইউ লাভড হীম।
-অফকোর্স আই ডু লাভ। এন্ড স্টীল আই লাভ হীম। আই লাভ হীম। পিয়াস! পিয়াস আই লাভ ইউ।
সাগুফতা কান্নায় ভেঙে পড়ে। শাম্মী ওকে জড়িয়ে ধরে।
-শান্ত হ দিদি, ওইটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।
-না ওইটা এক্সিডেন্ট ছিলো না। ও সুইসাইড করেছিল। ফুটফুটে একটা ফুল নিজেকে শেষ করে দিলো আমার জন্য। আমি ওকে খুন করেছি, আমি।
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে সাগুফতা। শাম্মী ওকে জড়িয়ে ধরে।
-আমার নিজের বলতে কিচ্ছু নেই। আই এম নট আ গুড মাদার, নাইদার আ গুড ওয়াইফ নর আ গুড ডটার। এন্ড অফকোর্স নট আ গুড সিস্টার। আই এম অনলি আ গুড এক্ট্রেস, নো নো নো দ্যা বেস্ট এক্ট্রেস ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। আই এম এক্টিং উইথ মাইসেল্ফ এন্ড অলসো এক্টিং উইথ দ্যা হোল ওয়ার্ল্ড। ইশতিয়াক মারা গেল আমি কিছু করতে পারলাম না। অভিমন্যু, আমার একমাত্র ছেলেকে কোর্ট তার দাদুর কাস্টডিতে দিলো, আমি নাকি বাউন্ডুলে মানুষ। আমার জীবন যাপন বিশৃঙ্খল। বাবা-মা আমার জন্য কষ্ট পান, তুই…
শাম্মী এবার ওর মুখ চেপে ধরে।
-চুপ, একটা কথাও না আর। চল ঘরে চল।
সাগুফতা শাম্মীকে জড়িয়ে ধরে, ফুঁপিয়ে ওঠে
-আমি পিয়াসকে বড় ভালোবাসতাম রে, বড় ভালোবাসতাম। আমার অবহেলা সহ্য করতে না পেরে ছেলেটা সুইসাইড করলো। অথচ আমি ওকে…
শাম্মী সাগুফতাকে ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
-অভিনয় ছাড়া আমি আর এ জীবনে কি করেছি? শুধু অভিনয় করেছি। আমি পিয়াসকে ভালোবাসতাম অথচ কখনো ওকে কাছে ভিড়তে দেই নি। অসম বয়স, অসম প্রেম।
শাম্মী সাগুফতার মাথার কাছে বসে থাকে। সাগুফতা প্রলাপ বকতে থাকে। রাত গভীর থেকে গভীর হয়। একজন অভিনেত্রী অভিনয় করে চলে নিজের সাথে, পুরো পৃথিবীর সাথে।
পাঁচ বছর আগে প্রায় সব পত্রিকাতেই একটা খবর ছাপা হয়। নাটক পাড়াতেও বেশ হৈ চৈ হয়েছিলো। পিয়াস নামের কম বয়সী এক নাট্যকর্মী মহড়ার সময় ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যায়, সে নাটকের ডিরেক্টরও ছিলো সাগুফতা।