
অনন্তলোকের পথে
ইয়াসমিন হক একটি সৃজনশীল স্কুলের শিক্ষক। স্কুলে ললিতকলার বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাস হয়, তার মধ্যে নাচ-গান, ছবি আঁকা এসব তো আছেই। এর বাইরে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক অনেক কার্যক্রমও আছে। শিশুরা প্রতি বৃহস্পতি-শুক্রবার ধরা-বাঁধা নিয়মের বাইরে স্কুলে এসে খেলাধূলার পাশাপাশি গল্প-আড্ডায় মেতে থাকে। ইয়াসমিন হক শিশুদের এসব কর্মকাণ্ড খুব উপভোগ করেন।
এক শুক্রবার একটি শিশু তার বাবার হাত ধরে স্কুলে আসে। বয়স কত হবে- আট কি নয়। আসে গান শিখতে। তার ডাকনাম নীল। ছেলেটির চোখে মুখে যেন শোকের ছায়া। শিক্ষক ইয়াসমিন হকের কেমন একটা মায়া হয়। নীলের বাবার কাছ থেকে জানা গেল নীলের মা নেই; নীলের যখন এক বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। সেই থেকে নীলের বাবাই তার বাবা-মা। নীলের বাবা জানান অন্য দশটি শিশুর চেয়ে নীল খুব পরিণত বুদ্ধির। এই বয়সেই নীল খুব পরোপকারী নিজের টিফিন অন্যকে খাওয়ানো, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে গরীব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দিয়ে দেয়া, ছোট ভাই-বোনদের সহযোগিতা করা, কেউ ঝগড়া করলে তার মধ্যস্থতা করা এবং লেখাপড়ায় সহযোগিতা করা সবই করে ও।
পাঁচ বছর পর
ফাল্গুন মাস। একটা দোয়েল পাখি আমগাছের ডালে বসে শিস্ দিচ্ছে। ইয়াসমিন হক জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেন, কাঁটাভর্তি মান্দার গাছটা লাল ফুলে ছেয়ে আছে। শৈশব থেকেই বসন্তকাল বা ২১ ফেব্রুয়ারির কথা উঠলেই পলাশ-শিমুল ফুলের নাম শোনা যায় কিন্তু ইয়াসমিন হকের চোখে লাল রঙের মান্দার অর্থাৎ মাদার ফুলের ছবি ভেসে ওঠে। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পুরানো কাগজ-পত্র গোছাতে গিয়ে একটি পত্রিকার পাতায় চোখ আটকে যায় তার। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইয়াসমিন হকের বুক থেকে। হেডলাইনটি বলছে-‘নদীতে ডুবে স্কুল ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু’ এবং সাথে কিশোরের হাসিমাখা মুখাবয়বের ছবি ছাপা হয়েছে। ছেলেটা মারা যাবার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যত্ন করে কাগজটি আলমারিতে উঠিয়ে রাখেন তিনি। প্রাত্যাহিক জীবনের চাপে কত কঠিন কষ্টও আড়াল হয়ে যায় এই শোকের মাঝেও গতকাল তিনি ভাগ্নীর বিয়ের দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানে সবাই প্রশ্ন করেছে-‘তোমার ছাত্র আত্মহত্যা করলো কি কারণে, কেন?’ রাস্তাঘাটে, বাড়িতে, স্কুলে সামাজিক মাধ্যমে সর্বত্র ইয়াসমিন হককে একই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে। খুব দ্রুত ঘর গুছিয়ে স্কুলে যান তিনি। স্কুলে গিয়ে বসতে না বসতেই অফিস সহকারি রহমান এসে জানায় একজন দেখা করতে এসেছে।
সাংবাদিক আবিদ এসে সালাম দেয়। ২৫/২৬ বছর বয়সী আবিদ বিভিন্ন সময়ে ইয়াসমিন হকের স্কুলের কার্যক্রম নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করেছে। তিনি জানতে চান- আবিদ তুমিও আমার ছাত্রের ব্যাপারে জানতে চাও? আমি সবার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।’
আবিদ হেসে উত্তর দেয়-আজকে আমি আপনার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি অন্য কোনো কারণ নেই।
ইয়াসমিন হক উদাস স্বরে বলেন, চমৎকার একটি ছেলে। এ্যাতো ভালো গান করতো; আমি চোখ বন্ধ করলে তার গান শুনতে পাই। ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা…’ অথচ দেখো সেই আলোতে সে নেই।
আবিদ ক্যামেরাটা নাড়াচাড়া করতে করতে প্রশ্ন করে-আপা আমরা শিশুদের বই পড়াই, পরীক্ষা নেই, জিপিএ ফাইভ পেতে বলি, এতসব দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার সময় ওদের কথা কি একবারও ভাবি?
-ভাবি না, একবারও ভাবি না। বরং ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো একটানা লেখাপড়া-রেজাল্ট-ভর্তিযুদ্ধ এসব নিয়ে মাথা শেষ করি!
দু’জনের কথার ভেতর শারমিন এসে ঢোকে। শারমিন গানের শিক্ষক। বহু স্মৃতি তার; সে-ও যোগ দেয় কথার মাঝে। বলে শুধু যে ভালো গাইতো তা না, ভালো বাজাতোও সে।
ইয়াসমিন হক দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। শারমিন আবার বলতে শুরু করে-কিছুদিন ধরে ওর মাঝে হতাশা লক্ষ্য করেছি কিন্তু এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে বুঝতেই পারিনি। ওর বাবার বিয়েটা একটা ব্যাপার ছিল।
আবিদ শারমিনের কথা ধরে বলে, আমি তো জানতাম রফিক ভাই ছেলের জন্যই এতকাল বিয়ে করেননি।
ছেলের অনুমতি নিয়েই দু’বছর আগে রফিক সাহেব বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা ঠিক নীলকে বুঝতে পারেননি।
তিনজনের মাঝে পরিবার ও শিশুদের বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা হয় তার মধ্যে পারিবারিক বিভেদ, শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, মিডিয়ার প্রভাব ইত্যাদি। ইয়াসমিন হক এভাবে আলোচনার ইতি টানেন- প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নানা কারণে পুরাতন সামাজিক রীতিনীতিগুলো বদলে যাচ্ছে আবার নতুন রীতিনীতি কি হবে আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারছি না। এসব নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে।
সবাই চলে গেলে সাত তারিখের ঘটনাটি আবার ভাবার চেষ্টা করেন ইয়াসমিন হক। সেদিন দুপুরের পরে খাওয়া-দাওয়া সেরে ডাইনিংয়ে বসেই ওষুধটা খাবে এরকম একটা সময়। ওষুধ বাসায় ছিল না গৃহকর্মী রহিমাকে নিচে পাঠিয়েছিল ওষুধ আনতে। দরজা ঠেলে রহিমা ঢুকে।
-খালাজি, এই যে আপনার ঔষধ আর ট্যাকা।
টেবিলে রেখে ও রান্না ঘরে ঢোকে; ইয়াসমিন হক গ্লাসে পানি ঢালছিল ওষুধটা খাবে বলে, এমন সময় মোবাইলে রিংটোন শুনতে পায়। স্ক্রিনে শিমুর নাম দেখে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা রিসিভ করে। আরে! শিমু কেমন আছিস?
উত্তর না দিয়ে শিমু বলতে থাকে- তোর ছাত্রের খবর শুনিস নাই?
অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে ইয়াসমিন হক-কার কথা বলছিস?
শিমু জানায় ভোরবেলা নীলকে মৃত অবস্থায় নদী থেকে উদ্ধার করেছে স্থানীয় লোকজন।
-কী বলিস!
কোনরকমে একটা শাড়ি পড়ে ইয়াসমিন হক বেড়িয়ে পড়েন। শিমুও ইতিমধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল; দু’জন উঠে পড়ে একটি অটোরিকশায়। উত্তরপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয় তারা। পৌঁছে শুনে নানাজনের নানা মন্তব্য-
-পানিতে ডুবে মারা গেল। কিন্তু ও তো সাঁতার জানতো। তাহলে কিভাবে…
-নদীর ঐপাড়ে প্রচণ্ড স্রোত ছিল হয়তো পাঁকে পড়ে গেছে।
-নীলের বাবা বলল ওর তো শ্বাস কষ্টের সমস্যা ছিল
-মা না থাকলে বাচ্চাদের যা হয়।
-বাবা খুব আদর করতো তাই বাবার দ্বিতীয় বিয়ে মানতে পারেনি হয়তো।
-পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদের কথা শুনেছি। শুনেছি ওর সৎমা ওকে খুব বকাঝকা করতো।
-এতো দায়িত্বশীল একটা ছেলে। ভালো গাইতো, ছবি আঁকতো। কেন যে বাঁচতে পারলো না!
এসব নানাজনের ভাবনার শেষ নেই। তখনো লাশ বোধহয় এসে পৌঁছায়নি। তারপর কে একজন বলে উঠলো লাশ বড় মাঠে জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অন্যদের সাথে শিমুকে সাথে নিয়ে ইয়াসমিন হকও সেদিকে ছুটলেন।
অন্যদিনের মতো বড় মাঠে কোন খেলাধূলা নেই। স্কুলের সামনে টগর গাছটায় দু’একটা সাদা কুঁড়ি উঁকি দিচ্ছিল, বাতাসে তাদের মাথা দুলছিল। পুরানো দালানের পিছনে বুড়ো বকুল গাছটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নানা বয়সী লোকজন ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে লাল দালানের দিকে। ভিড় ঠেলে শিমু ইয়াসমিনকে নিয়ে হাজির হয় বারান্দার কাছাকাছি। সেখানে দেখা হয় নীলের বাবার সাথে; ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। একটা কেমন কান্নার বেগ ভেতরে উথলে উঠল। নিজেকে সংবরণ করলেন ইয়াসমিন হক। কফিনের চারপাশে নীলের অসংখ্যা বন্ধু কাঁদছে। পেছন থেকে একজন বলছে-তোমার ছেলেকে সরাও।
ইয়াসমিন হক তাকিয়ে দেখে সাব্বিরকে ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে। হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মুখ ঢেকে দিয়ে খাটিয়াটা কাঁধে নেয়ার সময় শিশু-কিশোর আত্মীয়-স্বজন সবাই একসাথে ডেকে ওঠে- নীল! নীল! নীল!
এতক্ষণ ইয়াসমিন হক ছাত্রদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এবার সবার সাথে তিনিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন- বাবা তোকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না!
ছোটবেলা থেকে শিমু যে ইয়াসমিনকে দেখে বড় হয়েছে আজ তার সাথে মেলাতে পারছে না। শিমুর কাঁধে মাথা রেখে অজোর ধারায় কাঁদতে থাকে ইয়াসমিন হক।
বারান্দায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে, মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় নীলকে জানাজার জন্য। রফিকুল ইসলাম সবার কাছে কোন ঋণ আছে কিনা জানতে চান।
নীলের চাচাতো বোন উর্মিলা চিৎকার করে বলে ওঠে-আমাদের সবাইকে সবসময় সহযোগিতা করেছে নীল। কেন তুই আমাদের ঋণী করে চলে গেলি! তুই তো শুধু মানুষকে দিতে এসেছিলি; কারো কাছ থেকে কিছু নিতে নয়! অনন্তলোকে তুই ভাল থাকিস প্রিয় ভাই আমার!